মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


পরিক্রমণের পথে শারদীয়া দূর্গা পূজার পূর্বেই আসে মহালয়া। নদীমাতৃক ভারতের বিভিন্ন নদীতে পিতৃতর্পণের মধ্য দিয়ে উত্তর পুরুষগণ আহ্বান করেন তাঁদের পূর্বপুরুষগণকে। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনায় যে অমাবস্যা আসে, তাই মহালায়া। এই দিনটি হচ্ছে পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার সন্ধিলগ্ন। ‘মহ’ শব্দের দুটি অর্থ — পূজা ও উৎসব। আবার মহালয় বলতে বোঝায় মহান আলয়। আলয় কথাটির অর্থ আশ্রয়, এর সঙ্গে ‘আ’ যুক্ত করে পূজার আলয় হয়েছে।

অন্যদিকে মহালয় বলতে পিতৃলোককে বোঝায়, যেখানে বিদেহী পিতৃপুরুষগণ অবস্থান করছেন। তাই পিতৃলোককে স্মরণের অনুষ্ঠানই মহালায়া। কিন্তু তাহলে আ-কারান্ত স্ত্রীলিঙ্গ কেন? এর উত্তরে বলা যায়, পিতৃপক্ষের অবসানে, অন্ধকার অমাবস্যার সীমানা ডিঙিয়ে আমরা যখন আলোকময় দেবীপক্ষের আগমনকে প্রত্যক্ষ করি, তখন সেই মহালগ্নটি আমাদের জীবনে মহালয়ার বার্তা বহন করে আনে। এ ক্ষেত্রে স্বয়ং দেবীই সেই মহান আশ্রয়। তাই উত্তরণের লগ্নটির নাম মহালয়া।

স্মরণাতীতকাল থেকে মহালয়ার তর্পণ চলে আসছে হিন্দু সংস্কৃতিতে। দেবীপক্ষের শারদীয় উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হওয়ার প্রাক্কালে সূর্য যখন কন্যা রাশিতে প্রবেশ করে, তখন সূচিত হয় পিতৃপক্ষ। হিন্দুগণ বিশ্বাস করেন তাঁদের পূর্বজ পিতৃপুরুষগণও এইসময় আবির্ভূত হন পৃথিবীতে। আবার সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে প্রবেশ করলে, তাঁরা প্রত্যাবর্তন করেন পিতৃলোকে। এসময় আকাশপ্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে তাঁদের যাত্রাপথকে আলোকিত করার প্রথাও এদেশে প্রচলিত আছে। পিতৃগণের অবস্থানের প্রথম পক্ষে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতে হয়। “আগচ্ছন্তু যে পিতর ইমং গৃহ্নং স্ত্বপোঞ্জলিম্” — অর্থাৎ হে পিতৃপুরুষগণ আপনারা আসুন, আমার অঞ্জলিগ্রহণ করুন। আমাদের বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত তর্পণের এই চিরাচরিত প্রথা শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তর্পণ হল স্মৃতির মুখোমুখি হওয়া, স্মৃতির কাছে নতমস্তক হওয়া। প্রত্যহ যাপনের ব্যস্ততায়, মুখরতায় যে পূর্বপুরুষদের আমরা বিস্মৃত হই, আমাদের নিত্যদিনের সুখ-দুঃখে যাঁদের শরীরী উপস্থিতি নেই, তবুওতো তাঁরা আছেন। দেবীপক্ষের শুভসূচনায়, দেবী বন্দনায় যখন মুখরিত চারিদিক সেই শুভক্ষণে তাঁদের স্মরণ ও স্মৃতি তর্পণ যেন উত্তরপুরুষগণের মানবিক ঔদার্যেরই পরিচয়। এ কথা বললে অত্যুক্তি হয় না যে, পিতৃ ত র্পণ হল — ”ইতিহাসের প্রতি, ঐতিহ্যের প্রতি, আজকে আমি হয়ে ওঠার পশ্চাতে যে প্রবাহমান অতীত রয়েছে সেই অতীতকে স্বীকৃতিদানের এক উপায়মাত্র”।

তর্পণ প্রথা এক শাস্ত্রীয় নির্দেশও। যে নির্দেশ ”বসুধৈব কুটুম্বকম্” — এই আর্ষ বাক্যের দ্বারা ধ্বনিত হয়ে নিজ পরিবারের গন্ডিকে অতিক্রম করে বৈশ্বিক পর্যায়ে উন্নীত করেছে আত্মীয়তাকে। ‘ত্রুপ’ থেকে তর্পণ শব্দটির উৎপত্তি। ‘ত্রুপ’ কথার অর্থ ‘সন্তুষ্ট করা’। শাস্ত্র মতে, যে কার্যদ্বারা অপরের তৃপ্তি হয় তাই তর্পণ। অর্থাৎ অপরের প্রীত্যর্থে জলদান। তর্পণের উদ্ভবের ইতিহাস সম্পর্কে রামায়ণ-মহাভারত থেকে আমরা জানতে পারি, শ্রী রামচন্দ্র যখন লঙ্কা বিজয়ের পূর্বে অকালবোধন করে মা দুর্গাকে নিয়ে আসেন, তখন তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করে পূজায় বসেন।

কারণ, হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী কোনও শুভ কাজ করার সূচনাপর্বে প্রয়াত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করে, প্রণাম জানিয়ে তবেই কাজ শুরু করতে হয়। এই দিনেই প্রয়াত ব্যক্তির আত্মারা মর্তে আসেন। আত্মাদের এই মর্তে আগমনকেই মহালয় বলা হয়। সেখান থেকেই ‘মহালয়া’ কথাটার উৎপত্তি। তাই মহালয়কে পিতৃপক্ষের শেষ দিন বলা হয়।
আরও পড়ুন:

আবিষ্কার যখন আবিষ্কারকহন্তা, পর্ব-৫: রেডিয়াম পেন্টের উদ্ভাবক ভন সোচকি-র মৃত্যু হয় তেজস্ক্রিতায়

ছোটদের যত্নে: শিশু পেটের ব্যথায় ভুগছে? তাহলে শিশু বিশেষজ্ঞের এই পরামর্শগুলি মেনে চলুন

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৭: অপেক্ষার অবসান — অযোধ্যায় চার রাজকুমার

তর্পণের উল্লেখ পাওয়া যায় মহাভারতেও। দাতা কর্ণের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মা স্বর্গে গমন করলে সোনা ও মূল্যবান ধাতু খাদ্য হিসেবে দেওয়া হয় তাঁকে। স্বাভাবিকভাবেই কর্ণ অবাক হয়ে দেবরাজকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র বলেন যে, কর্ণ তাঁর সারা জীবনে অনেক দান কর্ম করলেও প্রার্থিত ব্যক্তিদের শুধু মূল্যবান ধনরত্নই দিয়ে গিয়েছেন। তাঁর পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে কখনও খাদ্য ও জল নিবেদন করেননি। পিতৃ পুরুষগণের প্রতি এই অবহেলার জন্য তাঁকে সোনা ও ধনরত্ন খাদ্য হিসেবে দেওয়া হয়েছে। পরে কর্ণ নিজের ভুল স্বীকার করে নিলে তাঁকে ১৬ দিনের জন্য আবার পৃথিবীতে প্রেরণ করেন দেবরাজ ইন্দ্র। পৃথিবীতে ফিরে নিজের পিতৃ পুরুষগণের উদ্দেশ্যে খাদ্য ও জল দান করেন তিনি। সেই থেকেই ১৬ দিনের এই পর্ব পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত।

পুরাণ মতে, মহালয়ার দিনে দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধের দায়িত্ব পান। ব্রহ্মার বর অনুযায়ী মহিষাসুর কেবলমাত্র নারীর দ্বারাই বধ্য। অসীম ক্ষমতাশালী মহিষাসুরকে বধের নিমিত্ত ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবের সম্মিলিত শক্তির প্রভাবে মহামায়া রূপে যে নারীশক্তির সৃষ্টি হল, তিনিই দেবী দুর্গা। দেবতাগণের দশটি অস্ত্রে সুসজ্জিতা সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা নয় দিন ব্যাপী যুদ্ধে মহিষাসুরকে পরাজিত ও হত্যা করলেন। তাই মহালয়ার দিন অতি প্রত্যুষে চন্ডীপাঠ করার রীতি রয়েছে।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৬: অক্ষবিদ্যাশিক্ষা করলেন নলরাজা

ছোটদের যত্নে: শিশুকে কোন ওষুধ কখন খাওয়াবেন? ওষুধ খাওয়ার সঠিক নিয়ম কী? জানুন শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১২: কাঠবিড়ালি ঢুকে পড়েছিল দ্বিজেন্দ্রনাথের জোব্বায়

সনাতন শাস্ত্রোক্ত তর্পণ বহুবিধ। পিতৃ তর্পণ, মাতৃ তর্পণ, গুরু তর্পণ, ঋষি তর্পণ, দিব্য তর্পণ, যম তর্পণ, ভীষ্ম তর্পণ, রাম তর্পণ, লক্ষণ তর্পণ, শূদ্র তর্পণ। নাস্তিক ভাবধারার বশবর্তী হয়ে যে সন্তান তর্পণ করেন না, জল পানের আশায় পিতৃপুরুষগণ তাঁর কাছে আসেন এবং নিরাশ হয়ে রক্ত পান করে চলে যান। তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে ”নাস্তিক্য ভাবাৎ যশ্চাপি ন তর্পয়তি বৈ সুতঃ, পিবন্তি দেহ রুধিরং পিতরো বৈ জলার্থিনঃ”। পুত্র সন্তানের প্রতি তার মাতা পিতা এবং পূর্বপুরুষগণের অনন্ত চাহিদা থাকে। ‘পু’ অর্থাৎ নরক।’ ত্র’ অর্থ ত্রাণ। নরক থেকে ত্রাণ করেন বলেই তিনি পুত্র। পিতামহ ভীষ্ম বিবাহ করেননি। ফলে তিনি অপুত্রক। এই ভারতে তাঁর মতো অনেক ব্যক্তি আছেন যাঁরা অপুত্রক। সেই সকল পুরুষদের অতৃপ্ত আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছে তর্পণ ক্রিয়া — “অপুত্রায় দদাম্যেতৎ সলিলং ভীষ্মবর্মণে”। তর্পণ কথার অর্থ খুশি করা। বন্ধু, আত্মীয় না হয়েও, রক্তের সম্পর্কিত না হয়েও পরমাত্মীয় রূপে জন্ম-জন্মান্তর ধরে সেই সকল বন্ধু ভাবাপন্নদের উদ্দেশ্যে তিল তর্পণের নির্দেশ রয়েছে শাস্ত্রে —

“যে বান্ধবা বা অবান্ধবা বা যে অন্য জন্মনি বান্ধবাঃ
তে তৃপ্তিং অখিলাং যান্ত যে অস্মৎ তোয় কাঙ্ক্ষিণঃ।।”


তর্পণকালে পিতা-মাতা ছাড়াও সপ্ত পুরুষগণকে জলদানের নির্দেশ দিয়েছেন শাস্ত্রকারগণ। মহালয়ার পূণ্যলগ্নে তর্পণকে কেন্দ্র করে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সংযোগ ঘটে। সেই সংযোগের অনুরণনে তৃপ্ত হয় আমাদের অন্তরমন। নস্যাৎ হয় আমাদের পরিচয় সঙ্কট (আইডেন্টিটি ক্রাইসিস)। বংশের বন্ধন দৃঢ় হয়।

“বৈয়াঘ্রপদগোত্রায় সাংকৃত্যপ্রবরায় চ
গঙ্গাপুত্রায় ভীষ্মায় সর্বদা ব্রহ্মচারিণে।
ভীষ্মঃ শান্তনবো বীরঃ সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয়ঃ
আভিরদ্ভিরবাপ্নোতু পুত্রপৌত্রচিতাং ক্রিয়াম্।।”

—এই মন্ত্রে তর্পণের দর্পণে আমরা প্রত্যক্ষ করি বৈশ্বিক মানব বন্ধনকে।

ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সুবীর ভট্টাচার্য

Skip to content