শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ইটিভিতে আমি ব্রহ্মা।

সিরিয়াল নয়, প্রথম আমি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম সিনেমার শ্যুটিং করতে। নাম ছিল ‘বীজ’। পরিচালক ছিলেন পান্না হোসেন। সেটা সম্ভবত ১৯৮৪-৮৫-র কথা। কিন্তু সেন্সর হয়ে যাবার পরেও সেই ছবিটি কোনও অজ্ঞাত কারণে মুক্তি পায়নি। শ্যুটিং করতে গিয়ে আমি একবারই গোঁফ কেটে ছিলাম। সেটি ছিল আমার জীবনের এই প্রথম ছবিটিতেই। এক মোসাহেবের চরিত্র করেছিলাম। তখন ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে কাজ করি। মুখ ঢেকে বেশ কিছুদিন ওয়ার্ডে রোগী দেখতাম।

এরপরও বহুবার আমার গোঁফের উপর আক্রমণ চলেছে। ১৯৯৮ সালে আমি প্রথম রামোজি ফিল্ম সিটিতে সিরিয়াল করতে হায়দরাবাদে যাই। ‘মা মনসা’। পরিচালক ছিলেন নীতেশ রায়, যিনি ওই ফিল্ম সিটির প্রধান স্থপতি ছিলেন। আর যিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত অভিনেতা এবং পরবর্তীকালে পরিচালক ফাল্গুনী সান্যাল। আমরা ভালোবেসে ওকে ডাকি ফালু বলে। ওর মায়ের ক্যানসার চিকিৎসার সূত্রে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। পরবর্তীকালে গিরিশ মঞ্চেও এসেছিলেন আমার সেই সময়ের একটি নাটক ‘কামার কাহিনী’ দেখতে। দেখে ওর খুব ভালো লাগে। ও আমাকে দেখা করতে বলে ঊষা কিরণ মুভিজের অফিস, বর্তমানে যেটি শিবপ্রসাদ-নন্দিতার উইন্ডোজ প্রোডাকসনের অফিস, সেখানে। ফালুর নির্দেশ মতো বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা তিনটে ছবি সেখানে জমা দেই এবং প্রাথমিক কথাবার্তাও হয়। কয়েকদিন বাদে জানতে পারি, ওরা আমাকে ‘মা মনসা’ সিরিয়ালের ব্রহ্মা চরিত্রের জন্য নির্বাচন করেছেন। সিরিয়ালটি তৈরি হয়েছিল ইটিভি-র জন্য।

শাবানা আজমির সঙ্গে।

সময়টা ছিল ইটিভির জন্ম লগ্ন। তার আগে পর্যন্ত আমরা শুধু কলকাতা দূরদর্শনের প্রোগ্রামই দেখতাম। আর ছিল আলফা বাংলা, পরবর্তীকালে যেটি জি বাংলা হয়। ১৯৯৯ সাল। হায়দরাবাদ শহর থেকে ৩১ কিলোমিটার দূরে ডিনামাইট দিয়ে একের পর এক পাহাড় ধ্বংস করে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল রামোজি ফিল্ম সিটি, পরবর্তীকালে যেটি বিখ্যাত টুরিস্ট স্পট হয়ে উঠেছে। ইটিভির জন্য নির্মীয়মান পাঁচটি বাংলা মেগা সিরিয়াল এবং বেশ কিছু টেলিফিল্মের কাজ তখন এখানে সবে শুরু হয়েছে। আমরা কলকাতা থেকে ফলকনামা এক্সপ্রেসে একটি বিশাল দল গিয়েছিলাম ‘মা মনসা’য় কাজ করার জন্য। সকাল আটটায় যাত্রা শুরু করে পরের দিন দুপুর বারোটায় নামলাম সেকেন্দ্রাবাদ স্টেশনে। স্টেশনের বাইরেই ছিল প্রোডাকশনের বড় বড় ভ্যান। আমারা কো-অর্ডিনেটরের নির্দেশ মতো একটি ভ্যানে উঠে বসলাম। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই শহর ছেড়ে গ্রামের পর গ্রাম পার হয়ে পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগলো সেই ভ্যান। শেষ পর্যন্ত বিশাল রাজ দরবারি গেট পার হয়ে ঢুকে পড়লাম এক সুরম্য নগরীতে।

স্টার জলসায় আমি ব্রহ্মা।

কেমন দেখতে সেই নগরী! এখন বিভিন্ন সিনেমার কল্যাণে আপনারা অনেকেই বড় এবং ছোট পর্দায় তা দেখে ফেলেছেন। কিন্তু ২৩-২৪ বছর আগে, প্রথম আমরা যখন এখানে আসি এবং দিন দশেক রাত্রি বাস করি, তখন যে অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম, তা ভাষায় লিখে বোঝানো খুব কঠিন। গ্র্যাঞ্জার বলে একটা শব্দ ইংরেজিতে আছে। এক কথায় বলা যেতে পারে, চারপাশে শুধু আর্টিফিশিয়াল গ্র্যাঞ্জারের ছড়াছড়ি। সুরম্য প্রাসাদ, হাসপাতাল, হোস্টেল, এয়ারপোর্ট, বাজার, ধাবা, পুরো একটি অভিজাত পাড়া, বস্তি, সুইমিং পুল, রেললাইন এবং ট্রেন-সহ আস্ত একটা রেলস্টেশন। মজার কথা হল সবগুলোই কিন্তু সাজানো। ধরা যাক একটা বিশাল কনসট্রাকশন, যার সামনের দিকটা এয়ারপোর্ট লাউঞ্জ, পেছনের দিকটা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল। প্রথম কয়েকদিন শ্যুটিং থেকে ছুটি পেলেই বা শ্যুটিং না থাকলে আমি আরও কয়েকজন অভিনেতা বন্ধুকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে পুরো সিটিটা দেখার চেষ্টা করতাম। দিন সাতেক ঘুরেও অবশ্য পঞ্চাশ ভাগও দেখে উঠতে পারিনি, দেখা সম্ভবও নয়। তবে বেশ কিছু স্টার অভিনেতাকে কাছাকাছি দেখার সুযোগ পেয়েছি, তাদের অটোগ্রাফ নিয়েছি, একসঙ্গে ফোটোও তুলেছি।
প্রথমে বলি শাবানা আজমির কথা। এই ফিল্ম সিটিতে একটি বিশাল সেন্ট্রাল রেস্টুরেন্ট আছে, যেখানে একসঙ্গে প্রায় তিন হাজার লোক বসে খেতে পারে। বাংলা হিন্দি এবং তেলেগুভাষীদের জন্য আলাদা আলাদা খাবারের আইটেম। তবে সবাইকেই থালা সংগ্রহ করে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিতে হতো। অনেকটা বুফে সিস্টেমের মতো। সেখানে দুদিন আগেই দেহাতি পোশাক এবং মেকাপে শাবানা আজমিকে দেখেছিলাম থালা হাতে খাবার সংগ্রহ করতে। প্রথমটা নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। উনি শ্যুটিং করছিলেন শ্যাম বেনেগালের একটি সিনেমায়। আমরা কয়েকজন মিলে সেই শ্যুটিং স্পটে একদিন গিয়ে হাজির হলাম। শাবানা আজমি এবং শ্যাম বেনেগালের সঙ্গে কথা বললাম, ফটো তুললাম। অনেক বছর আগের কথা, তবু মনে আছে, শাবানা আজমি পরিচালক-অভিনেতা অঞ্জন দত্তর কথা আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন আর রিফ্লেক্টর আনিয়ে উজ্জ্বল আলোর ব্যবস্থা করে ছবি তুলিয়েছেন। আর হ্যাঁ, আমাদের সবাইকে চা-বিস্কুটও খায়িয়ে ছিলেন। সম্ভবত সিনেমাটির নাম ছিল ‘হরি ভারি’।

করিশমা কাপুর তখন বেশ জনপ্রিয় নায়িকা। তাঁকে দেখার মজার অভিজ্ঞতার কথা বলি। সে সময় আমি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করছি। আমার সাংবাদিক বন্ধুরা বলেছিল যে, আমি যেন ফিরে এসে রামোজি ফিল্ম সিটি নিয়ে একটা লেখা তৈরি করে তাদের দিই। সেই লেখার মাল মশলা সংগ্রহ করতে আমি সবান্ধব ছাড়া একা একাও এদিক সেদিক ঘুরে বেরিয়েছি। রামোজিতে দুটো ফাইভ স্টার হোটেল আছে, তারা এবং সিতারা। মুম্বইয়ের স্টাররা এলে ওখানেই উঠতেন। আমরা ছিলাম বাংলো টাইপের দোতলা গেস্ট হাউসে, নাম ছিল শান্তিনিকেতন ওয়ান.. টু.. এইরকম। সিতারার রিসেপশনে কথাবার্তা বলে আমি বেরিয়েছি, পাশে সুদৃশ্য গার্ডেনে হঠাৎ চোখ পরল। ভীষণ রোগা এবং ফর্সা একজন মহিলা ঘুরে ঘুরে মোবাইলে কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন। তখনও ঘরে ঘরে মোবাইল আসেনি, খুব ধনী ব্যক্তি ছাড়া কেউ মোবাইল ব্যবহার করতেনও না। মুখটা খুব চেনা চেনা লাগল, মনে হল কোথায় যেন দেখেছি! আমি একটুক্ষণ থমকে গিয়ে আবার এগোতে লাগলাম। কিন্তু মনটা খচখচ করছিল, হঠাৎ মনের আয়নায় ভেসে উঠলো ‘দিল তো পাগল হ্যায়’ সিনেমার অন্যতম এক নায়িকার মুখ। আরে এ তো করিশমা কাপুর! একটু দাঁড়ালাম। উনি ফোনে কথা বলা বন্ধ করতেই এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলাম, কথা বললাম।
আরও পড়ুন:

চোখ ভালো রাখতে রোজকার পাতে এই খাবারগুলি থাকছে তো? দেখে নিন একঝলকে

মনের আয়না: আপনার সন্তান কি মোবাইলে আসক্ত? এর থেকে মুক্তি পেতে জানুন মনোবিদের পরামর্শ

মুম্বইয়ের অভিনেতারা ভীষণ প্রফেশনাল, একই সঙ্গে ভীষণ আন্তরিকও। বাঙালিদের ওঁরা একটু বেশি ফেবার করেন বলেই আমার মনে হয়েছে। আট-দশবার রামোজিতে যাতায়াত করার অভিজ্ঞতা থেকেই এটা বলছি। অনেক স্টারের সঙ্গেই মিট করেছি ওখানে। সাউথ ইন্ডিয়ান স্টার প্রভুদেবা, চিরঞ্জীবী ছাড়াও ‘ফিরভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি’ সিনেমার শ্যুটিংয়ে শাহরুখ খান এবং জুহি চাওলা, ‘লজ্জা’ সিনেমার শ্যুটিংয়ে রাজকুমার সন্তোষী, মনীষা কৈরালা, আসরানি, দিনা পাঠক–পরবর্তীকালে সানি দেওল, অনিল কাপুর–সব নাম এখন মনেও নেই। প্রথমবার রামোজি থেকে ঘুরে আসার পর আমি প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন নামে এই ফিল্ম সিটি নিয়ে ফিচার লিখেছিলাম। এরপরেও আমি ওখানে গিয়েছি, ‘তুলকালাম’ এবং ‘জোশ’ সিনেমার শ্যুটিং করতে। তবে আগে যেতাম ট্রেনে, পরবর্তীকালে ফ্লাইটেই যাতায়াত করেছি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৩: রবীন্দ্রনাথের মাস্টারমশায়

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৩: রাজা থেকে ঋষি — উত্তরণের আলোকপথযাত্রী বিশ্বামিত্র

কথায় কথায় গোঁফ প্রসঙ্গ থেকে অনেকটা দূর চলে এসেছি, আবার গোঁফে ফিরি। আগেই বলেছি, আমি নির্বাচিত হয়েছিলাম ব্রহ্মার চরিত্রে। প্রথম দিন গাড়িতে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল কিছুটা দূরে পাহাড়ের উপর মেকআপ রুমে। বিশাল মেকআপ রুম। একসঙ্গে অন্তত দশ জন মেকআপ করতে পারে। আমি উর্ধাঙ্গ অনাবৃত করে চেয়ারে বসলাম। সামনে দেওয়াল জুড়ে বিশাল সব আয়না। আয়নার সামনে দেখলাম একটা ফটোগ্রাফ পড়ে আছে, ব্রহ্মার কোনও চরিত্রাভিনেতার। সেটাকে অনুসরণ করেই আমার মেকআপ হবে, এটুকু বুঝলাম। দশাশই চেহারার একজন তেলেগু মেকাপ আর্টিস্ট ভাঙাভাঙা হিন্দিতে যা বললেন তার অর্থ হল, আপনি গোঁফটা কেটে আসেননি কেন! এখন আবার আমাকে কষ্ট করে আপনার গোঁফ কাটতে হবে। বলেই আমার গোঁফে ভালো করে জল স্প্রে করে রেজার সেটের সন্ধান করতে লাগলেন। আমি প্রমাদ গুনলাম। এমন তো কথা ছিল না! আমি তো ফাল্গুনীকে পই পই করে বলেছিলাম, গোঁফ আমি বিসর্জন দিতে পারব না।

কলার্স বাংলায় আমি ব্রহ্মা।

আমি মেকআপ আর্টিস্টকে একটু অপেক্ষা করতে বলে ওখান থেকে ল্যান্ড লাইনে ফোন করলাম শ্যুটিং ফ্লোরে ‘মা মনসা’-র অন্যতম সহকারি পরিচালক ফাল্গুনীকে অর্থাৎ আমাদের ফালুকে। যথেষ্ট ব্যস্ত ছিল ও সেই সময়। কিন্তু আমি ডাকছি শুনে ফোন ধরল। সব শুনে বলল ওই মেকআপ আর্টিস্টকে ফোনে ধরিয়ে দিতে। আমি দিলাম। তাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে সে যাত্রায় আমার গোঁফের গঙ্গা যাত্রা আটকানো গেল। আসল গোঁফের উপর নকল গোঁফ, দাড়ি, পরচুলা, নানা ধরনের অলংকার এবং সর্বোপরি আরও দুটো বাড়তি হাত এবং তিনটে মাথা দিয়ে আমাকে পুরো জড়ভরত বানিয়ে দেওয়া হল। ওই বাড়তি হাত আর মাথা নিয়ে না পারি ভালো করে বসতে, না পারি কিছু খেতে! সে এক নরক যন্ত্রণা! আগে তো ভাবিনি আমার এই দশা হবে! ব্রহ্মা চরিত্র শুনে লাফিয়ে উঠেছিলাম। আরেকটি রোলও আমাকে অফার করা হয়েছিল। জগৎকারু মুনির রোল, যেটি পরবর্তীকালে বাদশা মৈত্র করেন। কিন্তু সবাই বলল, এই রোলটির গুরুত্ব অনেক বেশি, তাই রাজি হয়েছিলাম। তখন কি আর জানতাম, ব্রহ্মা সাজার এমন জ্বালা। রাতে গেস্ট রুমে ফিরে দেখি ঘাড় নাড়াতে পারছি না, হাত দুটো টনটন করছে। যতদিন ব্রহ্মা করতে রামোজিতে গিয়েছি, ওই আর্টিফিশিয়াল হাত এবং মাথার ক্রাউন আমাকে বড্ড জ্বালিয়েছে। আর এখন তো কম্পিউটার গ্রাফিক্সে দুটো হাত কেন, হাজার হাত এবং হাজার মুন্ডু লাগিয়ে দেওয়া যায়!

মঞ্চে আমি ব্রহ্মা।

আমি তখনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, জীবনে কখনও আর মাইথোলজিকাল সিনেমা কিংবা সিরিয়াল করব না। কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা আমি রাখতে পারিনি। এরপরও আমি পরপর তিনবার মহালয়ার অনুষ্ঠানে ব্রহ্মা সেজেছি। কলকাতা দুরদর্শনে, স্টার জলসায় এবং গতবার কলার্স বাংলায়। এবং শুনলে আশ্চর্য হবেন আমার গ্রুপের চলতি মজার নাটক (কৈলাসে চা পান), যেটি আগামী ২১ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ বুধবার গিরিশ মঞ্চে সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় মঞ্চস্থ হতে চলেছে, সেই নাটকেও আমি ব্রহ্মার ভূমিকায়। অবশ্য এবার আমার উপর রোলটা চাপিয়ে দেয়নি কেউ, আমি স্বেচ্ছায় নিয়েছি। এবং একমাথা ও দুটো হাত অর্থাৎ আমার অরিজিনালি যা আছে, তাই নিয়েই অভিনয় করেছি। আসলে আমি ব্রহ্মা চরিত্রের প্রেমে পড়ে গিয়েছি যে! শ্যুটিংয়ের আরও মজার গল্প শোনাবো পরের পর্বে।

ছবি: লেখক

Skip to content