দীনবন্ধু মিত্র, গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও শেক্সপিয়ার।
কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের গল্প নিয়ে নটগুরু গিরিশচন্দ্র সামাজিক নাটকগুলো লিখেছিলেন। সাধারণত এই সমস্ত ঘরে নিরুপদ্রব এবং গতানুগতিক জীবনধারায় মধ্যে নাটকে উপাদান খুব বেশি একটা ছিল না। সেইজন্য গিরিশচন্দ্র সাধারণ এবং সামাজিক জীবনের যত রকম ব্যাঘাত ও বিকৃতি করতে পারে সবই তিনি তাঁর সামাজিক নাটকগুলোর মধ্যে স্থান করে দিয়েছেন। এই কারণেই তাঁর সামাজিক নাটকে জাল, জুয়া-চুরি, প্রতারণা, হত্যা প্রভৃতির একটু বাড়াবাড়ি রয়েছে। বাঙালি ঘরের বধূ সহনশীল এবং পতিপরায়ণা সেই জন্য পবিত্র দাম্পত্য জীবনের পাশে সর্বত্র পতিতা জীবনের কদর্যতা দেখিয়ে তিনি ঘটনার বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছেন।
‘প্রফুল্ল’ নাটক থেকে আরম্ভ করে গিরিশচন্দ্র যতগুলো সামাজিক নাটক লিখেছেন তার প্রায় সবগুলোই বিয়োগান্ত করুণরসাত্মক। এর কারণটা কী? কেন তিনি জীবনের করুণ দিকগুলি নাটকের মধ্যে প্রধান করে তুলেছেন? এর কতগুলি কারণ নির্দেশ করা যেতে পারে— প্রথমত, গিরিশচন্দ্রের অন্তর প্রেরণা দুঃখের নিত্য প্রবাহে অভিষিক্ত হয়েছিল, সেই প্রেরণা যখন সাহিত্যের কাহিনীকে আশ্রয় করেছে তখন স্বভাবতই কারুণ্যের কলতানে ভরে উঠেছে।
স্টার থিয়েটার।
তাছাড়া গিরিশচন্দ্র প্রায়ই বলতেন যে, তিনি উইলিয়াম শেক্সপিয়ারকে আদর্শ করেই তাঁর নাটক রচনা করতেন। শেক্সপিয়ারের ট্রাজেডি যে তাঁকে দুঃখময় নাটক লেখাতে অনুপ্রাণিত করেছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাছাড়া গিরিশচন্দ্র বুঝেছিলেন মিলনান্তক নাটক অপেক্ষা করুণরসাত্মক নাটক সামাজিক নাটকের ক্ষেত্রে বেশি কার্যকরী। করুন রস আশ্রিত নাটক দর্শকদের কাছে অধিকতর হৃদয়গ্রাহী ও শিক্ষাপ্রদ। পাশাপশি গিরিশচন্দ্রের সামাজিক নাটকগুলোর প্রত্যক্ষ প্রেরণা যুগিয়েছিল দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি। দীনবন্ধু মিত্রকে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তাছাড়া ‘সরলা’ নাটক থেকেও তিনি অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:
নাট্যকথা: রোদ্দুর ও অমলকান্তি/১
হোমিওপ্যাথি: হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে চান? তাহলে এগুলি অবশ্যই মেনে চলুন
শারদীয়ার গল্প-১: প্ল্যানচেট রহস্য
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৮: দশরথের অভিলাষ-রামের রাজ্যাভিষেক সংকল্প
এই ভাবেই গড়ে উঠেছে তাঁর ‘হারানিধি’ নাটকটি। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯০ সালে। ‘হারানিধি’ নাটকের বিষয় বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা থেকে গড়ে উঠেছে। মোহিনী নরপিশাচ পাষণ্ড হলেও সে কিন্তু ‘প্রফুল্ল’ নাটকের প্রফুল্লের স্বামী রমেশের মত স্নেহলেশহীন পাষণ্ড মানুষ নয়। তার একমাত্র স্নেহের পাত্রী ছিল তার কন্যা হেমাঙ্গিনী।
কন্যার অসুখেই তার মতিগতি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। নাটকের ঘটনা ঘুরে গিয়ে মিলনান্ত পরিণতি লাভ করেছিল। হেমাঙ্গিনী মস্তিষ্ক বিকৃতি দু’পক্ষের মিলন ঘটাল বটে কিন্তু তার এই মস্তিষ্ক বিকৃতির তেমন কিন্তু কোনও জোরালো কারণ নাট্যকার এই নাটকে দেখাননি। হেমাঙ্গিনী তার সখী সুশীলার সঙ্গে বেশ রসের কথাবার্তা বলে। আর অন্য সময় সেই হেমাঙ্গিনী ছেলেমানুষের মতো সরল অনভিজ্ঞ। তার চরিত্রের এই বৈপরীত্যের দিক খুব সুন্দরভাবেই চোখে পড়ে।
কন্যার অসুখেই তার মতিগতি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। নাটকের ঘটনা ঘুরে গিয়ে মিলনান্ত পরিণতি লাভ করেছিল। হেমাঙ্গিনী মস্তিষ্ক বিকৃতি দু’পক্ষের মিলন ঘটাল বটে কিন্তু তার এই মস্তিষ্ক বিকৃতির তেমন কিন্তু কোনও জোরালো কারণ নাট্যকার এই নাটকে দেখাননি। হেমাঙ্গিনী তার সখী সুশীলার সঙ্গে বেশ রসের কথাবার্তা বলে। আর অন্য সময় সেই হেমাঙ্গিনী ছেলেমানুষের মতো সরল অনভিজ্ঞ। তার চরিত্রের এই বৈপরীত্যের দিক খুব সুন্দরভাবেই চোখে পড়ে।
মিনার্ভা থিয়েটার।
হারানিধি নাটকের ক্রিয়া এবং ঘটনা একতরফা নয়। মোহিনী শক্তিশালী দুর্বৃত্ত হলেও তার প্রতিপক্ষ বেশ প্রবল। নবকুমার, অঘোর এবং কাদম্বিনী মোহিনীকে পাল্টা জব্দ করার চেষ্টা করেছে। এতে একঘেয়ে করুণ রসের অত্যাচার থেকে দর্শকরা মুক্ত হয়েছেন। অঘোরের চমকপ্রদ ক্রিয়া-কলাপ এবং সরস কথাবার্তা সমস্ত নাটকটিকে উজ্জ্বল করে রেখেছে। তাঁর মতো এমন হাস্যরসাত্মক চরিত্র গিরিশচন্দ্র খুব কম সৃষ্টি করতে পেরেছেন ।নাটকের সর্বপেক্ষা কৃত্রিম আরষ্ঠ চরিত্রের নাম নীলমাধব। “নীলদর্পণ “নাটকের নবীনমাধবের মত এই নীলমাধব হিতোপদেশ আওড়ায়।এই নাটকটি গিরিশচন্দ্র ঘোষ ‘স্টার থিয়েটার’ এবং ‘মিনার্ভা থিয়েটারে’ অভিনয় করেছিলেন এবং একসময় এই ‘হারানিধি’ নাটক অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল সামাজিক নাটক হিসেবে।