বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


রাতে পূর্ণার্থীদের ভিড়।

সম্প্রতি কলকাতায় বেড়াতে গিয়ে একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলাম। বাংলাদেশে দুর্গাপুজো হয়? হলেও সবাই কি প্রাণ খুলে আনন্দ উৎসবে সামিল হতে পারেন? দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে হয়েছে, ধর্মীয় অন্য সব অনুষ্ঠানের মতো বাংলাদেশে দুর্গাপুজোও সাড়ম্ভরে হয়ে থাকে। কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের পুজোতে উদ্দীপনা-উদ্মাদনা প্রবল। বাংলাদেশে ধর্মীয় আধ্যাত্মিক আরাধনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু শাস্ত্রীয় কাঠিন্য শারদোৎসবের কোনও অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় না। কলকাতার মতো এখানেও শারদীয়া দুর্গাপুজো যতটা না পবিত্র পুজো, তার চেয়ে অনেক বেশি উৎসব পার্বণের রূপ নিয়েছে।

নন্দনকানন রথের পুকুর পাড়ের মন্ডপ।

এখানে পুজোয় বিভিন্ন প্রকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও অংশগ্রহণ করে থাকেন। উদ্মাদনা যে একেবারেই নেই, তা নয়। কিন্তু প্রতিমা ভাঙার ভয় বরাবরের মতো থাকার কারণে উন্মাদনা পরিহারের জন্য বাংলাদেশ পুজো উদযাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দ সবাইকে অনুরোধ করেছেন। এবার পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশে ৩২,১১৮টি মন্ডপে দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত বছরের চেয়ে মন্ডপ বেড়েছে (সূত্র: প্রথম আলো)। দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলার সদরে সাড়ম্ভরে পুজো হয়। তার মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালি এবং ময়মনসিংহে সবচেয়ে বেশি পুজো হয়।
গত বছর কুমিল্লার একটি পুজা মন্ডপে গোপনে অন্য সম্প্রদায়ের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ রেখে সারা দেশে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছিল। হামলায় কয়েকজন পুজারী নিহত হয়েছিলেন। আহতের সংখ্যা ছিল অনেক। এর জন্য সরকার এবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছিল। তাই গত বছরের চেয়ে এবার সবাই নিশ্চিন্তে আনন্দ উৎসবে সামিল হতে পেরেছেন। কোনও প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সবচেয়ে বড় আয়োজন হয় ঢাকার ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির ও চট্টগ্রামের জেএমসেন হল-এ। এখানে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ের উচ্চপদস্থ মন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা ও সরকারি কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকেন। বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। থাকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে বস্ত্র ও উপহার সামগ্রী বিতরণ। রামকৃষ্ণ মিশন-সহ বিভিন্ন মন্ডপে কুমারীপুজো উৎসাহ উদ্দীপনার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও নানাবিধ কারণে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। তৎসত্ত্বেও এই দুর্গাপুজোতে তার কোনও প্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি। আয়োজন ও আড়ম্ভর গত বছরের তুলনায় কম নয়। নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে সরকার প্রতিটি মন্ডপে আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা বৃদ্ধি করেছে।
আরও পড়ুন:

বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে, পর্ব-১: ঢাকার জগদ্বিখ্যাত শ্রীশ্রীঢাকেশ্বরী মন্দির

ছোটদের যত্নে: কোন সময় গর্ভধারণ করলে সুসন্তান লাভ সম্ভব? নব দম্পতির মা হওয়ার আগের প্রস্তুতির পরামর্শে ডাক্তারবাবু

বরণীয় মানুষের স্মরণীয় সঙ্গ, পর্ব-৩: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী যামিনী রায় / ১

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪: কবে আসবে তুমি মননের সে ‘সহযাত্রী’? [০৯/০৩/১৯৫১]

বাইরে দূরে: অস্ট্রিয়ার ক্রিস্টাল দুনিয়া— সোয়ার্ভস্কি

বাংলাদেশের বাণিজ্যিক নগরী ও দেশের অর্থনৈতিক স্বর্ণধার চট্টগ্রামে দুর্গাপুজোর উদ্মাদনা একটু বেশি। এর পেছনে একটি পৌরাণিক ইতিহাস রয়েছে। স্বচ্ছলতা ও পৌরাণিক ধর্মীয় অনুভূতির একটি মিথস্ক্রিয়া এখানে আছে। রামায়ণে বর্ণিত মতে, শ্রীরামচন্দ্র সীতা উদ্ধারের জন্য শরৎকালে দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন। যাকে অকাল বোধন বলা হয়ে থাকে। তবে তারও অনেক আগে সত্যযুগে দুর্গাপুজোর সূচনা হয় এই চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের বোয়ালখালি উপজেলার করলডেঙ্গা পাহাড়ে মেধসমুণির আশ্রমে প্রথম দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। শ্রীশ্রী চণ্ডী ও বিভিন্ন পুরাণের বর্ণনা আনুসারে, ধার্মিক রাজা সুরথ শত্রুদের চক্রান্তে রাজ্য হারিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো উপস্থিত হন মেধসমুণির আশ্রমে। সেখানে মুনীবর রাজার দুর্দশার কথা শুনে ও দেখে তাকে হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য দুর্গাপুজো করার উপদেশ দেন। মুণির উপদেশ মেনে রাজা সুরথ এই আশ্রমে দুর্গাপুজো করেন বসন্তকালের চৈত্রমাসে। সে পুজোকে এখন বাসন্তী পুজো নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। দেবী দুর্গার আর্শীবাদে তিনি শত্রুদের পরাস্থ করে তার রাজ্য উদ্ধারে সক্ষম হন। সেই থেকে এখানে দুর্গাপুজো হচ্ছে।

নাজিরপাড়ার পুজোর মন্ডপ।

পাহাড় বেষ্টিত এই স্থানের প্রাকৃতিক নিসর্গ খুব সুন্দর। আশ্রমে চণ্ডীমন্দির, শিবমন্দির, তারাকালী মন্দির-সহ বিভিন্ন প্রকারের ১০টি মন্দির রয়েছে। বছর জুড়ে মনস্কামনা পূরণের উদ্দেশ্যে দেশ বিদেশের পুণ্যার্থীরা ছুটে আসেন এই আশ্রমে, আসে পর্যটকেরাও। মার্কন্ডেয় পুরান মতে, রাজা সুরথ একজন প্রবাদ প্রতিম ব্যক্তি ছিলেন। তিনি দেবী দুর্গার পরমভক্ত। পৃথিবীতে শ্রীশ্রী চণ্ডীর প্রচার করেছিলেন। তিনি তাঁর রাজ্য হারিয়ে রাজধানী বলিপুর ত্যাগ করে বাংলার এই দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে আত্মগোপন করেছিলেন। সেখানে বনের মধ্যে সামাধিবৈশ্য নামে একজন বণিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সামাধিবৈশ্যও ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনিও প্রতারণার ফলে ব্যবসা হারিয়ে দেউলিয়া হন। তারা ঘন বন-জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে এই করলডেঙ্গা পাহাড়ের মেধসমুণির আশ্রমে উপস্থিত হন। এখানে তারা দুর্গাপুজো করেন।

চট্টগ্রামের যাত্রা মোহন সেন হল প্রঙ্গণের দেবী মূর্তি।

পৌরাণিক কাহিনীর স্মৃতি অনু-স্মৃতি নিয়ে করলডেঙ্গা পাহাড়ের এই আশ্রম এখন পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় তীর্থে। প্রায় ৭০ একর পাহাড়ী বনভূমি জুড়ে প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরে প্রতিবছর মহালয়ার মধ্য দিয়ে দেবীপক্ষের সূচনা হয়। ভোর থেকে চণ্ডী আরাধনার মাধ্যমে দুর্গাকে মর্ত্যে আহ্বান জানাতে প্রতিবছরের মতো এবারও শত শত পুণ্যার্থীর পদচারণে এই আশ্রম মুখরিত হয়েছে। এসব বিভিন্ন কারণে চট্টগ্রামের দুর্গাপুজোর ধর্মীয় আধ্যাত্মিক দিক যেমন রয়েছে তেমনই উৎসবের উদ্মাদনাও একটু বেশি।
আরও পড়ুন:

ত্বকের পরিচর্যায়: ত্বক শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে? যত্নে কী কী করবেন? জেনে নিন ত্বক বিশেষজ্ঞের জরুরি পরামর্শ

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৯: রাজ্যাভিষেকের অপেক্ষায় অধীর অযোধ্যাবাসী

গৃহিণীদের মধ্যে বইয়ের নেশা বাড়াতে কাঁধে ঝোলা নিয়ে ঘুরে বেড়ান রাধা, ‘চলমান পাঠাগার’ তাঁর পরিচয়!

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৭: পুষ্কররাজাকে পরাস্ত করে রাজ্য ফিরে পেলেন নলরাজা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৭: রান্নাবান্নার ঠাকুরবাড়ি

ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব-৩৮: বসুন্ধরা এবং…

শ্রীরামচন্দ্র দুর্গাপুজো শরৎকালে অকালবোধন করে দেবীর আরাধনায় তার কৃপা লাভ করেন এবং রাবণ বধে সফল হন। রাজা সুরথ বসন্তকালে বাসন্তী পুজো করে হারানো রাজ্য উদ্ধার করেন। সামাধিবৈশ্যও তার আর্থিক সচ্ছলতা ফিরে পান। কিন্তু বর্তমানে সনাতনী সম্প্রদায়ের দুর্গতিনাশের জন্য দুর্গাপুজো করে কতটুকু সাফল্য লাভ হয়েছে? তা ভাবতে হবে। এত উদ্মাদনা, এত অহেতুক খরচ অপচয় করেও বাংলাদেশে সনাতনীদের দূর্গতি দিন দিন বেড়েছে। তা কি শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে ত্রুটির কারণে? না কি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভুলে কিংবা অর্থনৈতিক বা ব্যবসায়িক বুদ্ধির ভুলে, তার সুচিন্তিত বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন।

রাতের জে এম সেন হল।

শুধু আড়ম্ভর ও দেখানদারিই প্রাধান্য পাচ্ছে। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের বা দূর্গতি থেকে মুক্তির কোনও বাস্তব প্রয়াস নেই। খরচের আধিক্য কমিয়ে তা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্গতি হ্রাসে ব্যয় করা হলে মনে হয় দেবী দুর্গা সন্তুষ্ট হতেন। কিন্তু এখানে শুধু নেতৃত্ব বৃদ্ধি ও সরকারের সঙ্গে ক্ষমতার সংযোগ সৃষ্টির প্রয়াস চোখে পড়ে। বৃহত্তর সনাতনী সমাজের অগ্রগতির জন্য কোনও সুনির্দিষ্ট রূপরেখা না থাকায় আমরা দেবী দুর্গার প্রকৃত আর্শীবাদ থেকে বঞ্চিত হই। মা দুর্গার পরম শক্তির প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল বটে, কিন্তু আমাদের চরিত্রে সেই শক্তির কোনও রূপায়ন আমরা ঘটাতে পারিনি। তাই অনেকেই মনে করেন, ধর্মনিষ্ঠা, আন্তরিক শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক ব্যর্থতা, অশিক্ষা, কুসংস্কার, গোঁড়ামী এবং সাম্প্রদায়িক বৈষম্য ইত্যাদির কারণে বাংলাদেশের হিন্দুদের দুর্গতি বিনাশ না হয়ে দিন দিন দুর্দশা বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশের হিন্দুরা সব দুঃখ দুর্দশা ভুলে বছরে একবারই একসঙ্গে জেগে ওঠেন এই শারদীয় দুর্গোৎসবে। এই শারদোৎসবের আনন্দধারায় সবার জীবনের দুর্দশা মোচন হোক এটাই ছিল এবারের পুজার মূল প্রার্থনা।

ছবি: লেখক
* সোনার বাংলার চিঠি (Letter from Sonar Bangla, Sonar Banglar Chithi, Bangladesh) : অরুণ শীল (Arun Shil) কবি ও সাহিত্যিক। তিনি প্রধানত শিশু-কিশোর সাহিত্যের লেখক। শুরুতে গণমুখী ছড়া লিখে তুখোড় ছড়াকার হিসেবে পরিচিতি পেলেও মায়াবী, কোমল এবং স্বপ্নময় কিশোর কবিতা লিখে খ্যাতিমান হয়েছেন। ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ নিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর ২২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধ, ফিচার লিখেও তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। পেয়েছেন বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সম্মাননা ও পুরস্কার।

Skip to content