রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ক্যানাল শহর ইউট্রেকট।

ইউট্রেকট যাওয়ার জন্য দাদা আগেই থ্যালিস নামে একটা ট্রেন কোম্পানির টিকিট বুক করে রেখেছিল। এখানে ভারতীয় রেলওয়ের মতো কোনও জাতীয় রেল নেই। যেতে আসতে খরচ পাঁচশো ইউরো মতো। মানে প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা। ট্রেন ধরতে হবে ইন্টারস্টেট ট্রেন স্টেশন থেকে। প্যারিস গার্ডেনর স্টেশন। সেটা একটু কঠিন জায়গা। সেখান থেকে কত যে ট্রেন ছাড়ছে তার ঠিকানা নেই। সবাই পই পই করে বলে দিয়েছিল গার্ডেনর স্টেশনে খুব সাবধান। ওখানে নাকি পার্স, হ্যান্ডব্যাগ হামেশাই চুরি হয়ে যায়। পেশাদার চোর নাকি আছে এখানে। এমনকি আমার বউদির পর্যন্ত হ্যান্ডব্যাগ চুরি হয়ে গিয়েছিল। আজকাল ট্যুরিস্ট শহর প্যারিস, রোম, বার্সিলোনা সর্বত্র এইসব হচ্ছে। বিদেশে ম্যানিব্যাগ, বিশেষ করে পাসপোর্ট চুরি হয়ে গেলে তো ভীষণ মুশকিল। আমরা তাই পকেটে পঞ্চাশ ইউরো রেখে বাদ বাকি টাকা পয়সা, পাসপোর্ট ব্যাগের ভিতর ঢুকিয়ে দিলাম।

ইউট্রেকটের রাস্তার পাশে ওল্ড উইন্ডমিল।

প্যারিস থেকে লোকাল ট্রেনে গার্ডেনর স্টেশনে পৌঁছলাম। সে এক বিশাল জায়গা। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দেওয়া হবে মাত্র পনেরো মিনিট আগে। সেখান থেকে সঠিক প্ল্যটফর্ম চিনে ঠিক ট্রেনের নির্দিষ্ট কামরা খুঁজে ওঠা কঠিন কাজ। হাওড়া স্টেশনে কুলি বা যে কাউকে বললে আপনাকে বলে দেবে কোন প্ল্যাটফর্মে যেতে হবে। এখানে তার উপায় নেই। যাই হোক, সঠিক আসনে বসে দাদাকে মেসেজ পাঠালাম ঠিক ঠাক উঠে গিয়েছি। দাদা ওদিক থেকে লিখল ব্রাভো। খুব সুন্দর ট্রেন। জানলা দিয়ে দেখা যায় সুন্দর দৃশ্য। বাইরে সবুজ ঘাস ভরা মাঠ। মাঝে মাঝে উইন্ডমিলের সাদা পাখা দেখা যাচ্ছে। ট্রেনে চেকার আছে। তারা আমাদের টিকিটটা স্ক্যান করে নিল এয়ার লাইন্সের মতো। ট্রেনের ভিতর স্ন্যাকস শপ আছে। একটু কফি বা স্যান্ডউইচ কিনে নিয়ে আনছেন অনেকেই। আমরা জানলার বাইরের দৃশ্য দেখতেই ব্যস্ত ছিলাম।
রটারডামে ট্রেন পালটাতে হবে। কিন্তু ট্রেন তো ১৫ মিনিট দেরিতে চলছে। ভেবে একদিকে ভালোই লাগলো এদেশেও ট্রেন লেট হয়। ফ্রান্স মানেই যে ঘড়ির কাঁটায় ট্রেন চলবে তা নয়। ওদিক থেকে দাদা মেসেজ পাঠাচ্ছে ট্রেন লেট, ইউ হ্যাভ টু হারি আপ। না হারি আপ করতে হল না। আগের ট্রেনটা বাতিল হয়ে গিয়েছে। আধ ঘণ্টার মধ্যে আর একটা ট্রেন পেয়ে গেলাম ইউট্রেকট যাওয়ার। রাখে কৃষ্ণ মারে কে! ইউট্রেকটের সেন্ট্রাল স্টেশনে যখন পৌঁছলাম তখন বেলা সাড়ে চারটা। আয়োজকরা বলেছিল স্টেশন থেকে আমাদের হোটেলটা নাকি পায়ে হাঁটা পথ। সত্যিই তাই। ওই তো সামনে মল দেখা যাচ্ছে। মলের ভিতরে আমাদের হোটেল হ্যাম্পটন বাই হিল্টন। মলের ভিতরে যে হোটেল হতে পারে তা এই প্রথম দেখলাম।
আরও পড়ুন:

শম্ভু, শম্ভু, শিব মহাদেব শম্ভু, খুদার ইবাদত যাঁর গলায় তাঁর আর কাকে ভয়?

ইংলিশ টিংলিশ: One word expressions কী? জেনে নিন একঝলকে

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব -২০: গিরিশচন্দ্রের অন্যতম সেরা সামাজিক নাটক ‘হারানিধি’

ডাক্তারের ডায়েরি, পর্ব-৩২: গুনী সান্নিধ্য: বিমল কর, নিমাই ভট্টাচার্য ও দিব্যেন্দু পালিত

এখানকার হোটেলে একটা রুমে শুধু দু’জন থাকতে পারবে। না অতিরিক্ত বেড লাগিয়ে যে আমরা তিনজন থাকবো তা হবে না। তাই আমাদের তিনজনের জন্য দুটো রুম নিতে হল। তবে লাগোয়া রুম পাওয়া গেল। একটু থিতু হয়েই ফোন করলাম আমার সায়েন্স কলেজের বন্ধু তানিয়ার মেয়ে মমমমকে। ওই রকমই নাম ওর। ওর ভালো নাম আইরিন। ওর সেদিনই আবার দাঁত তোলা হয়েছে। কথাই বলতে পারছে না। কিন্তু ওর স্বামী রত্নদীপ এল ঘরে দেখা করতে। বঙ্কিমচন্দ্রের দাদা সঞ্জীবচন্দ্র এক জায়গায় লিখেছিলেন, “বিদেশে বাঙালি মাত্রই সজ্জন”। তাই-ই হল। রত্নদীপ আমাদের ইউট্রেকট সম্পর্কে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে গেল। বলে দিল কী কী দেখার জায়গা আছে নেদারল্যান্ডসে। কোথা থেকে ট্যাক্সি ধরতে হবে মিটিংয়ে যাবার জন্য।

আমস্টারডাম রেলওয়ে স্টেশন ।

আয়োজকরা লিখেছিল হ্যাম্পটন বাই হিল্টন থেকে মিটিংয়ের সেন্টার নাকি পায়ে হাঁটা পথ। ম্যাপও পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমার একটু হারিয়ে যাবার অভ্যাস আছে। মনে আছে, একবার রাইটার্স বিল্ডিংয়ের নীচে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ”দাদা রাইটার্স বিল্ডিংটা কোথায়?” আসলে আমার জিজ্ঞাসা করার খুব অভ্যাস। রত্নদীপ দেখিয়ে দিল, কোথা থেকে ট্যাক্সি ধরতে হবে। আইআইটি খড়গপুর থেকে পাশ করে রত্নদীপ ইংল্যান্ডে পিএইচডি করেছে। পর্তুগালে পোস্টডক করে এখন ইউট্রেকটে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের উপর গবেষণা করছে। আর আইরিন ক্যানসার নিয়ে গবেষণা করছে ইউট্রেকট বিশ্ববিদ্যালয়ে। আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহর ইউট্রেকট। ইউট্রেকটে দেখার মতো আছে বিখ্যাত ডোম আর ক্যানাল। ডোম সত্যিই দেখার মতো। ১১২ মিটার লম্বা। ৭০০ বছরের পুরোনো। তবে ডোমের থেকেও ভালো লাগবে ক্যানাল। পুরো শহরটা জুড়ে আছে ক্যানাল, ছ’ কিলোমিটার মতো হবে। ইউরোপের সব থেকে সুন্দর ক্যানাল শহর ইউট্রেকট। ক্যানালের দুই ধারে খুব সুন্দর সুন্দর খাবারের দোকান। ইউট্রেকটে এলে অবশ্যই ক্রুজ নেবেন। শহরের অনেকটাই দেখা হয়ে যাবে। সন্ধেবেলা বেরোলাম ডিনারের জন্য। ভাগ্যিস তাড়াতাড়ি বেরিছিলাম। এখানে রাত আটটার পর কিচেন বন্ধ হয়ে যায় বেশিরর ভাগ রেস্টুরেন্টের। একটা ইউরোপিয়ান রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। পাশে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট দেখলাম। নাম নমস্কার। নেদারল্যান্ডসের এই ছোট্ট শহরে ভারতীয় খাবারের দোকান খুলেছে কেউ এটা দেখে একটু অবাক হলাম।

গ্র্যান্ড প্যালেস ব্রাসেলস।

পরদিন সকাল ন’টার সময় মিটিং। প্রথমে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। তাই সকাল আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। বেশি দূর নয়। হেঁটেও আসতে পারতাম। কনফারেন্স কিটে কোনও ব্যাগ ছিলও না। শুধু একটা প্রোগ্রাম বুক। একদিক থেকে ভালোই। বছরে কনফারেন্স থেকে দশটা ব্যাগ হয়ে যায়। আজকাল ড্রাইভার কিংবা ল্যাব টেকনিশিয়ানরাও নেয় না। প্রায় আড়াইশো চিকিৎসক এসেছেন এই মিটিংয়ে। সু ফেন চেক এসেছেন সিঙ্গাপুর থেকে, তেমনি ড্যানিয়েল এসেছেন ব্রাজিল থেকে, জানেট ডেভিস আমেরিকা থেকে। ভারত থেকে আমরা পাঁচ জন। লাঞ্চ, ব্রেকফাস্ট, সবই স্যান্ডউইচ বা বার্গার। বেশির ভাগের ভিতরে বিফ। আমার বিফে আপত্তি আছে। আমার মা গরুকে সকালে উঠে নমস্কার করতেন। জানি ‘ইউরোপীয় কাউ নট নেসেসারিলি হলি কাউ’, তবু আমি বিফ কখনও খাই না।
আরও পড়ুন:

পর্ব-৩২: দেশে প্রথম গবেষণা সংস্থার কারিগরি সহায়তায় বেড়ে ওঠা সেরা প্রাপ্তি ‘জয়ন্তী রুই’ মাছ

ডিমেনশিয়া ও অ্যালঝাইমার্সের ঝুঁকির মধ্যে আপনি নেই তো? সতর্ক হতে হবে গোড়াতেই/ পর্ব: ১

নাট্যকথা: রোদ্দুর ও অমলকান্তি/২

বাইরে দূরে: দ্রোণস্থলীর দেবতা টপকেশ্বর মহাদেব

মিটিংয়ের দ্বিতীয় দিন গালা ডিনার। শেষ দিন মিটিংয়ের পর ক্রুজ। শুভ্রা আর সুমেধাকেও নিয়ে যাব ঠিক করেছি। ২৬০ ইউরো লাগবে। এসবিআই-এর ক্রেডিট কার্ড ডিক্লাইন্ড হল। বললো যদি ‘একজ্যাক্ট অ্যামাউন্ট’ দিতে পার, তবেই নিতে পারি। ভাগ্যিস সেটা ছিল তাই টিকিট কাটতে পারলাম। আমার পেপারটা বেশ ভালো হল। বিষয় ছিল ইউভিয়াইটিসের একটা নতুন রকমের চিকিৎসা, ওরাল স্টেরয়েডের বদলে ইন্ট্রাঅকুলার স্টেরয়ড, যা একবার দেওয়ার পর ৩৬ মাস কাজ করবে। এর উপর গ্লোবাল স্টাডি আছে। কিন্তু ‘ইন্ডিয়ান স্টাডি’ এই প্রথম। কিছু প্রশ্ন করলেন কয়েকজন। ঠিক মতো উত্তরও দিতে পারলাম। আমার কনফেরেন্স থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ছটা হয়ে গেল। বউ আর মেয়ে গিয়েছে আমস্টারডাম দেখতে। সবাই ক্লান্ত। তাই ঘরেই খাবার আনবো ঠিক করলাম। কিন্তু যেখানেই যাই, ‘নো ক্যাশ’, অথচ ক্রেডিট কার্ডও ‘অ্যাক্সেপ্টেড’ হচ্ছে না। কোনওক্রমে একটা থাই খাবারের দোকানে ক্যাশ টাকা দিয়ে খাবার পেলাম। এরকম পয়সা থাকতেও খাবার কিনতে পারবো না এই প্রথম অভিজ্ঞতা হল।

পরদিন সন্ধ্যাবেলা বিজনেস মিটিং। সেখানে চিকিৎসক ডিরুট আয়োজক কমিটির চেয়ারম্যান ইউট্রেকটের অফথ্যালমোলজির ঐতিহাসিক অবদানের কথা বললেন। এখানকার অফথ্যালমোলজিস্ট চিকিৎসক ডন্ডারস অফথ্যালমোস্কোপ ও ভিসুয়াল ফিল্ড দেখার যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। তার ছাত্র চিকিৎসকর স্নেলেন আবিষ্কার করেছিলেন স্নেলেন চার্ট, যা আজও ব্যবহার করা হয় ‘ভিশন টেস্ট’ করতে। স্নেলেনের হাসপাতালটাকে মিউজিয়াম করা হয়নি। ওটা এখন একটা বুটিক হোটেল। নাম ‘আই হোটেল’। পরে ওয়াকিং ট্যুরে ডন্ডারসের স্ট্যাচু আর স্নেলেনের হটেলটা দেখেছিলাম।
ছবি: লেখক

ডাঃ জ্যোতির্ময় বিশ্বাস সাহিত্যের জগতে পদচারণা করেন ডাকনামে। ‘সবুজ বিশ্বাস’ নামে তিনি একাধিক সাহিত্যকেন্দ্রিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। বাচিক শিল্পেও তাঁর প্রবল আগ্রহ। এই মুহূর্তে বাচিকশিল্পে আমাদের রাজ্যে যাঁরা স্বনামধন্য, তাঁরা অধিকাংশই ডাঃ বিশ্বাসের বন্ধুস্থানীয়। ছাত্রজীবনে, এই শহরে এমবিবিএস পাঠকালে একসঙ্গে এ-মঞ্চে, সে-মঞ্চে কবিতা আবৃত্তি করেছেন। পরে পেশাগত কারণে বিদেশযাত্রা ও গবেষণাকর্মের শেষে শংকর নেত্রালয়ে যোগদানের ফলে সেই বাচিকশিল্পের সঙ্গে সেই যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে উঠেছে। চেন্নাই শহরের বাঙালিসমাজের যে কোনো অনুষ্ঠানে অবশ্য এখনো তিনি আবৃত্তি পরিবেশন করেন। ডাঃ বিশ্বাস চক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বনামধন্য। ভারতের প্রথম শ্রেণির একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ। তিনি চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ের অন্যতম ডিরেক্টর।

Skip to content