শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


পুরোহিতের ভূমিকায় যখন আমি।

ডাক্তারবাবুদের আবার পুজো! এই সমাজে এমন কিছু পেশা আছে যেখানে জরুরি ভিত্তিক কাজটাই আগে প্রাধান্য পায়, আনন্দ-বিনোদন নয়। যেমন পুলিশ, দমকল কর্মী, সাফাই কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, বিদ্যুৎ কর্মী, পরিবহনকর্মী, সংবাদ মাধ্যম কর্মী ইত্যাদি। এরা সবাই প্রায় সরকারি কর্মী। ডাক্তারবাবুরা সরকারি এবং বেসরকারি, দু’রকমই হয়ে থাকেন। সংবাদ মাধ্যম কর্মীরা অবশ্য অধিকাংশই বেসরকারি। এরা সবাই মিলে জান প্রাণ লড়িয়ে পরিষেবা দেন বলেই লক্ষ লক্ষ লোক পুজোর আনন্দে শামিল হতে পারেন। এদের কাছে তাই পুজো বলে আলাদা করে আনন্দের কিছু হয় না। কেউ কেউ পুজোর মধ্যে একদিন হয়তো ছুটি পান, কেউ তাও পান না।

জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় সফল হয়ে যখন ডাক্তারিতে ঢুকলাম, কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে গেলাম, পুজোর দিনগুলো অন্যদের থেকে আমাদের আলাদা। ইয়ারলি পরীক্ষাগুলো প্রায় প্রতি বছরই পুজোর পর হতো। মনে আছে আমার স্কুল জীবনের বন্ধু রজত গোস্বামী (পরবর্তীকালে বিখ্যাত মেডিসিনের ডাক্তার), আর আমি ফার্স্ট ইয়ার থেকেই অধিকাংশ দিন একসঙ্গে পড়াশোনা করতাম। আমাদের বাড়ি ছিল একই পাড়ায়, যদিও কলেজ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা, রজতের নীলরতন আর আমার আর জি কর। ডাক্তারিতে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়। এককভাবে সবকিছু পড়ে ফেলা এবং বুঝে ফেলা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। তাই অনেকেই দুজনে বা তিনজনে মিলে একসঙ্গে পড়াশোনা করে। এর ফলে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে পড়াটা তাড়াতাড়ি মাথায় ঢোকে। পরে সেগুলো আরেকবার নিজে নিজে পড়ে নিলেই মুখস্ত হয়ে যায়। এ ছাড়া একাকীত্ব এবং হতাশা গ্রাস করতে পারে না। আমি ডাক্তারি পড়েছি বাড়ি থেকে যাতায়াত করেই। যারা হোস্টেলে থাকে তারাও পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয় যৌথভাবেই।

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর অধিকাংশ দিন আমার বাড়ির চিলেকোঠাতে দুজনে মিলে পড়াশোনা শুরু করতাম। যখন সন্ধ্যা নামতো, ঢাকের আওয়াজ এবং আরতির কোরাস কানে এসে পৌঁছতো, তখন ছাদে গিয়ে দাঁড়াতাম, কিছুক্ষণ পায়চারি করে আবার এসে পড়াশোনা শুরু করতাম। এ ভাবে প্রায় রাত এগারোটা অব্দি ম্যারাথন পড়াশোনা চলতো। তারপর আমি রজতকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসে, বাড়ি ফিরে ডিনার করে আবার পড়তে বসতাম। পুজোর মধ্যে একটা দিন সন্ধেবেলা দুজনে মিলে স্থানীয় কিছু ঠাকুর দেখতাম। পুজোর সময় এত লোকের এত রকম আনন্দ দেখে নিজেরা মাঝে মাঝে বড় বিমর্ষ হয়ে পড়তাম। ভাবতাম, আমাদের এই ছাত্র জীবন শেষ হবে কবে! আমরা যখন সত্যিই ডাক্তার হব, তখন নিশ্চয়ই পুজোর সময় চুটিয়ে আনন্দ করতে পারব!

আমার ঠাকুরমা (কর্তামা)।

একসময় সত্যিই আমরা ডাক্তারি পাশ করলাম। শুরু হল ইন্টার্নশিপ, পরবর্তীকালে হাউসটাপশিপ। তখনও কিন্তু, একদিনের বেশি পুজোয় ছুটি মিলতো না। রোটেশন ডিউটি করতে হতো। হাসপাতালে তো কোনওদিনই রোগীর কামাই থাকে না। পুজোর সময় বরং সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি বাড়ে। পাড়ার ডাক্তারবাবুরা, যাদের আমরা জেনারেল ফিজিশিয়ান বলি, সারা বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফাঁকে পুজোর এই কটা দিন তাদের অধিকাংশই চেম্বারের ঝাঁপ বন্ধ করে বাইরে কোথাও বেড়াতে যেতেন। এখনও যান। তবে এখন প্রতিটি এলাকায় পৌর হাসপাতাল এবং বহু জায়গায় মাঝারি মাপের বেসরকারি হাসপাতাল থাকায়, ডাক্তারের ক্রাইসিস অনেকটাই কমে গিয়েছে। কিন্তু একটা সময় পুরো এলাকাটাই নির্ভরশীল থাকত জেনারেল ফিজিশিয়ানদের উপরেই। পুজোর সময় মদ খেয়ে মারামারির কেস, আগুনে পোড়া কেস, অ্যাক্সিডেন্টের রোগী বেশি আসতো। এখন আগুনে পোড়া কেস অনেক কম আসে, কারণ বাজি পটকা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। পুজোর সময় ডাক্তারদের সংখ্যা কম থাকায়, যারা ডিউটি করত তাদের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়তো। ইমারজেন্সিতে প্রায় সারা রাতই জাগতে হতো।

ইএনটি বিভাগের ইমারজেন্সিটা আবার একটু অন্যরকম। প্রথমে জেনারেল ইমারজেন্সিতে সব ধরনের রোগীই আসে। সেখান থেকে স্ক্রিনিং হয়। যদি সিরিয়াস রোগী হয়, তাহলে সেই বিভাগীয় হাউসস্টাফ বা ইনচার্জকে ডেকে পাঠানো হয়। তারা দেখে ভর্তি করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। নাক কান গলার রোগীদের সাধারণত ভর্তি করতে হয় না। তাই তাদের সেই বিভাগে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নাকে-কানে কোনও কিছু ঢুকিয়ে ফেলা রোগীরা আসেন, গলায় কাঁটা আটকে আসেন, আবার নাক দিয়ে প্রবল রক্তপাত হচ্ছে— এমন রোগীরাও আসেন। জেনারেল এমার্জেন্সি থেকে ইএনটি ইমারজেন্সিতে এদের পাঠিয়ে দিলে, আমরা তাদের বিপদমুক্ত করি। সেবার পুজোয় আমার একদিন ইমারজেন্সি ডিউটি ছিল। সপ্তমীর মধ্যরাতে জরুরি তলব পেয়ে কোয়ার্টার ছেড়ে বিভাগে গিয়ে দেখি, বছর তিনেকের একটি বাচ্চার নাকে পুঁতি ঢুকে গিয়েছে। বাড়ির লোকেরা সেটি বার করতে গিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়ে ফেলেছে। বাড়ির লোক এবং প্রতিবেশী মিলে প্রায় জনা দশেক পেশেন্ট পার্টি আমাকে পেয়েই ঘিরে ধরল, সবিস্তারে তাদের অভিযোগের কথা জানালো। পাড়ার কোনও হাতুড়ে ডাক্তার নাকি বার করতে গিয়ে ওই পুঁতি আরও ভিতরে ঢুকিয়ে ফেলেছে। ওদের ধারণা, ওটা এখন যদি শ্বাসনালীতে চলে যায়, তাহলে বাচ্চা আর বাঁচবে না! যদি মাথায় উঠে যায় তাহলে আরও ভয়ঙ্কর বিপদ! আমাকে যে করেই হোক ওই পুঁতি বার করে বাচ্চাটিকে বাঁচাতে হবে।
আমার তো আক্কেল গুড়ুম। বুকের মধ্যে বিসর্জনের বাজনা বাজতে শুরু করলো। পুরো ইএনটি বিভাগে ডাক্তার বলতে সবেমাত্র হাউস সার্জেনশিপ শুরু করা আমি, একজনই। আর সঙ্গে আমার একজন হেলথ স্টাফ। এত লোকের সামনে যদি কোনও কারনে ওটা বার করতে না পারি, তাহলে যে আমার কপালে দুর্ভোগ আছে, সেটা আগেই বুঝে গেলাম। জয় মা দুর্গা বলে লেগে পড়লাম। ন্যাজাল হুক নাকের মধ্যে ঢুকিয়ে খুব কায়দা করে পুঁতিটাকে বার করতে হবে। তার আগে অ্যাসিস্ট্যান্টকে বললাম বাচ্চাটাকে ঠিকঠাক কোলে বসিয়ে চেপে ধরতে। ঠিকমতো চেপে ধরলে ফরেন বডি বার করতে খুব সুবিধা হয়। পেশেন্ট পার্টিরা সবাই আমার পিছনে দাঁড়িয়ে। পারলে আমার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। প্রথমবার ব্যর্থ হলাম, কিন্তু দ্বিতীয় বার এক টানেই পুরো পুঁতিটা বার করে আনলাম। উপস্থিত সবাই হই হই করে উঠলো, জয়ধ্বনি দিল আমার নামে। বাচ্চাটার মা তো কেঁদে কেটে একশা। সবথেকে ভালো লাগলো, বাচ্চাটিকে ওই পুঁতিটা হাতে নিয়ে খিল খিল করে হাসতে দেখে। বাচ্চার বাবা একটা দশ টাকার নোট বার করে আমাকে দিতে চাইল মিষ্টি খাওয়ার জন্য। ১৯৮১ সালে অর্থাৎ আজ থেকে ৪১ বছর আগে ১০ টাকার অনেক দাম। সবিনয় প্রত্যাখ্যান করে বললাম এই টাকাটি দিয়ে বাচ্চাটিকে কাল একটা খেলনা কিনে দেবেন। তারপর কেটে গিয়েছে অনেকদিন। সুদীর্ঘ ডাক্তারি জীবনে অনেক বাচ্চার নাক-কান থেকে অনেক কিছুই বার করেছি। তবু সেই সপ্তমীর রাতের ওই ঘটনাটি আমি কোনওদিন ভুলতে পারিনি। পারবও না।

সরকারি চাকরি কোনওদিন করিনি বলে পুজোতে অন্তত একটি বেলা চুটিয়ে ঠাকুর দেখার সুযোগ পেয়েছি প্রতিবছরই। দেখেছিও। আনন্দ-ফুর্তির ডালি কানায় কানায় পূর্ণ। মনে আছে, যে বছর প্রথম গাড়ি কিনেছিলাম, মা এবং বাড়ির অন্যান্যদের নিয়ে কলকাতায় ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিলাম। মা তখনও হাঁটাচলা করতে পারত। পরবর্তীকালে পুজোর একটি দিন ঘণ্টা কয়েক মাকে নিয়ে স্থানীয় কিছু ঠাকুর দেখিয়ে আনতাম। এখন পুজো এলে এটা খুব মিস করি। মিস করি আমার ঠাকুমা, যাকে কর্তামা বলে ডাকতাম, তাঁকেও। এক বছর বয়স থেকে কর্তামার স্নেহছায়াতেই মানুষ আমি। তখনও গাড়ি কিনে উঠতে পারিনি। পুজোর একদিন পাড়ার পরিচিত একটি রিকশা ভাড়া করে ঠাকুমাকে সেই রিকশাতেই তুলে দিতাম। সেই রিক্সাওয়ালা ভাইটি খুব দায়িত্ব নিয়ে ঠাকুমাকে বেশ কয়েকটি ঠাকুর দেখিয়া আমার বাড়ি পৌঁছে দিত।
আরও পড়ুন:

ডাক্তারের ডায়েরি, পর্ব-৩৬: শ্যুটিংয়ের গপ্পো সপ্পো

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৭: অপেক্ষার অবসান — অযোধ্যায় চার রাজকুমার

ছোটদের যত্নে: সন্তান জ্বরে ভুগছে? কী ভাবে সামলাবেন? রইল ঘরোয়া চিকিৎসার খুঁটিনাটি

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-১৯: অনুপ্রেরণার আর এক নাম কই মাছ

খুব নিষ্ঠা সহকারে, ভোগ সহযোগে ধুমধাম করে আমাদের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হত এক সময়। নেতৃত্ব দিত আমার ঠাকুমা অর্থাৎ কর্তামাই। সহযোগিতায় আমার মা, ফুল কাকিমা, ছোট কাকিমা, পরবর্তীকালে আমার স্ত্রী এবং অন্যান্য মহিলা বাহিনী। সবাই উপোস করে থাকতো।
লক্ষ্মী পুজো তো রাতের দিকেই হয়। একবার হলো কি, ঠাকুর মশাই আর পুজো করতে এল না। আমাদের বাড়ি আসবার পথে কারা নাকি তাকে হাইজ্যাক করে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়েছে! এদিকে রাত এগারোটা বেজে গিয়েছে। উপোস করে এবং সারাদিনের পরিশ্রমের ফলে সবাই ক্লান্ত। অনেক মহিলাই অসুস্থ হয়ে পড়ল। উপায়ান্তর না দেখে সবার অনুরোধে আমার ঠাকুমাই অং বং মন্ত্র পড়ে পুজো সারলো। বছর দুয়েক আগে আমার উপনয়ন হয়েছে। আমি ভাবলাম, যদি পুজোর মন্ত্রটা আমি জানতাম, তাহলে তো পুজোটা আমিই করতে পারতাম। হাজারো হক বামুনের ব্যাটা তো। আর আমার প্রিয়জনদের এত কষ্ট সহ্য করতেও হতো না। অশিক্ষিত, বিড়ি খেকো পুরুতের চেয়ে পুজোটা আমি যে কোনও অংশে খারাপ করবো না, এ বিশ্বাস আমার ছিল।

লেগে পড়লাম। আমার ছোটবেলার বন্ধু ভৈরব পুজো-আর্চা করত। ওর থেকে মন্ত্রের খাতা নিয়ে নিজের মতো করে লিখে নিলাম। প্রাথমিক ট্রেনিংটা ওই দিল। কিন্তু ফাইনাল ট্রেনিং নিলাম পাড়ার এক মুদি দোকানি মুখার্জিদার কাছ থেকে। অভাবে পড়ে দোকান চালাতেন ঠিকই, কিন্তু মানুষটি ছিলেন অতি ভদ্র, সৌম্য দর্শন এবং শিক্ষিত। উনি আমাকে শেখালেন প্রতিটি মন্ত্রের অর্থ, নানা ধরনের মুদ্রা, আচার-বিচার ইত্যাদি। ব্যাস! পরের বছর থেকে আমি পুরোদস্তুর পুরোহিত বনে গেলাম। সরস্বতী ও লক্ষ্মী, এই দুটি পুজোই আমি করেছি টানা ২১ বছর। যেবার প্রথম পুজো করা শুরু করি, সেবার আমি ডাক্তারিতে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। অতি উৎসাহে সারা পাড়া জুড়ে গোটা পনেরো পুজো করে ফেলেছিলাম। যে ডাকছিল, সেখানেই ছুটি যাচ্ছিলাম। আমাকে অ্যাসিস্ট করছিল আমার ছোটবেলার বন্ধু মানিক। বাবার এই ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ হয়নি। পরের দিন পরিষ্কার মাকে জানিয়ে দিল, ওকে বল ডাক্তারি পড়া ছেড়ে পুরোহিতগিরিটাই করতে। এরপর থেকে শুধু বাড়ির পুজোটাই করতাম। তবে মনে আছে প্রথমবার পুজো করে প্রচুর ফলমূল, আতপ চাল, গামছা, এমনকি একটা শাড়িও পেয়েছিলাম। নগদ টাকা পেয়েছিলাম অনেক। পরিষ্কার মনে আছে,পরের দিন আমি আর মানিক হাতিবাগানে রাধা সিনেমা হলে একটা হিন্দি সিনেমা দেখে শ্যামবাজারে গোলবাড়ির কষা মাংস খেয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। যতদিন আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিল ততদিন পুজোটা আমি নিজেই করেছি। এরপর কালের নিয়ম মেনে সংসার ভাগ হয়ে গেল। তারপরও দু-চার বছর করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত আর মন সায় দিল না। বন্ধ করে দিলাম পুজো করা। এখন আর আমাদের বাড়িতে লক্ষ্মী বা সরস্বতী, কোনও পুজোই হয় না। ঠাকুর দেবতায় আমার কোন কালই ভক্তি ছিল না, এখনও নেই। কিন্তু সবাই মিলে হই-হুল্লোড় করে পুজো করা, এটা আমি খুব এনজয় করতাম। মনে হতো যেন একটা ফ্যামিলি গেট টুগেদার, যেটা খুব মিস করি। মিস করি আমার কর্তামা, মা, ফুলমাকেও। কি নিষ্ঠাভরে যে তারা পুজোর আয়োজন করতেন! সেদিন আমি তাদের কাছে এই পরিবারের কেউ নই, আমি পুরোহিত, দেবতার ডাইরেক্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ।

আমার মা।

পুজোতে আমার অধিকাংশ স্মৃতিই খুব সুখের, আনন্দের। তবু দুঃখের ঘটনাও ঘটেছিল একবার। সেই দুঃখের স্মৃতি আমি এখনও বহন করে চলেছি। তখন আমাদের যৌথ পরিবার। বাবারা তিন ভাই একসঙ্গে। বাড়িতে প্রায় ১৩-১৪ জন সদস্য। আমার ছোট কাকা কালিকা প্রসাদ ভট্টাচার্য, ডাক নাম কানু, ছিল বকলমে ফ্যামিলি হেড। আমাদের পড়াশোনা এবং ভালো মন্দ দেখভাল করার সব দায়িত্ব ছিল তার উপরে। ভীষণ রসিক মানুষ ছিল আমাদের ছোট কাকা। মজার মজার কথা বলে হাসাতে হাসাতে পেট ফাটিয়ে দিত, আবার সিরিয়াস হলে তার চোখের দিকে তাকাতেই আমরা ভয় পেতাম। অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে হেলথ ইন্সপেক্টরের কাজ করত।

ইছাপুর থেকে হঠাৎ তাকে বদলি করে দেওয়া হলো মহারাষ্ট্রের ভুসয়ালে। তখন আমি হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়েছি। ওখানে থাকাকালীন আমার ডাক্তারিতে চান্স পাওয়ার খবর শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে কাকা বলেছিল, ‘এবার আর আমাদের ফ্যামিলিতে বিনা চিকিৎসা বা কুচিকিৎসায় কেউ মারা যাবে না। নিজেদের ঘরেই একজন ডাক্তার সবসময় মজুত থাকবে।’ ১৯৮১-র শুরুতে আমার ডাক্তারি পাশ করার খবর শুনে ছোট কাকা তার কর্মস্থলের বহু লোকজনকে নিমন্ত্রণ করে ভুরিভোজ খাইয়েছিল।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৬: অক্ষবিদ্যাশিক্ষা করলেন নলরাজা

ত্বকের পরিচর্যায়: ‘টাকপোকা’ ঠিক কী? এই অসুখে আপনিও আক্রান্ত হতে পারেন, এর প্রতিকার জানেন?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৫: শেকল-বাঁধা ঠাকুরবাড়ির খাতা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪: ধীরে চলো ‘ওরে যাত্রী’ [০২/০২/১৯৫১]

১৯৮২ সালের সেদিনটি ছিল সপ্তমী। পূজা মন্ডপে সবে ঢাকে কাঠি পড়েছে। তখন তো আর ১৫ দিন ধরে দুর্গাপুজো চলতো না। আমি ডে অ্যান্ড নাইট ডিউটি নিয়েছি, যাতে পরের দিনগুলো ছুটি পাই। আগেই খবর পেয়েছিলাম ভুসয়ালে ছোট কাকা পেটের অসুখে গুরুতর অসুস্থ হয়ে অর্ডন্যান্স হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আমরা সবাই যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলাম। সপ্তমীর সকালে আউটডোরে ডিউটি করছি। হঠাৎ ইনডোরে জরুরি তলব পড়লো আমার। গিয়ে দেখি আমার নামে একটি টেলিগ্রাম এসেছে। সে সময় তো আর মোবাইল ফোন ছিল না। ল্যান্ড ফোন এবং টেলিগ্রামই ছিল খবর আদান প্রদানের ভরসা। বাড়ির ল্যান্ডলাইন ফোন খারাপ থাকায় আমার উদ্দেশ্যে এই টেলিগ্রাম। ঠিকানা ছিল আর জি কর মেডিকেল কলেজের ইএনটি বিভাগ। টেলিগ্রাম পড়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই, শিরদাঁড়া বেয়ে যেন একটি হিম শীতল স্রোত নামতে থাকে। আমার ছোট কাকা আর নেই। ইওর আঙ্কেল কালিকা দাস এক্সপায়ার্ড ইয়েসটারডে অ্যাট অর্ডন্যান্স হসপিটাল। সেদিন আমার সহকর্মীরা একটি ট্যাক্সি ডেকে আমাকে তুলে দিয়েছিল। আমি বাড়ি এসে সবাইকে এই দুঃসংবাদটি জানাই। সারা বাড়ি জুড়ে কান্নার রোল পড়ে যায়। বিশেষ করে আমার কর্তামা অর্থাৎ ছোট কাকার মা আছারি পিছারি করে কাঁদতে থাকেন। আসলে মাত্র ১০ মাস বয়স যখন আমার কাকার, তখন আমার কর্তামা বিধবা হয়েছিলেন। সেই যুগে ওই সামাজিক পরিকাঠামোতে ১০ মাসের একটি শিশুকে মানুষ করে তোলা একজন বিধবার পক্ষে যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ছিল।

আমার ছোট কাকা।

সেবারের জন্য পুজোর আনন্দ হারিয়ে গেল আমাদের পুরো পরিবারেরই। শোক একসময় কমে আসে, কমে আসে কান্নার বহিঃপ্রকাশও। কিন্তু আমার কর্তামার বুকে শোকের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলে ছিল বহু-বহুদিন। আমি কর্তামার সঙ্গেই সেই ছোট্ট বয়স থেকে শুতাম। পুজোর বাকি কটা দিন এবং তারপরও বেশ কিছুদিন আমার ঘুম ভাঙতো সদ্য সন্তানহারা এক বিধবা মায়ের বিলাপ মিশ্রিত কান্না শুনে। ‘ওরে কানু তোকে যে আমি কত কষ্টে মানুষ করেছি, আমি বেঁচে থাকতে তুই চলে গেলি, ফিরে আয় বাবা ফিরে আয়।’ মন্ডপ থেকে ভেসে আসা ঢাকের আনন্দ ধ্বনির সঙ্গে আমার ঠাকুমার কান্নার বিলাপ ধ্বনি মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। আমার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে ফোঁটা ফোঁটা জল। সেই জলেই সেবার নিঃশব্দে অঞ্জলি দিয়েছিলাম মায়ের চরণে।

Skip to content