সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


রবি ঘোষ ও তপেন চট্টোপাধ্যায়

বাঘা দা মানে রবিদা অর্থাৎ রবি ঘোষের সঙ্গে আমার আগে থেকেই পরিচয় ছিল, যখন আমি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাটক দেখতে যেতাম। নাটক দেখার আগে বা পরে সৌমিত্রদার সঙ্গে দেখা করবার সময় রবিদার সঙ্গেও সৌজন্য বিনিময় হতো, দু-একবার টুকটাক কথাও হয়েছে। তবে ঘনিষ্ঠতা বলতে যা বোঝায়, সেরকম কিছু তখনও গড়ে ওঠেনি। একটি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ম্যাগাজিনে আমি তখন নিয়মিত লিখছি। চিত্রতারকার দাঁত বলে একটি সরস ডাক্তারি প্রবন্ধ সেখানে লিখেছিলাম একবার। পরে যখন দে’জ পাবলিশিং প্রকাশিত বইয়ে সেটি সংকলিত হল, তখন আমি ভাবলাম, সঙ্গে রবি ঘোষের একটি সহাস্য ফটো দিলে কেমন হয়! কিন্তু দেওয়ার আগে তো তাঁর একটা অনুমতি নেওয়া দরকার। এটা ভাবতে ভাবতেই মনে হল, অনুমতি নিতে যখন যাবই, তাঁকে অনুরোধ করব আমার বইটির একটি ভূমিকা লিখে দেওয়ার জন্য। যেমন ভাবা তেমন কাজ। একদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই গিয়ে হাজির হলাম উত্তম মঞ্চে। তখন উনি ওখানে কি একটি নাটক করছিলেন। পরিচয় দেওয়াতে চিনতে পারলেন, আমার আবদার শুনলেন এবং ফোন নম্বর দিয়ে বললেন, ফোন করে পরের সপ্তাহে আসতে। আমার দুটি আবদারই উনি রেখেছিলেন। তাঁর একটি ফটো আমাকে দিয়েছিলেন এবং নতুন বইয়ের জন্য ছোট্ট একটি ভূমিকাও লিখে দিয়েছিলেন।

রবিদাকে নিয়ে আরেকটা ঘটনার কথা বলি। তখন আমি ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে কর্মরত। সালটা ১৯৮৫-৮৬। হাসপাতালের সাহায্যার্থে শিশির মঞ্চে অনেক শিল্পীকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করেছিলাম। এই অনুষ্ঠানে প্রথম জনসমক্ষে হারমোনিয়াম বাজিয়ে মঞ্চে গান গেয়েছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক আমার সাহিত্যগুরু সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। এই অনুষ্ঠানে রবি ঘোষকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম এবং উনি এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। তার কারণ, এই হাসপাতালের কর্ণধার ডাঃ সরোজ গুপ্তকে রবিদা দেবতার মতো শ্রদ্ধা করতেন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র, অভিনেতা শেখর চট্টোপাধ্যায়, নাট্য ব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী, আবৃত্তিকার নীলাদ্রি শেখর বসু, সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ-সহ বহু গুণীজন এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন।

গান গাইছেন রবি ঘোষ।

অনুষ্ঠানের প্রথমার্ধে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের গল্প ক্যানসার অবলম্বনে চিত্র পরিচালক অমল সুর একটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। সাধারণ দর্শকের সঙ্গে আমন্ত্রিত বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরাও এই নাটকটি দেখছিলেন। কিন্তু মঞ্চে অশ্লীলতা দেখানো হচ্ছে, এই অভিযোগ তুলে কিছু দর্শক চেঁচামেচি শুরু করায় নাটকটি আমরা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। পর্দা ফেলে দেওয়া হয়। প্রেক্ষাগৃহে তখন চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা অবস্থা। আমরা কী করব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এমন সময় রবিদা আমাকে বলেন, পর্দা খুলে দাও, আমি মঞ্চে পারফর্ম করবো। আমি বললাম, দাদা দর্শক তো এখনও শান্ত হয়নি, আরেকটু অপেক্ষা করব? উনি বললেন, একদম নয়, এরপর পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে, তুমি এক্ষুনি পর্দা খুলতে বলো। পর্দা উঠলো। রবিদা ভোলা দত্তকে নিয়ে হাস্যকৌতুক পরিবেশন করতে শুরু করলেন। ৫ মিনিটের মধ্যে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ শান্ত হয়ে গেল। এমনই ছিল মঞ্চে কিংবা পর্দায়, রবি ঘোষের উপস্থিতির মোহিনী শক্তি। আজ রবি ঘোষ আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু সেদিন যে ঝামেলা থেকে তিনি আমাদের বাঁচিয়েছিলেন, সে কথা আমি আমৃত্যু মনে রাখবো।

আবার দূরদর্শনের কথায় ফিরি। আগেই বলেছিলাম, সেখানে ‘চেনা মুখ অচেনা মানুষ’ বলে একটি সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে আমি সৌমিত্র-সুপ্রিয়াকে নিয়ে অনুষ্ঠান করেছিলাম। এবার ভাবলাম যদি গুপি-বাঘা অর্থাৎ রবি ঘোষ এবং তপেন চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে করা যায়।

রবিদার ফ্ল্যাটের ড্রইং রুমে।

তখনও আমি তপেনদা-কে শুধু গুপি গায়েন হিসেবেই চিনি। আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনও পরিচয় হয়নি। মুশকিল আসানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন আমাদের রবিদা। একদিন গলফ গ্রিনের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে তো রাজি করালামই, ওই বাড়িতে আমরা শ্যুটিং করব সেই অনুমতিও আদায় করে নিলাম। তারপর তাঁকে দিয়েই টেলিফোন করালাম তপেনদা-কে। এরপর তপেনদা-র আর রাজি না হয়ে কোনও উপায় রইল না।

রবিদার বাড়িতে সকাল থেকেই শ্যুটিং শুরু হল। তপেন দা এসেছিলেন সময় মতোই। দূরদর্শনের পক্ষে প্রযোজক ছিলেন পার্থ চক্রবর্তী। স্ক্রিপ্ট করেছিলাম আমিই। স্ক্রিপ্ট পছন্দ হয়েছিল রবিদার। কিন্তু গানে গলা মেলাতে হবে শুনে, একটু কিন্তু কিন্তু করছিলেন। আমি বললাম, আমার স্ত্রী হারমোনিয়াম ধরবেন। ভূতের রাজা দিল বর… এই গানটার কিছুটা গেয়ে দিলেই হবে। তপেনদা বললেন, তুমি না পারলে আমিই গেয়ে দেব। তুমি শুধু এক দুই তিন, এক নম্বর-দুই নম্বর-তিন নম্বর… এই জায়গাগুলো বলবে। রেকর্ডিং-এর সময় রবিদা কিন্তু একদম পারফেক্ট টাইমিংয়ে সুর তাল বজায় রেখেই তার অংশটুকু গেয়ে দিলেন। একটা মজার কথা এই সময় বলেছিলেন উনি। অনুপ ঘোষালের কণ্ঠে এই গানটি রেকর্ডিং হয়েছিল এইচএমভি-তে। রবিদা তাঁর জায়গাগুলো শুধু গেয়ে দিয়েছিলেন। রেকর্ডিং-এর দুই-এক সপ্তাহ বাদে রবিদার নামে একটি চেক তাঁর বাড়ির ঠিকানায় এলো। আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন তিনি এই ভেবে যে গায়ক না হয়েও গান গাইবার জন্য চেক পাওয়া যায়, টাকা রোজগার করা যায়! অবশ্য কথাগুলো বলেই রবি দা কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, এ সবই সম্ভব হয়েছিল মানিকদার জন্য, উনিই তো আমাকে দিয়ে ওই জায়গাগুলো গাইয়ে নিয়েছিলেন।

স্কেচ করছেন রবি ঘোষ।

রবিদার ফ্ল্যাটের ড্রইংরুমে যেখানে শুটিং করেছিলাম আমরা, সেখানে দেওয়াল জোড়া চার্লি চ্যাপলিনের একটি ঢাউস ফটো ছিল। চ্যাপলিনকেই অভিনয়ের গুরু বলে মানতেন তিনি। যদিও মঞ্চে তাঁর প্রত্যক্ষ গুরু ছিলেন উৎপল দত্ত। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিয়মিত পড়াশোনা করতেন উনি। ড্রয়িং রুমের বুক সেলফে সাজানো ছিল অনেক বই। এই অনুষ্ঠানে গুপী বাঘা সিরিজের ছবিগুলো নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন রবিদা। বলেছিলেন তাঁর প্রিয় মানিকদাকে নিয়ে বেশ কিছু মজার গল্পও। রবিদার স্ত্রী বৈশাখী বৌদির কাছে একটি গোপন তথ্য পেয়েছিলাম, রবিদা নাকি ভালো পেন্সিল স্কেচ করেন! চেপে ধরতেই প্রথমে না-না করলেন। তপেনদা আর বৌদি মিলে তাঁকে রাজি করালেন। একটি প্যাডের পাতায় ডট পেন দিয়ে দারুণ একটি ছবি আঁকলেন। যেটি টিভির পর্দায় এই অনুষ্ঠানে দেখানো হয়েছিল। রেকর্ডিং শেষে সেই ছবির নীচে আমার এবং আমার স্ত্রীর নাম লিখে, আমাদের সেটি উনি প্রেজেন্টও করেছিলেন। আমার কাছে আজও সেই পাতাটি রাখা আছে, যার ফটো এই লেখার সঙ্গে দিলাম। আরেকটা ঘটনার কথা মনে আছে। শ্যুটিং-এর বিরতিতে রবিদা নিজের হাতে আমাদের শ্যুটিং ইউনিটের সবার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়েছিলেন। সঙ্গে নানা ধরনের মুখরোচক স্ন্যাক্স তো ছিলই, যেটি বৌদি বাড়িতেই বানিয়েছিলেন।

উপহার পাওয়া সেই অমূল্য সম্পদ।

তপেনদাও ভারী মজার মানুষ ছিলেন। বিজ্ঞাপন অফিসে কাজ করতেন। সত্যজিৎ রায় সম্পাদিত তৎকালীন সন্দেশ পত্রিকাতেও ইলাস্ট্রেশনের কাজ করেছেন। টুকটাক অভিনয়ও করতেন। সত্যজিৎ রায় অনেক আগে থেকেই তাঁকে চিনতেন। এই গুপী গাইন রোলটির জন্য প্রথম নাকি ভাবা হয়েছিল কিশোর কুমারের নাম! শেষ পর্যন্ত তপেনদার কপালেই শিকে ছেঁড়ে। শ্যুটিং শেষ হওয়ার পর তপেনদাকে আমার নিজস্ব গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দেবার কথা ছিল। কিন্তু ক’দিন ধরেই আমার গাড়ির স্টার্ট মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। গ্যারেজে নিয়ে গিয়ে যে দেখাবো, সেই সময়ও করে উঠতে পারিনি। ভয়ে ভয়ে এই কথাগুলো তপেনদাকে নিবেদন করলাম। উনি খুব ক্যাজুয়ালি বললেন, ‘ওসব নিয়ে টেনশনের কিছু নেই। যদি স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়, আমরা ঠেলে স্টার্ট করে দেবো।’ তপেনদাকে নিয়ে আতঙ্কের সঙ্গেই যাত্রা শুরু হল। সম্ভবত তাঁর বাড়ি ছিল ব্রহ্মপুরে অর্থাৎ গড়িয়ার দিকে। আমার ড্রাইভারকে বলেছিলাম কোনও অবস্থায় স্টার্ট বন্ধ না করতে। কিন্তু গড়িয়া মোড়ের কিছুটা আগে হঠাৎ এক সিগন্যালে ও ভুল করে স্টার্ট বন্ধ করে দেয় এবং যথারীতি গাড়ি আর স্টার্ট নিতে চায় না। মহা ফ্যাসাদে পড়লাম। তপেনদা গাড়ি থেকে নেমে মহা উৎসাহে গাড়ি ঠেলতে শুরু করে দিল। ট্রাফিক পুলিশ এবং দু’ চারজন পথচারী তাঁকে চিনতে পেরে তাঁরাও হাত লাগালেন এবং আশ্চর্য ব্যাপার হল মিনিট কয়েকের মধ্যে গাড়ি হঠাৎ স্টার্টও নিল। এবার সোজা তপেনদা-র বাড়ি। বাড়ি পৌঁছে তপেনদা গাড়ি থেকে নেমে আমাকে বললেন, ‘তুমি প্রথম আমার বাড়িতে এলে, আমার উচিত তোমাকে অন্তত এক কাপ চা খাওয়ান। কিন্তু আমি সেই রিস্ক নিতে পারছি না, যদি আবার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। এটা ডিউ রইল। তুমি কথা দাও, অন্য একদিন আসবে। আমার এখানে এসে লাঞ্চ বা ডিনার করবে।’ আমি কথা দিতেই তপনদা বললেন, ‘গাড়ি ঘোরাতে হবে না। সোজা এগিয়ে ডানদিকের গলি দিয়ে ইউ টার্ন করে বেরিয়ে যাও। আর বাড়ি পৌঁছে একটা ফোন করো। ‘সেদিন সত্যিই আর গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়নি। একদমেই ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছতে পেরেছিলাম। যথারীতি তপেনদাকে ফোন করে জানিয়েওছিলাম। এরপর অনেকবারই তপেনদার সঙ্গে কথা হয়েছে। টেলিকাস্ট ডেট তাঁকে জানিয়েছিলাম। উনি রিপিট টেলিকাস্ট দেখেছিলেন এবং ফোন করে তাঁর ভালোলাগার কথা আমাকে জানিয়েও ছিলেন।

আজ আর সেই গুপিও নেই, বাঘাও নেই। কিন্তু এই মজার মজার ঘটনাগুলো আমার স্মৃতির ফ্রেমে বন্দী হয়ে রয়েছে গত ৩২ বছর ধরে, আমৃত্যু থাকবেও। মাঝে মাঝে অ্যালবাম উল্টে শুটিংয়ের ছবিগুলো দেখি। অনেক কথাই মনে পড়ে যায়। একটু বোধহয় নস্টালজিকও হয়ে পড়ি।

ছবি: লেখক

Skip to content