সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

যশোর শহর থেকে ন্যাশনাল হাইওয়েতে পড়ামাত্রই আমাদের সেমি-লাক্সারি বাসের গতি বাড়ল৷ যশোর থেকে মাগুরা হয়ে ফরিদপুর শহরে পৌঁছতে মোটামুটি আড়াই ঘণ্টা৷ লিমিটেড স্টপেজ৷ ভাড়া প্রায় পৌনে দুশো টাকা৷ খোলা জানালা দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের হাওয়া মন্দ লাগছিল না৷ আমার পাশে দু’জন ভদ্রমহিলা৷
একজন বোরখা পরা৷ তবে মুখ ঢাকা নয়৷ তাঁর পাশে এক হিন্দু গৃহবধূ৷ পরনে ঢাকাই শাড়ি৷ কপালে বড় সিঁদুরের টিপ৷ সিঁথিতেও চওড়া সিঁদুর৷ মুখখানি ঢলঢল করছে৷ লাবণ্যচঞ্চল দু’চোখ৷ হাসলে টোল পড়ে৷
দেখে মনে হয়, দু’জনের কারও বয়সই বাইশ-চব্বিশের বেশি নয়৷ আমার অনুমান সঠিক৷ আলাপ হওয়ায় জানতে পারলাম ওরা দুই বন্ধু৷ যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী৷ হস্টেলে থাকে৷ ওরা রুমমেটও বটে৷

মুসলমান মেয়েটির নাম মাসুদা ইয়াসমিন৷ মাগুরায় বাড়ি৷ এখনও বিয়ে করেনি৷ আর লাবণি দত্তের বিয়ে হয়েছে মাত্র মাসখানেক৷ বিয়ের পর এখন পদবি শিকদার৷ মাগুরায় লাবণির শ্বশুরবাড়ি৷ ওর পৈতৃক বাড়ি সাতক্ষীরা ও খুলনার মাঝামাঝি এক জায়গায়৷ স্বামী বিধান শিকদার ব্যাঙ্ককর্মী৷ চাকরির সূত্রে এখন ঢাকায় পোস্টিং৷ ওদের ‘তুমি’ করেই সম্বোধন করলাম৷

লাবণিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম—এই যে বিয়ের পরপরই তোমরা স্বামী-স্ত্রী আলাদা জায়গায় থাকছ, তোমার মন খারাপ করে না? লাবণি খিলখিল করে হেসে উঠল৷ ভেবেছিলাম, আমার কথা শুনে ওর মন খারাপ হবে৷ হাসতে হাসতেই বলল, ‘আমাদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং খুব ভালো৷ মাঝে মাঝে একটু মন খারাপ হইলেও পড়ালিখার কথা ভাইব্যা নিজেরে মানায় লই৷ আর মোবাইল ফোন তো কাছে আছেই৷ ওর বা আমার মন খারাপ হইলেই পরস্পরের লগে কথা কই৷’
লাবণির শ্বশুরবাড়ির লোকজন তো ঢালাও অনুমতি দিয়ে রেখেছেন বাড়ির বউ যতদূর ইচ্ছা পড়াশুনো করবে৷ মাসুদা ইয়াসমিনও গল্প করতে পারে৷ জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তো মহিলা৷ বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া৷ এমনকী পার্লামেন্টের স্পিকারও এক মহিলা৷ তোমার সম্প্রদায়ের মেয়েরা নিশ্চয়ই যথেষ্ট স্বাধীনতা উপভোগ করেন?’

মাসুদা মুহূর্তের মধ্যে গম্ভীর হয়ে গেল৷ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘স্যার, এইসব দেইখ্যা ভাইব্বেন না যে আমাগো দ্যাশের মুসলিম মাইয়ারা খুব ভালো আছে৷ মাইয়াদের কোনো স্বাধীনতা নাই৷ আজও মুসলিম মাইয়ারা সামাজিক বঞ্চনার শিকার৷ পুরুষরা তো আমাগো মানুষ বইল্যাই মনে করে না৷’
মাসুদা বলল, ‘ইন্ডিয়ার মাইয়াদের অনেক বেশি স্বাধীনতা শুনছি৷ এটা খুবই আশার কথা৷’ সেই মুহূর্তে মুখে হয়তো বলিনি, তবে মনে মনে ভেবেছি, আমাদের দেশের মেয়েরাও কি খুব ভালো আছে? সুখে আছে? ধর্ষণ, সামাজিক অবহেলা তো আজও কমেনি৷

মাসুদা এবং লাবণি দু’জনেই বাংলা সিরিয়ালের ভক্ত৷ সিরিয়ালও দেখে৷ বাংলা ও হিন্দি সিনেমাও ওদের বড্ড প্রিয়৷ প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ডিস অ্যান্টেনা৷ ভারতের একগুচ্ছ বাংলা ও হিন্দি টিভি চ্যানেল এখন সকলের হাতের নাগালে৷ টিভির হিন্দি সিনেমার দাপটে বাংলাদেশের সিনেমা আরও কোনঠাসা৷ মাসুদার প্রিয় নায়ক অমিতাভ বচ্চন এবং মিঠুন চক্রবর্তী৷ লাবণির আবার আমির খানকেই বেশি পছন্দ৷ ওদের সঙ্গে গল্প করে সময় ভালোই কাটছিল৷

হাইওয়ের বিশেষ বিশেষ মোড়ে বেশ কিছুক্ষণ পর বাস দাঁড়াচ্ছিল৷ যাত্রীরা ওঠানামা করছেন৷ এই মোড়গুলোয় বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার পোস্টার ও ব্যানারে ছয়লাপ৷ কেউ সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে জনসাধারণের উদ্দেশে উষ্ণ অভিনন্দন ও প্রাণঢালা ভালোবাসা বিলোচ্ছেন৷ আবার কারও প্রকৃত শক্তি যে গ্রামের গরিব মানুষরাই, সেকথা জননেতার মধুর বাণীতে প্রতিফলিত৷ তবে কোনো হিন্দু রাজনৈতিক নেতার একটা পোস্টার কিংবা ব্যানারও আমার চোখে পড়েনি৷ যেতে যেতে হঠাৎ সশব্দে বাসের টায়ার ফাটার আওয়াজ৷ স্টেপনি লাগাতে মিনিট কুড়ি৷

লাবণি ও মাসুদা মাগুরায় নামল৷ যাওয়ার আগে দু’জনেই আমাকে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে যেন বোনের অধিকার নিয়েই বলল, ‘আপনি সাবধানে থাকবেন৷ এমনি আমাগো দ্যাশ নিরাপদ৷ ভয়ের কিছু নাই৷ আপনার বাংলাদেশ ভ্রমণ সফল হোক৷’ বললাম, ‘তোমাদের সঙ্গে হয়তো আর কোনোদিন দেখা হবে না৷ তোমরা পড়াশুনো করে আরও বড় হও৷’—চলবে

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content