মিথিলা নগরী, জনক রাজার দেশ। সেখানে বিরাট যজ্ঞের আয়োজন। নানা দেশ থেকে এসেছেন কত সহস্র ব্রাহ্মণ, তাঁদের বিচিত্র দেশীয় ভাষায় মুখরিত মিথিলার আকাশ। এসেছে কত রথ, অগ্নিহোত্রের সামগ্রীতে পরিপূর্ণ। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এ নগরীতে অবশেষে উপস্থিত হলেন ঋষি বিশ্বামিত্র। সঙ্গে তাঁর সিদ্ধাশ্রমের মুনি-ঋষিরা আর দুই দাশরথি কোশলকুমার। রাম, লক্ষ্মণ দুই ভাইকে নিয়ে এসেছেন বিশ্বামিত্র, জনকের আশ্চর্য হরধনুটি দেখাবেন তাঁদের। শুধু এ অভিপ্রায়েই কি তিনি নিয়ে এলেন তাঁদের? না কি এই মিথিলাতেই নির্ধারিত হবে রাজকুমারদের ভবিষ্যৎ জীবন, জুড়ে যাবে মিথিলা আর অযোধ্যার হৃদয় — এ ইঙ্গিত তিনি আগেই পেয়েছিলেন? তবে, সে কথা এখন থাক। আজ বরং শুনি দুই ঋষির বিরোধের ইতিবৃত্ত। দুই ঋষি, নাকি ঋষি ও রাজার বিরোধ?
মিথিলা নগরীতে মহর্ষি বিশ্বামিত্র এসেছেন, এ সংবাদ শুনে রাজপুরোহিত শতানন্দ ও অন্যান্য ঋত্বিকদের নিয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে এলেন স্বয়ং মিথিলেশ্বর জনক। পাদ্য, অর্ঘ্য দিয়ে সসম্মানে বরণ করে নিলেন তাঁকে। তপোবলে, অধ্যাত্মশক্তিতে সকলের পূজনীয়, বরণীয় ঋষি তিনি। কিন্তু তিনি কি এমন বরণীয়, সর্বজনমান্য অধ্যাত্মতেজে সমুজ্জ্বল ঋষিই ছিলেন? তাঁর ফেলে-আসা অতীত তো অন্য কথা বলে। বলে তাঁর ক্ষাত্রতেজের কথা, বলে কুশরাজার বংশধর, কান্যকুব্জের অধীশ্বর গাধির পুত্র রাজা বিশ্বামিত্রের কথা। তবে বিশ্বামিত্র রাজা থেকে কেন ঋষি হলেন? কোন দুশ্চর তপস্যায় অর্জন করলেন তিনি ব্রহ্মতেজ? আর কেনই বা রাজপ্রাসাদের বিলাস ছেড়ে ঋষিজীবনের কঠোর কৃচ্ছসাধনকেই বরণ করে নিলেন তিনি জীবনে?
মিথিলার রাজপুরোহিত, অহল্যানন্দন শতানন্দ শোনালেন সেই দুর্গম অধ্যাত্মপথে বিশ্বামিত্রের যাত্রার কথা। কত সংকট, চড়াই-উৎরাই পার হয়ে তিনি আজ ব্রহ্মতেজধারী ঋষি। বাল্মীকিরামায়ণে আদিকাণ্ডের কেন্দ্রপুরুষ তিনিই। কীভাবে শুরু হল তাঁর অধ্যাত্মপথে যাত্রা? সে যাত্রার মূলে রয়েছে ব্রহ্মতেজ আর ক্ষাত্রতেজের বিরোধ। শতানন্দ রামকে শোনালেন ঋষি বশিষ্ঠ আর রাজা বিশ্বামিত্রের বিরোধের কাহিনী। আমরাও শুনবো সে বৃত্তান্ত।
মহীপতি কুশ ছিলেন ব্রহ্মার পুত্র। কুশের পুত্র কুশনাভ, কুশনাভের পুত্র গাধি। মহামতি গাধির পুত্র ছিলেন বিশ্বামিত্র। শত্রুদমনে তৎপর, অমিততেজস্বী, পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন বিশ্বামিত্র। ধর্মাত্মা, প্রজাহিতৈষী, এই রাজা সুদীর্ঘকাল রাজকর্তব্য পালন করেছেন, সামলেছেন রাজ্যপাট। ক্ষত্রিয় রাজা তিনি, এবার, বীরদর্পে পৃথিবী পরিক্রমা করতে লাগলেন। সঙ্গে তাঁর ষড়ঙ্গ সেনাদল। মহাসমারোহে হাতী, ঘোড়া, রথ আর পদব্রজে চলে তাঁর সৈন্যদল, চলে সেই সঙ্গে অস্ত্রবাহক আর বাদ্যবাহকের দলও।
একবার বহু দেশ ঘুরে, নানা পর্বত, নদী, অরণ্য, নগর পার হয়ে ফুলে-ফলে, তরুলতায় পরিপূর্ণ এক শান্ত, সুনিবিড় তপোবনে এসে উপস্থিত হলেন রাজা। সেখানে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তৃণভোজী পশুর দল। তপস্যায় মগ্ন মহাত্মা মুনিরা কেউ দুশ্চর ব্রতপরায়ণ, কেউ বহিরিন্দ্রিয় দমন করে শুধু জল, বায়ু আর গাছের শুকনো পাতা গ্রহণ করে জীবন ধারণ করছেন। জিতেন্দ্রিয়, ক্রোধসংযমী মুনিরা কেউ কেউ শুধুমাত্র অপক্ব খাদ্য গ্রহণ করেই দিন যাপন করেন, কেউ বা গ্রহণ করেন প্রত্যহ একবার আহার। সেখানে নিশ্চিন্তে জপহোমে ব্যস্ত রয়েছেন বালখিল্য মুনিরা। তপশ্চর্যার এক উৎকৃষ্ট স্থান এই আশ্রম মহর্ষি বশিষ্ঠের।
পৃথিবী পরিক্রমা করে এ আশ্রমে প্রবেশ করলেন পৃথিবীপতি ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ বিশ্বামিত্র। বশিষ্ঠ যথাবিধি অভ্যর্থনা জানালেন তাঁকে। পারস্পরিক কুশল প্রশ্নে অভিনন্দিত করলেন দুজন দুজনকে। কথার শেষে মুনিশ্রেষ্ঠ বশিষ্ঠ সৈন্যদল সহ রাজা বিশ্বামিত্রকে অতিথিরূপে আপ্যায়নের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। প্রথমে বিনয়বশত সে অনুরোধে অসম্মতি প্রকাশ করলেও বশিষ্ঠের বারংবার অনুরোধে আশ্রমের অতিথি হলেন বিশ্বামিত্র। তখন বশিষ্ঠ তাঁর বিচিত্রশোভায় শোভিত শবলা নামক কামধেনুটিকে আহ্বান করলেন। তার কাছে চাইলেন তিনি সসৈন্য বিশ্বামিত্রের জন্য প্রচুর পরিমাণে উৎকৃষ্ট, সুস্বাদু বহু প্রকারের খাদ্যসম্ভার। নিমেষে চলে এল সেই বিপুল খাদ্য সম্ভার, রূপোর অতিকায় সব পাত্রে পরিপূর্ণ হয়ে। ছয়টি রসের আস্বাদনের বিপুল আয়োজন এক লহমায় প্রস্তুত। বিশ্বামিত্রের সৈন্যদল এ ব্যবস্থায় মহা খুশি। শুধু সৈন্যবাহিনী নয়, বিশ্বামিত্রের সঙ্গে ছিলেন অন্তঃপুরিকারাও। ছিলেন পুরোহিত, ব্রাহ্মণ, মন্ত্রী, অমাত্যরাও। তাঁরা সকলেই এমন সুস্বাদু খাবার খেয়ে তৃপ্ত হলেন।
মিথিলা নগরীতে মহর্ষি বিশ্বামিত্র এসেছেন, এ সংবাদ শুনে রাজপুরোহিত শতানন্দ ও অন্যান্য ঋত্বিকদের নিয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে এলেন স্বয়ং মিথিলেশ্বর জনক। পাদ্য, অর্ঘ্য দিয়ে সসম্মানে বরণ করে নিলেন তাঁকে। তপোবলে, অধ্যাত্মশক্তিতে সকলের পূজনীয়, বরণীয় ঋষি তিনি। কিন্তু তিনি কি এমন বরণীয়, সর্বজনমান্য অধ্যাত্মতেজে সমুজ্জ্বল ঋষিই ছিলেন? তাঁর ফেলে-আসা অতীত তো অন্য কথা বলে। বলে তাঁর ক্ষাত্রতেজের কথা, বলে কুশরাজার বংশধর, কান্যকুব্জের অধীশ্বর গাধির পুত্র রাজা বিশ্বামিত্রের কথা। তবে বিশ্বামিত্র রাজা থেকে কেন ঋষি হলেন? কোন দুশ্চর তপস্যায় অর্জন করলেন তিনি ব্রহ্মতেজ? আর কেনই বা রাজপ্রাসাদের বিলাস ছেড়ে ঋষিজীবনের কঠোর কৃচ্ছসাধনকেই বরণ করে নিলেন তিনি জীবনে?
মিথিলার রাজপুরোহিত, অহল্যানন্দন শতানন্দ শোনালেন সেই দুর্গম অধ্যাত্মপথে বিশ্বামিত্রের যাত্রার কথা। কত সংকট, চড়াই-উৎরাই পার হয়ে তিনি আজ ব্রহ্মতেজধারী ঋষি। বাল্মীকিরামায়ণে আদিকাণ্ডের কেন্দ্রপুরুষ তিনিই। কীভাবে শুরু হল তাঁর অধ্যাত্মপথে যাত্রা? সে যাত্রার মূলে রয়েছে ব্রহ্মতেজ আর ক্ষাত্রতেজের বিরোধ। শতানন্দ রামকে শোনালেন ঋষি বশিষ্ঠ আর রাজা বিশ্বামিত্রের বিরোধের কাহিনী। আমরাও শুনবো সে বৃত্তান্ত।
মহীপতি কুশ ছিলেন ব্রহ্মার পুত্র। কুশের পুত্র কুশনাভ, কুশনাভের পুত্র গাধি। মহামতি গাধির পুত্র ছিলেন বিশ্বামিত্র। শত্রুদমনে তৎপর, অমিততেজস্বী, পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন বিশ্বামিত্র। ধর্মাত্মা, প্রজাহিতৈষী, এই রাজা সুদীর্ঘকাল রাজকর্তব্য পালন করেছেন, সামলেছেন রাজ্যপাট। ক্ষত্রিয় রাজা তিনি, এবার, বীরদর্পে পৃথিবী পরিক্রমা করতে লাগলেন। সঙ্গে তাঁর ষড়ঙ্গ সেনাদল। মহাসমারোহে হাতী, ঘোড়া, রথ আর পদব্রজে চলে তাঁর সৈন্যদল, চলে সেই সঙ্গে অস্ত্রবাহক আর বাদ্যবাহকের দলও।
একবার বহু দেশ ঘুরে, নানা পর্বত, নদী, অরণ্য, নগর পার হয়ে ফুলে-ফলে, তরুলতায় পরিপূর্ণ এক শান্ত, সুনিবিড় তপোবনে এসে উপস্থিত হলেন রাজা। সেখানে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তৃণভোজী পশুর দল। তপস্যায় মগ্ন মহাত্মা মুনিরা কেউ দুশ্চর ব্রতপরায়ণ, কেউ বহিরিন্দ্রিয় দমন করে শুধু জল, বায়ু আর গাছের শুকনো পাতা গ্রহণ করে জীবন ধারণ করছেন। জিতেন্দ্রিয়, ক্রোধসংযমী মুনিরা কেউ কেউ শুধুমাত্র অপক্ব খাদ্য গ্রহণ করেই দিন যাপন করেন, কেউ বা গ্রহণ করেন প্রত্যহ একবার আহার। সেখানে নিশ্চিন্তে জপহোমে ব্যস্ত রয়েছেন বালখিল্য মুনিরা। তপশ্চর্যার এক উৎকৃষ্ট স্থান এই আশ্রম মহর্ষি বশিষ্ঠের।
পৃথিবী পরিক্রমা করে এ আশ্রমে প্রবেশ করলেন পৃথিবীপতি ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ বিশ্বামিত্র। বশিষ্ঠ যথাবিধি অভ্যর্থনা জানালেন তাঁকে। পারস্পরিক কুশল প্রশ্নে অভিনন্দিত করলেন দুজন দুজনকে। কথার শেষে মুনিশ্রেষ্ঠ বশিষ্ঠ সৈন্যদল সহ রাজা বিশ্বামিত্রকে অতিথিরূপে আপ্যায়নের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। প্রথমে বিনয়বশত সে অনুরোধে অসম্মতি প্রকাশ করলেও বশিষ্ঠের বারংবার অনুরোধে আশ্রমের অতিথি হলেন বিশ্বামিত্র। তখন বশিষ্ঠ তাঁর বিচিত্রশোভায় শোভিত শবলা নামক কামধেনুটিকে আহ্বান করলেন। তার কাছে চাইলেন তিনি সসৈন্য বিশ্বামিত্রের জন্য প্রচুর পরিমাণে উৎকৃষ্ট, সুস্বাদু বহু প্রকারের খাদ্যসম্ভার। নিমেষে চলে এল সেই বিপুল খাদ্য সম্ভার, রূপোর অতিকায় সব পাত্রে পরিপূর্ণ হয়ে। ছয়টি রসের আস্বাদনের বিপুল আয়োজন এক লহমায় প্রস্তুত। বিশ্বামিত্রের সৈন্যদল এ ব্যবস্থায় মহা খুশি। শুধু সৈন্যবাহিনী নয়, বিশ্বামিত্রের সঙ্গে ছিলেন অন্তঃপুরিকারাও। ছিলেন পুরোহিত, ব্রাহ্মণ, মন্ত্রী, অমাত্যরাও। তাঁরা সকলেই এমন সুস্বাদু খাবার খেয়ে তৃপ্ত হলেন।
বিশ্বামিত্র শুধু তৃপ্তই হলেন না, তাঁর অন্তরে ক্ষত্রিয়সুলভ অধিকারের বাসনাও জেগে উঠল। এমন কাম্য বস্তু দানকারী গাভী তো রত্ন! আর এমন দুর্লভ রত্ন অধিকারে থাকবে, ভোগ করবে পার্থিব রাজা— এটাই তো স্বাভাবিক! এ গাভী যে রাজার আয়ত্তে থাকবে, তাঁর ঐশ্বর্যের অভাব থাকবে না কখনও। রাজশ্রেষ্ঠ বিশ্বামিত্র আর আত্মসংবরণ করতে পারলেন না। ক্ষত্রিয়ের অধিকারবোধে কামধেনু শবলাকে বশিষ্ঠের কাছে চেয়ে বসলেন তিনি। অবশ্য একলক্ষ গাভীর বিনিময়ে। বশিষ্ঠ কিছুতেই সম্মত হলেন না এ প্রস্তাবে। স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, শতসহস্র কেন, শতকোটি ধেনুর বিনিময়ে বা রাশি রাশি রূপো পেলেও শবলাকে তিনি দেবেন না। এই শবলা তাঁর যে প্রাত্যহিক দিন যাপনের নিত্যসঙ্গী, এ যেন মনস্বী, যশস্বী মানুষের সাথে জড়িয়ে থাকা কীর্ত্তির মতোই অবিচ্ছেদ্য। আশ্রমের যাগ-যজ্ঞ, জপ-হোম সব কিছুতেই শবলা যোগান দেয় প্রয়োজনীয় উপকরণ। আশ্রমে ভূতযজ্ঞে অন্যান্য প্রাণিদের উদ্দেশ্যে খাদ্যের ব্যবস্থাও করে সে। আশ্রমের অন্ন-পানের দায়িত্বভার তারই। তাকে কিছুতেই রাজার হাতে তুলে দিতে পারলেন না বশিষ্ঠ।
বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয়বীর। পার্থিব সম্পদের মূল্য দিয়ে বিচার করতে চান জগৎসংসারকে। কামধেনুর বিনিময় মূল্য হিসেবে প্রলোভনের তালিকা দীর্ঘ হতে লাগল ক্রমশ। তিনি তপোবনবাসী, ব্রহ্মতেজে বলীয়ান বশিষ্ঠকে এবার স্বর্ণময় কণ্ঠহারে, অলঙ্কারে ভূষিত চোদ্দ হাজার গজশ্রেষ্ঠ, উত্তমগুণযুক্ত এগার হাজার ঘোড়া, নানা রঙের অল্পবয়স্ক এক কোটি গাভী দিতে চাইলেন শবলার বিনিময়ে। বশিষ্ঠ তাতেও সম্মত হলেন না। বললেন, “এই শবলাই আমার রত্ন, ধনসম্পদ যা-কিছু সব। এর থেকেই আমার আশ্রমের পরিপুষ্টি, অন্ন-পানের সংস্থান। আমার সমস্ত ক্রিয়া অনুষ্ঠানের মূল এই গাভী। এ হল আমার জীবনস্বরূপ। একে কোনও কিছুর বিনিময়েই আমি দিতে পারব না।”
বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয়বীর। পার্থিব সম্পদের মূল্য দিয়ে বিচার করতে চান জগৎসংসারকে। কামধেনুর বিনিময় মূল্য হিসেবে প্রলোভনের তালিকা দীর্ঘ হতে লাগল ক্রমশ। তিনি তপোবনবাসী, ব্রহ্মতেজে বলীয়ান বশিষ্ঠকে এবার স্বর্ণময় কণ্ঠহারে, অলঙ্কারে ভূষিত চোদ্দ হাজার গজশ্রেষ্ঠ, উত্তমগুণযুক্ত এগার হাজার ঘোড়া, নানা রঙের অল্পবয়স্ক এক কোটি গাভী দিতে চাইলেন শবলার বিনিময়ে। বশিষ্ঠ তাতেও সম্মত হলেন না। বললেন, “এই শবলাই আমার রত্ন, ধনসম্পদ যা-কিছু সব। এর থেকেই আমার আশ্রমের পরিপুষ্টি, অন্ন-পানের সংস্থান। আমার সমস্ত ক্রিয়া অনুষ্ঠানের মূল এই গাভী। এ হল আমার জীবনস্বরূপ। একে কোনও কিছুর বিনিময়েই আমি দিতে পারব না।”
এতক্ষণের যত প্রীতিভাবনা, পারস্পরিক কুশল চিন্তা — সবই যেন এক লহমায় হারিয়ে গেল। ক্ষাত্রবাসনার উদগ্র বহিঃপ্রকাশে দ্বন্দ্ব আর বিদ্বেষের আবহ ঘনিয়ে এল ক্রমশ। বিশ্বামিত্র জোর করে হরণ করে নিতে চাইলেন কামধেনুটিকে। যে গাভীর দেওয়া খাদ্য-পানীয়ে কিছুক্ষণ আগেই উদরপূর্তি করেছে তারা, তাকেই এখন নিষ্ঠুরভাবে টানতে টানতে নিয়ে চলল রাজভৃত্যের দল। শবলা শোকে দুঃখে কাতর হয়ে ভাবতে লাগল নিজের দুর্ভাগ্যের কথা। ভাবতে ভাবতে মনে জোর এল তার। শত সহস্র রাজভৃত্যের বাধা সরিয়ে সে দ্রুতবেগে ছুটে এল বশিষ্ঠের কাছে। এসে পায়ের কাছে লুটিয়ে কাঁদতে লাগল। অসহায় ভাবে জানতে চাইল সে ঋষির কাছে, কেন এভাবে রাজার সৈন্যরা তাকে নিয়ে চলেছে? কেনই বা তিনি বাধা দিচ্ছেন না রাজার এ কাজে?
বশিষ্ঠ বললেন, ক্ষাত্রতেজে উন্মত্ত এই রাজা জোর করে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন তাকে। কারণ, তপস্যারত শান্তিপ্রিয় ব্রাহ্মণের চেয়ে সসাগরা পৃথিবীর অধিপতি ক্ষত্রিয় রাজার বাহুবল অনেক বেশি। অস্ত্রবল আর সৈন্যদলে সজ্জিত হয়ে বলদর্পে পৃথিবী শাসন করতে চান তাঁরা। শবলা সাধারণ গাভী মাত্র নয়। বাক্যার্থজ্ঞানে সুনিপুণ সে। এবার বশিষ্ঠকে সবিনয়ে সে জানাল, “বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় বীর, মহাতেজস্বী, পরাক্রমশালী রাজা। তাঁর ক্ষমতা অনেক। কিন্তু আপনি ব্রহ্মতেজে বলীয়ান। সে তেজ যে ক্ষাত্রশক্তির চাইতে অনেক বেশি। আপনি এই দুর্বিনীত, বলশালী রাজার বল আর দর্প দুইই বিনাশ করুন।”
বশিষ্ঠ তখন স্বীয় তেজঃশক্তিতে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলেন যেন। বিশ্বামিত্রকে দমন করার জন্য শত্রুসংহারক সৈন্যদল সৃষ্টির আদেশ দিলেন শবলাকে। শান্ত, সমাহিত তপোভূমি মুহূর্তে পরিণত হল রণভূমিতে। শবলার হাম্বারবে সৃষ্টি হল শত শত পহ্লব সৈন্য। তারা সবেগে বিনাশ করল বিশ্বামিত্রের সৈন্যদের। সে দৃশ্য দেখে বিশ্বামিত্র নিজেই নানা অস্ত্রে পহ্লব সৈন্যদের নাশ করলেন। শবলা আবার সৃষ্টি করল শক ও যবন সৈন্য। কিন্তু তারাও বিশ্বামিত্রের অস্ত্রে ভূতলশায়ী হল। এবার শবলার দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে সৃষ্টি হল অস্ত্রধারী নানা ধরনের দুর্ধর্ষ সৈনিকদের। তারা বিশ্বামিত্রের চতুরঙ্গ বাহিনীকে একেবারে নিঃশেষ করে ফেলল। এ দৃশ্য দেখে বিশ্বামিত্রের শত পুত্র ক্রুদ্ধ হয়ে ছুটে এল মহর্ষি বশিষ্ঠের দিকে। বশিষ্ঠ এক হুঙ্কারে ভস্ম করলেন তাদের।
এবার রাজা বিশ্বামিত্র যেন ভগ্নদন্ত সর্প, রাহুগ্রস্ত সূর্য। তাঁর সমস্ত শক্তি, দম্ভ, অহমিকা চূর্ণ, ভস্মীভূত। পাখা ছিঁড়ে যাওয়া পাখির মতো তিনি আজ শক্তিহীন। পুত্র, সৈন্য সব কিছু হারিয়ে হীনবল রাজা গভীর বৈরাগ্য লাভ করলেন। উপলব্ধি করলেন ক্ষাত্রশক্তির ন্যূনতা। বাহুবল, অস্ত্রবল সব কিছুর অসারতা অনুভব করলেন মুহূর্তে। জেগে উঠল তাঁর বৈরাগ্যবোধ। রাজ্যরক্ষার ভার একমাত্র জীবিত পুত্রকে দিয়ে ত্যাগ করলেন রাজ্য। ক্ষত্রিয়ের রাজবেশ ছেড়ে এবার বল্কলবাস ধারণ করে পৃথিবীপতি চললেন হিমালয়ের কোলে, নির্জন অরণ্যদেশে। কঠোর তপস্যায় মগ্ন হলেন সেখানে। তপস্যা কী নিয়ে এল সংযম? হল কি বাসনার অবসান? সে আখ্যান শোনা যাবে আর একদিন। সে হল বিশ্বামিত্রের ব্রহ্মতেজে বলীয়ান হয়ে ঋষিত্ব অর্জনের কাহিনি।—চলবে
বশিষ্ঠ বললেন, ক্ষাত্রতেজে উন্মত্ত এই রাজা জোর করে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন তাকে। কারণ, তপস্যারত শান্তিপ্রিয় ব্রাহ্মণের চেয়ে সসাগরা পৃথিবীর অধিপতি ক্ষত্রিয় রাজার বাহুবল অনেক বেশি। অস্ত্রবল আর সৈন্যদলে সজ্জিত হয়ে বলদর্পে পৃথিবী শাসন করতে চান তাঁরা। শবলা সাধারণ গাভী মাত্র নয়। বাক্যার্থজ্ঞানে সুনিপুণ সে। এবার বশিষ্ঠকে সবিনয়ে সে জানাল, “বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় বীর, মহাতেজস্বী, পরাক্রমশালী রাজা। তাঁর ক্ষমতা অনেক। কিন্তু আপনি ব্রহ্মতেজে বলীয়ান। সে তেজ যে ক্ষাত্রশক্তির চাইতে অনেক বেশি। আপনি এই দুর্বিনীত, বলশালী রাজার বল আর দর্প দুইই বিনাশ করুন।”
বশিষ্ঠ তখন স্বীয় তেজঃশক্তিতে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলেন যেন। বিশ্বামিত্রকে দমন করার জন্য শত্রুসংহারক সৈন্যদল সৃষ্টির আদেশ দিলেন শবলাকে। শান্ত, সমাহিত তপোভূমি মুহূর্তে পরিণত হল রণভূমিতে। শবলার হাম্বারবে সৃষ্টি হল শত শত পহ্লব সৈন্য। তারা সবেগে বিনাশ করল বিশ্বামিত্রের সৈন্যদের। সে দৃশ্য দেখে বিশ্বামিত্র নিজেই নানা অস্ত্রে পহ্লব সৈন্যদের নাশ করলেন। শবলা আবার সৃষ্টি করল শক ও যবন সৈন্য। কিন্তু তারাও বিশ্বামিত্রের অস্ত্রে ভূতলশায়ী হল। এবার শবলার দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে সৃষ্টি হল অস্ত্রধারী নানা ধরনের দুর্ধর্ষ সৈনিকদের। তারা বিশ্বামিত্রের চতুরঙ্গ বাহিনীকে একেবারে নিঃশেষ করে ফেলল। এ দৃশ্য দেখে বিশ্বামিত্রের শত পুত্র ক্রুদ্ধ হয়ে ছুটে এল মহর্ষি বশিষ্ঠের দিকে। বশিষ্ঠ এক হুঙ্কারে ভস্ম করলেন তাদের।
এবার রাজা বিশ্বামিত্র যেন ভগ্নদন্ত সর্প, রাহুগ্রস্ত সূর্য। তাঁর সমস্ত শক্তি, দম্ভ, অহমিকা চূর্ণ, ভস্মীভূত। পাখা ছিঁড়ে যাওয়া পাখির মতো তিনি আজ শক্তিহীন। পুত্র, সৈন্য সব কিছু হারিয়ে হীনবল রাজা গভীর বৈরাগ্য লাভ করলেন। উপলব্ধি করলেন ক্ষাত্রশক্তির ন্যূনতা। বাহুবল, অস্ত্রবল সব কিছুর অসারতা অনুভব করলেন মুহূর্তে। জেগে উঠল তাঁর বৈরাগ্যবোধ। রাজ্যরক্ষার ভার একমাত্র জীবিত পুত্রকে দিয়ে ত্যাগ করলেন রাজ্য। ক্ষত্রিয়ের রাজবেশ ছেড়ে এবার বল্কলবাস ধারণ করে পৃথিবীপতি চললেন হিমালয়ের কোলে, নির্জন অরণ্যদেশে। কঠোর তপস্যায় মগ্ন হলেন সেখানে। তপস্যা কী নিয়ে এল সংযম? হল কি বাসনার অবসান? সে আখ্যান শোনা যাবে আর একদিন। সে হল বিশ্বামিত্রের ব্রহ্মতেজে বলীয়ান হয়ে ঋষিত্ব অর্জনের কাহিনি।—চলবে
*শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।