শ্রীশ্রীযশোরেশ্বরী দেবী
বাংলাদেশে আমার যাওয়ার ইচ্ছা অনেকদিনের৷ বাংলাদেশ ভ্রমণের স্বপ্নই দেখতাম বটে! স্বচক্ষে দেখে আসব কেমন রয়েছে মন্দিরসহ বিভিন্ন হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান৷ আরও দুই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের উপাসনার জায়গাগুলোর অবস্থাই বা কেমন! বাংলাদেশের বিভিন্ন মসজিদের নির্মাণশৈলীর সরাসরি অভিজ্ঞতালাভও বা কম কীসে৷ আমার পিতা-পিতামহের দেশ সোনার বাংলার খোলা আকাশ দেখে আর মৃদুমন্দ বাতাসে বুকভরা নিঃশ্বাস নিয়ে প্রাণ জুড়াব৷ আমিও গুনগুনিয়ে বলব—আমারও সোনার বাংলা তুমি৷ তোমাকে আমিও যে ভালোবাসি!
সেই সুযোগও একদিন এসে গেল৷ বাংলাদেশের ভিসা পেতেও অসুবিধা হয়নি৷ জার্নালিস্ট ভিসা৷ সঙ্গে প্রয়োজন মতো বাংলাদেশি টাকা৷ আর পিঠে রুকস্যাক৷ বাংলাদেশের ভিসা-ফি বলে কিছু নেই৷ অর্থাৎ এই ভিসার জন্য আমাদের দেশের কাউকেই পয়সা গুনতে হয় না৷ জার্নালিস্ট ভিসা পাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের কলকাতা ডেপুটি হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি (প্রেস) কাজি মোস্তাক জহিরের সহযোগিতার কথা ভুলব না৷ তবে পরে তিনি ঢাকায় বদলি হয়ে যান৷
লোকাল ট্রেনে বনগাঁ জংশনে পৌঁছলাম সকাল ১১টা নাগাদ৷ স্টেশন থেকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত মোটামুটি ৮ কিমি৷ মসৃণ চওড়া পিচের পথ৷ দু’পাশে বিরাট বিরাট গাছ৷ ইছামতি নদীর ব্রিজ পেরিয়ে অটোরিকশয় আধঘণ্টা হরিদাসপুর (পেট্রাপোল) সীমান্ত৷ তারপর ভারতীয় ইমিগ্রেসনের লাইনে দাঁড়ানো৷ বেশ ভিড়৷ পাসপোর্ট-ভিসা পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া৷ কাস্টমসও করাতে হল৷ সব মিলিয়ে ছাড়পত্র পেতে ঘণ্টাখানেকেরও বেশি৷
এরপর ভারতীয় সীমানার ভেতর দিয়ে মিনিট কয়েক হেঁটে বাংলাদেশের সীমানায় পৌঁছে যাওয়া৷ যশোর রোড এখানেই দু’দেশের মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছে৷ একদিকে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী (বি এস এফ), অন্যদিকে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীরা৷ বাংলাদেশের রক্ষীরা একবার আমার পাসপোর্টে চোখ বুলিয়ে নিলেন ভিসার ছাপ ঠিকমতো আছে কি না৷ একটা ফর্ম ভরতে হল৷ তবে ইমিগ্রেসনে বেশি সময় লাগেনি৷
বাংলাদেশ কাস্টমসের ইউনিফর্ম পরা এক কর্মী আমাকে একটু গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার ব্যাগে কী আছে?’ হাসিমুখে বললাম, ‘খুলেই দেখুন৷’ কর্মীটি এরপর ভালো মানুষের মতো মুখ করে বললেন, ‘আপনি আমাগো মেহেমান৷ দেখা লাগব না৷ আপনি অনায়াসে যাইতে পারেন৷’
বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে আমার দারুণ অনুভূতি হল৷ অবশেষে স্বপ্ণ সফল৷ যশোরের অটোরিকশগুলো ব্যাটারিতে চলে৷ নাম, ইজিট্যাক্সি৷ বায়ুদূষণ হয় না৷ তবে ব্যাটারিতে চার্জ দিতে বিলক্ষণ খরচ৷ এরকম ট্যাক্সিতে মুখোমুখি দু’দিকে বসার জায়গা৷ জনাছয়েক বসতে পারে৷ ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট এরকম বড় বড় শহরের অটোরিকশগুলো গ্যাসে চলে৷ এগুলো সি এন জি নামে পরিচিত৷ ইজিট্যাক্সির গতি কিন্তু সি এন জি থেকে অনেকটাই কম৷ তবে বরিশাল শহরে কিছু কিছু ইজিট্যাক্সিও আমার নজরে পড়েছে৷ এপার বাংলাতেও ইজিট্যাক্সির মতো দেখতে ‘টোটো’-র চল শুরু হয়েছে৷ ইদানীং দক্ষিণেশ্বরসহ কলকাতা শহরের কয়েক জায়গায় এই যাত্রীবাহী যান চোখে পড়ে৷ মফস্বল শহরেও ‘টোটো’ ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে৷
যুবক হায়দর আলির ইজিট্যাক্সিতে উঠেছিলাম৷ ভাড়া ১০ টাকা৷ হায়দর বেশ গল্প করতে পারে৷ বলল, বাংলাদেশের বর্ডার থেকে যশোরের বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছতে মিনিট দশ-পনেরো৷
একফাঁকে কলকাতার অটোচালকদের কথাও জানতে চাইল হায়দর৷ বাংলাদেশের পুলিশের ইউনিফর্মের রং নীল৷ রাস্তার কয়েক জায়গায় পুলিশ দাঁড়িয়ে৷ রাস্তার দু’পাশে নানা ধরনের দোকান৷ মোবাইল স্টোর, মুদি দোকান, মিষ্টির দোকান, চায়ের দোকান কয়েকটা৷ চালু হোটেলও দেখলাম৷
দোকানগুলোর সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা৷ একটা ইংরেজি অক্ষরও খুঁজে পেলাম না৷ আমার অটোতেই বসলেন এক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা৷ মনে হল, একটু আগেই ভারতীয় ইমিগ্রেসনের লাইনে তাঁদের দেখেছি৷ ভদ্রলোকের নাম তপন দাস৷ সঙ্গে তাঁর স্ত্রী৷ সাতক্ষীরায় বাড়ি৷ ভারতে দিন সাতেক কাটিয়ে বাড়ি ফিরছেন৷ স্ত্রীকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ উত্তর ২৪ পরগনার গুমায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে ওঠেন৷
জিজ্ঞাসা করলাম—আমাদের দেশ কেমন লাগল?
তপনবাবু টুকটাক ব্যাবসা করেন৷ জমিজমাও কিছু আছে৷ বললেন, ‘এমনিতে দ্যাশটা যে ভালো তাতে কোনও সন্দেহ নাই৷ আতিথেয়তাও আছে৷ কিন্তু আপনাগো দ্যাশের লোকজন তাদের বেশি বুদ্ধিমান বইল্যা মনে করে৷ আমাদের নীচু নজরে দ্যাখে৷ এইটাই খারাপ লাগে৷’ তবে নানা যুক্তি দিয়ে তপনবাবুর এই ধারণা বদলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম৷
বাসস্ট্যান্ডে নামলাম৷ যশোরের বাস দাঁড়িয়ে৷ প্রায় লাগেজের মতোই বাসের কন্ডাক্টর আমাকে ভিড় বাসে ঠেলে তুলে দিল৷ তবে তার ভেতরে দয়া বলে একটা বস্তু আছে৷ আমাকে জানালার ধারে সিটের ব্যবস্থা করে দিল৷ সস্ত্রীক তপন দাসও একই বাসে উঠলেন৷
এপার বাংলা ওপার বাংলার বিশেষ তফাত নেই৷ একইরকম ঘরবাড়ি, দোকানপাট, রাস্তার ধারে ভিড়ভাট্টা আর বাতাসে ধুলো ওড়ে৷
যশোর শহর পর্যন্ত ভাড়া ৫৫ বাংলাদেশি টাকা৷ বাসে টিকিট দেওয়ার কোনও ব্যাপার নেই৷ যাত্রীদের মুখ চিনে কন্ডাক্টর বেশ মনেও রাখতে পারে দেখলাম৷ আমার কাছে দ্বিতীয়বার ভাড়া চাইতে আসেনি৷ পরে দেখেছি, বাংলাদেশের দূরপাল্লার বাসগুলোতে ভাড়ার পরিবর্তে যাত্রীদের টিকিট দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই৷ কন্ডাক্টরদের স্মরণশক্তি তারিফ করার মতো৷
তবে নামী ট্র্যাভেল কোম্পানিগুলোর রাতের দূরপাল্লার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসগুলোতে মোটা টাকা ভাড়াবাবদ মানি-রিসিট পাওয়া যায়৷ সাধারণত এ ধরনের বাসে অ্যাডভান্স বুকিং করাই ভালো৷ তপনবাবুরা এক জায়গায় নামলেন৷ এখান থেকে ডানদিকে একটা রাস্তা সোজা চলে গিয়েছে সাতক্ষীরার দিকে৷ শারশা যাদবপুর বাজার৷ বাস থেকেই দেখতে পেলাম অমলের মিষ্টির দোকান৷ কাচের শো-কেসে নানা ধরনের মিষ্টি সাজানো৷
চওড়া চমৎকার পথে বেশ জোরেই বাস ছুটছে৷ দু’পাশের বিস্তীর্ণ জমিতে ধান রোয়া হয়েছে৷ যেন চরাচর জুড়ে সবুজ গালিচা পাতা৷ আসগর আলির মুদি দোকানের পাশেই বিপ্লবের চা ও পান-সিগারেটের দোকান৷ যশোর শহরে ঢোকার আগেই ঝিকরগাছা বাসস্ট্যান্ডে যখন ‘মহিল এক্সপ্রেস’ থেকে নামলাম, বাংলাদেশের সময় প্রায় বেলা ৩টে৷
বাসস্ট্যান্ডেই নিরঞ্জন বাগচীর সঙ্গে আলাপ৷ পরনে ধুতি-শার্ট৷ যশোর শহরেই একটি সুকলে শিক্ষকতা করেন৷ বললেন, ‘এইখানেই ইজিট্যাক্সিতে চাপেন৷ যশোর রামকৃষ্ণ মিশনে পৌঁছাইয়া দিব৷ ভাড়া ১০ টাকা৷’
ইজিট্যাক্সিতেই পরিচয় বলরাম সাহার সঙ্গে৷ রামকৃষ্ণ মিশনের কাছেপিঠেই থাকেন৷ কথাবার্তায় বুঝতে অসুবিধা হয় না এখানে রামকৃষ্ণ মিশন হয়েছে বলে তিনি খুশি৷ বললেন, ‘রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন হইবার ফলে স্থানীয় মানুষরা খুব খুশি৷ হিন্দুদের মনে বাড়তি জোর আইছে৷ তাছাড়া গরিব মুসলমানেরাও মিশনের হোমিওপ্যাথিক ডিসপেনসারিতে চিকিৎসার সুযোগ পাইতাছে৷’
রাস্তায় দেখলাম, হাসিখুশি মেয়েরা বইখাতা নিয়ে সুকল থেকে ফিরছে৷ মিনিট দশেকের মধ্যেই মিশনের গেটে পৌঁছলাম৷ পাশে ছোট গেট৷ এই গেট দিয়ে মিশনের ভেতর অনেকটাই দেখা যায়৷ দূরে একটি ছেলে সাইকেলে আসছে৷ ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকলাম৷
ছেলেটি কাছে আসতে বললাম, ‘কলকাতা থেকে আসছি৷ আশ্রমে থাকব৷ সুদেব মহারাজকে একটু খবর দিতে পারো?’ ও সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে সুদেব মহারাজকে খবর দিল৷ ছেলেটির নাম কার্তিক বিশ্বাস৷ বি এস সি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র৷ বাড়ি নড়াইলে৷ আশ্রমের হোস্টেলে থাকে৷
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সুদেব মহারাজ নিজে এসে ছোট গেটটা খুলে দিয়ে স্মিতহেসে বললেন, ‘ভেতরে আসুন৷ দুপুরের খাওয়া নিশ্চয়ই হয়নি৷ বিকেল হতে চলল৷ তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিং হলে চলে আসুন৷ পরে কথা হবে৷’
লাউ দিয়ে মুগডাল৷ আস্ত দুটো সুস্বাদু ফলিমাছ৷ গরম গরম ভাত৷ খিদের মুখে দারুণ লাগল৷ যশোর রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন ২০১২ সালের জুনে তৈরি হয়৷ আগে এই জায়গায় ‘বিবেকানন্দ ভাবপ্রচার পরিষদ’ ছিল৷ কয়েক একর জায়গা নিয়ে আশ্রম৷ এখানকার প্রধান হলেন স্বামী জ্ঞানপ্রকাশানন্দ৷ একসময় ঢাকার রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে থাকতেন৷ তিনি ‘মিন্টু মহারাজ’ নামেই সমধিক পরিচিত৷ সেইসময় তিনি ভারতে ছিলেন৷ অবশ্য আমার আসার কথা আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম৷ ২৮/৩০ জন বি এ, বি এস সি, এম এ পাঠরত হিন্দু ছেলে এই আশ্রমে থাকে৷ সিট-রেন্ট মাথাপিছু শ’চারেক টাকা৷ দু’বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা ছেলেদেরই করতে হয়৷
লম্বা দোতলা বিল্ডিং৷ একতলা ও দোতলা মিলিয়ে অনেকগুলো ঘর৷ নাম, ‘ব্রহ্মানন্দ ভবন৷’ অতিথিরা এখানেই থাকেন৷ আমারও থাকবার ব্যবস্থা এখানে৷ ব্রহ্মানন্দ ভবনের দু’পাশে একদিকে বিবেকানন্দ দাতব্য চিকিৎসালয় ও অন্যদিকে বিবেকানন্দ পাঠাগার৷ সন্ধ্যায় শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরে আরতি দেখার পর সুদেব মহারাজের একতলার অফিসে আলাপ হল, আশ্রমেরই এক ভক্ত ভবতোষ ঘোষ এবং তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী লিলি ঘোষের সঙ্গে৷
লিলিদেবী বললেন, ‘আশ্রমের পিছনেই আমার বাড়ি৷ বিয়ের পর গত পঁয়ত্রিশটা বচ্ছর তো এখানেই৷ আমার তো দুই পোলা৷ ছোটটা প্রায়ই কয়, মা কলকাতার আশপাশে একটু জমি অন্তত কিনা রাখো৷ অনেকবার কিনবার কথাও ভাবছি৷ শেষপর্যন্ত কিনা আর হইল কই! আসলে এদেশ ছাইড়া যাইতে আর ইচ্ছা করে না৷ আমাদের যশোর প্রধানত হিন্দু অঞ্চল৷’
যে বেজপাড়ায় যশোর রামকৃষ্ণ মিশন, সেখানে শতকরা ৩০ ভাগ হিন্দু৷ শ্রীমতী ঘোষ বলেন, ‘ইন্ডিয়ায় আমার আত্মীয়-পরিজনরা জিজ্ঞাসা করেন—বাড়িতে শাঁখ বাজাইতে পারি কি না৷ এটা কোনো সমস্যাই না৷ উলুধ্বনি, ঘণ্টাধ্বনি, শাঁখ বাজান সবকিছুই আমরা করতে পারি৷ শহরে অসুবিধা নাই৷ হিন্দু মাইয়ারা রাস্তাঘাটে স্বাধীনভাবে চলাফিরা করে৷ কিন্তু গ্রামাঞ্চলে হিন্দু মাইয়াদের আজও নানান সমস্যায় পড়তে হয়৷’ লিলি ঘোষের কথাবার্তায় খুব একটা বাংলাদেশি টান নেই৷
সুকোমল চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার আলাপ যশোর রামকৃষ্ণ মিশনেই৷ বাড়ি বেজপাড়ায়৷ একসময় যশোর শহরে ওষুধের দোকান ছিল তাঁর৷ রামকৃষ্ণ মিশনে নিয়মিত যাতায়াত করেন৷ দুই ছেলে৷ বড় ছেলে ঢাকায় মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার৷ ছোট ছেলে নওগাঁয় ব্যাংকের অফিসার৷
১৯৪৫ সালে ময়মনসিংহে জন্ম সুকোমলবাবুর৷ তখন বছর চারেক বয়স তাঁর৷ ভাগ্যসন্ধানে তিন ছেলে ও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যশোর জেলায় চলে এলেন সুকোমলবাবুর বাবা৷ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরির পর অবশেষে বেজপাড়ায়৷ তখন এই অঞ্চল বন-বাদাড়৷
সুকোমলবাবুর মুখেই শুনলাম, তাঁর মামা ও মাসিরা সেই সময় কলকাতায় চলে যান৷ কাঁকিনাড়ায় মাসি, পাণ্ডুয়ায় মামা৷ আর এক মামা পরে অসমে যান৷ কিন্তু সুকোমলবাবুর বাবা ভারতে যেতে চাননি৷ বলেছিলেন, ‘দরকার হইলে গাছতলায় থাকুম৷ কিন্তু রিফিউজি কার্ড কোনোদিন করুম না৷ ছিলেনও প্রায় সেরকমভাবেই প্রথমদিকে৷
বেজপাড়ায় গাছতলায় একটা কুড়েঘর বানিয়ে সুকোমলবাবুর বাবা বসবাস শুরু করেন৷ মাস্টারি ও যজমানি করে কোনোরকমে সংসার চালাতেন৷ অসীম ধৈর্য আর বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর৷ ইতিমধ্যে সুকোমলবাবুর আরও দুটো বোন হল৷ তাঁর এক ভাই আগেই ভারতে চলে যান৷
এদিকে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠতেই পাকিস্তানি সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ল পূর্ব বাংলার ওপর৷ যশোরেও খুঁজে খুঁজে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করতে লাগল৷ রাজাকারদের হাতে মারা গেলেন সুকোমলবাবুর বাবা৷ স্বামীকে ছেড়ে যেতে চাননি স্ত্রী৷ চোখের সামনে স্বামীর এই করুণ পরিণতি দেখেও এক ফোঁটা চোখের জল ফেলতে পারেননি সুকোমলবাবুর মা৷ কারণ, সেই মুহূর্তে ভদ্রমহিলা নিজেই অর্ধমৃত অবস্থায়৷ তাঁর শরীরে কয়েকবার ছুরি চালিয়েছিল নিষ্ঠুর রাজাকাররা৷
ওই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে এখনও কেঁপে ওঠেন সুকোমলবাবু৷ বললেন, ‘আমার ছোট্ট বোইনটার বয়স তখন মাত্র ৪ বচ্ছর৷ চারপাশে গণ্ডগোলের খবর শুইনা ওকে লইয়া আমাদের বাড়ি হইতে কিছুটা দূরে এক মুসলমান বন্ধুর বাড়িতে রাইখা আসতে গেলাম৷ সেই সময়ই রাজাকাররা বিহারী মুসলমান গুণ্ডাদের লইয়া আমাদের বাড়ি আক্রমণ করে৷ পরে আমারই এক মুসলমান বন্ধু মা-কে তার মা পরিচয় দিয়া হাসপাতালে নিয়া যায়৷ ভাগ্যের জোরে মা ক্রমশ সুস্থ হইয়া ওঠেন৷
আমি, আমার এক ভাই ও বোনেরা হগ্গলে মিলা ভারতে পলাইয়া যাই৷ আসামে থাকতাম৷ ইতিমধ্যে মা-ও কলকাতায় আইয়া পড়লেন৷ মাসে ৩০০ টাকা পাইতাম এক ওষুধের দোকানে কাজ কইরা৷ টাকাটা কলকাতায় পাঠাইতাম৷ মা-কে দেখার লাইগা ছট্ফট্ করতাম৷ কলকাতায় আইলাম, মা আমারে দেইখা কান্না করতে লাগলেন৷ বাবার জন্য খুব কষ্ট হইতাছিল৷ কেন এমন হইল?
কলকাতায় ও অন্যান্য জায়গায় আত্মীয়-স্বজনদের মুখগুলা তো দেখলাম! স্বার্থ আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যই শুধু৷ মন ভাইঙা গেল৷ ফিরা আইলাম আবার নতুন বাংলাদেশে৷ সব মিলাইয়া অখন নিজের ভিটা-মাটিতে মোটামুটি আছি৷’
ভবতোষ ঘোষ সুকোমলবাবুর পাশেই বসেছিলেন৷ ব্যাংকে কাজ করতেন৷ বছর কয়েক হল অবসর নিয়েছেন৷ মাগুড়া জেলায় ২৫ বিঘা ধানিজমি আছে তাঁর৷ এত জমি নিয়মিত দেখাশোনা করাও সম্ভব নয়৷ বেদখল হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে৷ ভবতোষবাবু কিছুটা স্বস্তির সুরে বললেন, ‘সেই সম্ভাবনা কিন্তু উড়াইয়া দেওয়া যায় না৷ এই দ্যাশে যখন তখন যা খুশি হইতে পারে৷ তবে আমার কপাল এখনও ভালাই আছে৷ বেদখল কিছু হয় নাই৷ আবার হইতেও বা কতক্ষণ?’
সুকোমলবাবু ও ভবতোষবাবুর মুখে শুনলাম, শ্রীযুক্ত তারাপদ দাসের কথা৷ তারাপদবাবু যশোর সম্মিলনী সুকলের নামকরা মাস্টারমশাই ছিলেন৷ বাংলা ও ইংরেজি দুটো সাবজেক্টই পড়াতেন৷ বয়স এখন তাঁর আশির ওপর৷ অনেক পাবলিক অনুষ্ঠানেই তারাপদবাবুকে প্রধান অতিথি করে নিয়ে যাওয়া হয়৷ বাংলাদেশের মন্দির সম্বন্ধেও তিনি খোঁজখবর রাখেন৷ তারাপদবাবু রামকৃষ্ণ মিশনের ভক্ত৷
এরকম একজন জ্ঞানীগুণী মানুষের সঙ্গে আমার দেখা করার ইচ্ছা ছিল৷ শেষপর্যন্ত সময়াভাবে তা হয়নি৷
রাতে বাংলাদেশের দু’জন আর্মড পুলিশকে পাহারা দিতে দেখলাম রামকৃষ্ণ মিশনে৷ বাংলাদেশে যতগুলো রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন রয়েছে, সব জায়গায় পুলিশ প্রহরা৷ বড় বড় মন্দিরসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও সরকার থেকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ তবুও হামলার বিপদ শিয়রে শুয়ে থাকে৷
রামকৃষ্ণ মিশন মানেই সুস্বাদু ঘরোয়া খাবারদাবার৷ রাতে সুদেব মহারাজ ও জয় মহারাজের সঙ্গে ডাইনিং হলে খেতে বসলাম৷ গরম গরম ভাতের সঙ্গে সজনে ডাঁটার চচ্চড়ি বড়ই উপাদেয়৷ আর ঘন মুসুরির ডাল৷ রাতেও আস্ত দুটো ফলিমাছের ঝোল৷ এখনও বাংলাদেশের মাছের স্বাদের তুলনা নেই৷
খেতে খেতে সুদেব মহারাজ আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন—আপনি যশোরেশ্বরী মন্দিরে যাবেন না? আমাদের আশ্রম থেকে যশোরেশ্বরী মন্দির কিন্তু অনেকটা পথ৷ সকাল সকাল বেরলে সন্ধ্যায় আবার আশ্রমে ফিরে আসতে পারবেন৷ আসল ব্যাপার হল, কাল মঙ্গলবার৷ শনি-মঙ্গল এ দু’দিনই যশোরেশ্বরী মন্দির খোলা থাকে৷
বললাম, ‘আগামীকালই আমার যাওয়ার ইচ্ছা৷ তবে কাউকে সঙ্গী হিসেবে পেলে ভালো হত৷ অনেকটা পথ তো৷ গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে৷’
এবার সুদেব মহারাজ জয় মহারাজের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি তো এখনও যশোরেশ্বরী মন্দিরে যাননি? যান না মিঃ গুপ্তর সঙ্গে গিয়ে ঘুরে আসুন৷ দু’জনে একসঙ্গে গেলে ভালোই হবে৷’
জয় মহারাজ এককথায় আমার সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে গেলেন৷
ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে আশ্রমের মাঠে সুদেব মহারাজের সঙ্গে গল্প করছিলাম৷ কথাবার্তার মধ্যেই এক যুবক এসে সুদেব মহারাজকে প্রণাম করল৷ যুবকের নাম দীপু কুমার৷ আশ্রমের কাছেই হরিজন পাড়ায় থাকে৷ ধর্ম-সংক্রান্ত বিশেষ কয়েকটা প্রশ্ণ ছিল এই হরিজন যুবকের৷ যশোর কলেজে কমার্স নিয়ে পড়াশুনো করছে৷
সুদেব মহারাজ বললেন, ‘মিঃ গুপ্ত, এবার গিয়ে শুয়ে পড়ুন৷ কাল সকাল সকাল উঠতে হবে৷’ তিনিও একসময় ঢাকা রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে ছিলেন৷ তাঁর সন্ন্যাস নাম স্বামী সদ্বিদ্যানন্দজি৷
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
সৌজন্যে দীপ প্রকাশন
সেই সুযোগও একদিন এসে গেল৷ বাংলাদেশের ভিসা পেতেও অসুবিধা হয়নি৷ জার্নালিস্ট ভিসা৷ সঙ্গে প্রয়োজন মতো বাংলাদেশি টাকা৷ আর পিঠে রুকস্যাক৷ বাংলাদেশের ভিসা-ফি বলে কিছু নেই৷ অর্থাৎ এই ভিসার জন্য আমাদের দেশের কাউকেই পয়সা গুনতে হয় না৷ জার্নালিস্ট ভিসা পাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের কলকাতা ডেপুটি হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি (প্রেস) কাজি মোস্তাক জহিরের সহযোগিতার কথা ভুলব না৷ তবে পরে তিনি ঢাকায় বদলি হয়ে যান৷
লোকাল ট্রেনে বনগাঁ জংশনে পৌঁছলাম সকাল ১১টা নাগাদ৷ স্টেশন থেকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত মোটামুটি ৮ কিমি৷ মসৃণ চওড়া পিচের পথ৷ দু’পাশে বিরাট বিরাট গাছ৷ ইছামতি নদীর ব্রিজ পেরিয়ে অটোরিকশয় আধঘণ্টা হরিদাসপুর (পেট্রাপোল) সীমান্ত৷ তারপর ভারতীয় ইমিগ্রেসনের লাইনে দাঁড়ানো৷ বেশ ভিড়৷ পাসপোর্ট-ভিসা পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া৷ কাস্টমসও করাতে হল৷ সব মিলিয়ে ছাড়পত্র পেতে ঘণ্টাখানেকেরও বেশি৷
এরপর ভারতীয় সীমানার ভেতর দিয়ে মিনিট কয়েক হেঁটে বাংলাদেশের সীমানায় পৌঁছে যাওয়া৷ যশোর রোড এখানেই দু’দেশের মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছে৷ একদিকে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী (বি এস এফ), অন্যদিকে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীরা৷ বাংলাদেশের রক্ষীরা একবার আমার পাসপোর্টে চোখ বুলিয়ে নিলেন ভিসার ছাপ ঠিকমতো আছে কি না৷ একটা ফর্ম ভরতে হল৷ তবে ইমিগ্রেসনে বেশি সময় লাগেনি৷
বাংলাদেশ কাস্টমসের ইউনিফর্ম পরা এক কর্মী আমাকে একটু গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার ব্যাগে কী আছে?’ হাসিমুখে বললাম, ‘খুলেই দেখুন৷’ কর্মীটি এরপর ভালো মানুষের মতো মুখ করে বললেন, ‘আপনি আমাগো মেহেমান৷ দেখা লাগব না৷ আপনি অনায়াসে যাইতে পারেন৷’
বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে আমার দারুণ অনুভূতি হল৷ অবশেষে স্বপ্ণ সফল৷ যশোরের অটোরিকশগুলো ব্যাটারিতে চলে৷ নাম, ইজিট্যাক্সি৷ বায়ুদূষণ হয় না৷ তবে ব্যাটারিতে চার্জ দিতে বিলক্ষণ খরচ৷ এরকম ট্যাক্সিতে মুখোমুখি দু’দিকে বসার জায়গা৷ জনাছয়েক বসতে পারে৷ ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট এরকম বড় বড় শহরের অটোরিকশগুলো গ্যাসে চলে৷ এগুলো সি এন জি নামে পরিচিত৷ ইজিট্যাক্সির গতি কিন্তু সি এন জি থেকে অনেকটাই কম৷ তবে বরিশাল শহরে কিছু কিছু ইজিট্যাক্সিও আমার নজরে পড়েছে৷ এপার বাংলাতেও ইজিট্যাক্সির মতো দেখতে ‘টোটো’-র চল শুরু হয়েছে৷ ইদানীং দক্ষিণেশ্বরসহ কলকাতা শহরের কয়েক জায়গায় এই যাত্রীবাহী যান চোখে পড়ে৷ মফস্বল শহরেও ‘টোটো’ ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে৷
যুবক হায়দর আলির ইজিট্যাক্সিতে উঠেছিলাম৷ ভাড়া ১০ টাকা৷ হায়দর বেশ গল্প করতে পারে৷ বলল, বাংলাদেশের বর্ডার থেকে যশোরের বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছতে মিনিট দশ-পনেরো৷
একফাঁকে কলকাতার অটোচালকদের কথাও জানতে চাইল হায়দর৷ বাংলাদেশের পুলিশের ইউনিফর্মের রং নীল৷ রাস্তার কয়েক জায়গায় পুলিশ দাঁড়িয়ে৷ রাস্তার দু’পাশে নানা ধরনের দোকান৷ মোবাইল স্টোর, মুদি দোকান, মিষ্টির দোকান, চায়ের দোকান কয়েকটা৷ চালু হোটেলও দেখলাম৷
দোকানগুলোর সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা৷ একটা ইংরেজি অক্ষরও খুঁজে পেলাম না৷ আমার অটোতেই বসলেন এক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা৷ মনে হল, একটু আগেই ভারতীয় ইমিগ্রেসনের লাইনে তাঁদের দেখেছি৷ ভদ্রলোকের নাম তপন দাস৷ সঙ্গে তাঁর স্ত্রী৷ সাতক্ষীরায় বাড়ি৷ ভারতে দিন সাতেক কাটিয়ে বাড়ি ফিরছেন৷ স্ত্রীকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ উত্তর ২৪ পরগনার গুমায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে ওঠেন৷
জিজ্ঞাসা করলাম—আমাদের দেশ কেমন লাগল?
তপনবাবু টুকটাক ব্যাবসা করেন৷ জমিজমাও কিছু আছে৷ বললেন, ‘এমনিতে দ্যাশটা যে ভালো তাতে কোনও সন্দেহ নাই৷ আতিথেয়তাও আছে৷ কিন্তু আপনাগো দ্যাশের লোকজন তাদের বেশি বুদ্ধিমান বইল্যা মনে করে৷ আমাদের নীচু নজরে দ্যাখে৷ এইটাই খারাপ লাগে৷’ তবে নানা যুক্তি দিয়ে তপনবাবুর এই ধারণা বদলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম৷
বাসস্ট্যান্ডে নামলাম৷ যশোরের বাস দাঁড়িয়ে৷ প্রায় লাগেজের মতোই বাসের কন্ডাক্টর আমাকে ভিড় বাসে ঠেলে তুলে দিল৷ তবে তার ভেতরে দয়া বলে একটা বস্তু আছে৷ আমাকে জানালার ধারে সিটের ব্যবস্থা করে দিল৷ সস্ত্রীক তপন দাসও একই বাসে উঠলেন৷
এপার বাংলা ওপার বাংলার বিশেষ তফাত নেই৷ একইরকম ঘরবাড়ি, দোকানপাট, রাস্তার ধারে ভিড়ভাট্টা আর বাতাসে ধুলো ওড়ে৷
যশোর শহর পর্যন্ত ভাড়া ৫৫ বাংলাদেশি টাকা৷ বাসে টিকিট দেওয়ার কোনও ব্যাপার নেই৷ যাত্রীদের মুখ চিনে কন্ডাক্টর বেশ মনেও রাখতে পারে দেখলাম৷ আমার কাছে দ্বিতীয়বার ভাড়া চাইতে আসেনি৷ পরে দেখেছি, বাংলাদেশের দূরপাল্লার বাসগুলোতে ভাড়ার পরিবর্তে যাত্রীদের টিকিট দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই৷ কন্ডাক্টরদের স্মরণশক্তি তারিফ করার মতো৷
তবে নামী ট্র্যাভেল কোম্পানিগুলোর রাতের দূরপাল্লার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসগুলোতে মোটা টাকা ভাড়াবাবদ মানি-রিসিট পাওয়া যায়৷ সাধারণত এ ধরনের বাসে অ্যাডভান্স বুকিং করাই ভালো৷ তপনবাবুরা এক জায়গায় নামলেন৷ এখান থেকে ডানদিকে একটা রাস্তা সোজা চলে গিয়েছে সাতক্ষীরার দিকে৷ শারশা যাদবপুর বাজার৷ বাস থেকেই দেখতে পেলাম অমলের মিষ্টির দোকান৷ কাচের শো-কেসে নানা ধরনের মিষ্টি সাজানো৷
চওড়া চমৎকার পথে বেশ জোরেই বাস ছুটছে৷ দু’পাশের বিস্তীর্ণ জমিতে ধান রোয়া হয়েছে৷ যেন চরাচর জুড়ে সবুজ গালিচা পাতা৷ আসগর আলির মুদি দোকানের পাশেই বিপ্লবের চা ও পান-সিগারেটের দোকান৷ যশোর শহরে ঢোকার আগেই ঝিকরগাছা বাসস্ট্যান্ডে যখন ‘মহিল এক্সপ্রেস’ থেকে নামলাম, বাংলাদেশের সময় প্রায় বেলা ৩টে৷
বাসস্ট্যান্ডেই নিরঞ্জন বাগচীর সঙ্গে আলাপ৷ পরনে ধুতি-শার্ট৷ যশোর শহরেই একটি সুকলে শিক্ষকতা করেন৷ বললেন, ‘এইখানেই ইজিট্যাক্সিতে চাপেন৷ যশোর রামকৃষ্ণ মিশনে পৌঁছাইয়া দিব৷ ভাড়া ১০ টাকা৷’
ইজিট্যাক্সিতেই পরিচয় বলরাম সাহার সঙ্গে৷ রামকৃষ্ণ মিশনের কাছেপিঠেই থাকেন৷ কথাবার্তায় বুঝতে অসুবিধা হয় না এখানে রামকৃষ্ণ মিশন হয়েছে বলে তিনি খুশি৷ বললেন, ‘রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন হইবার ফলে স্থানীয় মানুষরা খুব খুশি৷ হিন্দুদের মনে বাড়তি জোর আইছে৷ তাছাড়া গরিব মুসলমানেরাও মিশনের হোমিওপ্যাথিক ডিসপেনসারিতে চিকিৎসার সুযোগ পাইতাছে৷’
রাস্তায় দেখলাম, হাসিখুশি মেয়েরা বইখাতা নিয়ে সুকল থেকে ফিরছে৷ মিনিট দশেকের মধ্যেই মিশনের গেটে পৌঁছলাম৷ পাশে ছোট গেট৷ এই গেট দিয়ে মিশনের ভেতর অনেকটাই দেখা যায়৷ দূরে একটি ছেলে সাইকেলে আসছে৷ ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকলাম৷
ছেলেটি কাছে আসতে বললাম, ‘কলকাতা থেকে আসছি৷ আশ্রমে থাকব৷ সুদেব মহারাজকে একটু খবর দিতে পারো?’ ও সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে সুদেব মহারাজকে খবর দিল৷ ছেলেটির নাম কার্তিক বিশ্বাস৷ বি এস সি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র৷ বাড়ি নড়াইলে৷ আশ্রমের হোস্টেলে থাকে৷
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সুদেব মহারাজ নিজে এসে ছোট গেটটা খুলে দিয়ে স্মিতহেসে বললেন, ‘ভেতরে আসুন৷ দুপুরের খাওয়া নিশ্চয়ই হয়নি৷ বিকেল হতে চলল৷ তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিং হলে চলে আসুন৷ পরে কথা হবে৷’
লাউ দিয়ে মুগডাল৷ আস্ত দুটো সুস্বাদু ফলিমাছ৷ গরম গরম ভাত৷ খিদের মুখে দারুণ লাগল৷ যশোর রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন ২০১২ সালের জুনে তৈরি হয়৷ আগে এই জায়গায় ‘বিবেকানন্দ ভাবপ্রচার পরিষদ’ ছিল৷ কয়েক একর জায়গা নিয়ে আশ্রম৷ এখানকার প্রধান হলেন স্বামী জ্ঞানপ্রকাশানন্দ৷ একসময় ঢাকার রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে থাকতেন৷ তিনি ‘মিন্টু মহারাজ’ নামেই সমধিক পরিচিত৷ সেইসময় তিনি ভারতে ছিলেন৷ অবশ্য আমার আসার কথা আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম৷ ২৮/৩০ জন বি এ, বি এস সি, এম এ পাঠরত হিন্দু ছেলে এই আশ্রমে থাকে৷ সিট-রেন্ট মাথাপিছু শ’চারেক টাকা৷ দু’বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা ছেলেদেরই করতে হয়৷
লম্বা দোতলা বিল্ডিং৷ একতলা ও দোতলা মিলিয়ে অনেকগুলো ঘর৷ নাম, ‘ব্রহ্মানন্দ ভবন৷’ অতিথিরা এখানেই থাকেন৷ আমারও থাকবার ব্যবস্থা এখানে৷ ব্রহ্মানন্দ ভবনের দু’পাশে একদিকে বিবেকানন্দ দাতব্য চিকিৎসালয় ও অন্যদিকে বিবেকানন্দ পাঠাগার৷ সন্ধ্যায় শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরে আরতি দেখার পর সুদেব মহারাজের একতলার অফিসে আলাপ হল, আশ্রমেরই এক ভক্ত ভবতোষ ঘোষ এবং তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী লিলি ঘোষের সঙ্গে৷
লিলিদেবী বললেন, ‘আশ্রমের পিছনেই আমার বাড়ি৷ বিয়ের পর গত পঁয়ত্রিশটা বচ্ছর তো এখানেই৷ আমার তো দুই পোলা৷ ছোটটা প্রায়ই কয়, মা কলকাতার আশপাশে একটু জমি অন্তত কিনা রাখো৷ অনেকবার কিনবার কথাও ভাবছি৷ শেষপর্যন্ত কিনা আর হইল কই! আসলে এদেশ ছাইড়া যাইতে আর ইচ্ছা করে না৷ আমাদের যশোর প্রধানত হিন্দু অঞ্চল৷’
যে বেজপাড়ায় যশোর রামকৃষ্ণ মিশন, সেখানে শতকরা ৩০ ভাগ হিন্দু৷ শ্রীমতী ঘোষ বলেন, ‘ইন্ডিয়ায় আমার আত্মীয়-পরিজনরা জিজ্ঞাসা করেন—বাড়িতে শাঁখ বাজাইতে পারি কি না৷ এটা কোনো সমস্যাই না৷ উলুধ্বনি, ঘণ্টাধ্বনি, শাঁখ বাজান সবকিছুই আমরা করতে পারি৷ শহরে অসুবিধা নাই৷ হিন্দু মাইয়ারা রাস্তাঘাটে স্বাধীনভাবে চলাফিরা করে৷ কিন্তু গ্রামাঞ্চলে হিন্দু মাইয়াদের আজও নানান সমস্যায় পড়তে হয়৷’ লিলি ঘোষের কথাবার্তায় খুব একটা বাংলাদেশি টান নেই৷
সুকোমল চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার আলাপ যশোর রামকৃষ্ণ মিশনেই৷ বাড়ি বেজপাড়ায়৷ একসময় যশোর শহরে ওষুধের দোকান ছিল তাঁর৷ রামকৃষ্ণ মিশনে নিয়মিত যাতায়াত করেন৷ দুই ছেলে৷ বড় ছেলে ঢাকায় মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার৷ ছোট ছেলে নওগাঁয় ব্যাংকের অফিসার৷
১৯৪৫ সালে ময়মনসিংহে জন্ম সুকোমলবাবুর৷ তখন বছর চারেক বয়স তাঁর৷ ভাগ্যসন্ধানে তিন ছেলে ও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যশোর জেলায় চলে এলেন সুকোমলবাবুর বাবা৷ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরির পর অবশেষে বেজপাড়ায়৷ তখন এই অঞ্চল বন-বাদাড়৷
সুকোমলবাবুর মুখেই শুনলাম, তাঁর মামা ও মাসিরা সেই সময় কলকাতায় চলে যান৷ কাঁকিনাড়ায় মাসি, পাণ্ডুয়ায় মামা৷ আর এক মামা পরে অসমে যান৷ কিন্তু সুকোমলবাবুর বাবা ভারতে যেতে চাননি৷ বলেছিলেন, ‘দরকার হইলে গাছতলায় থাকুম৷ কিন্তু রিফিউজি কার্ড কোনোদিন করুম না৷ ছিলেনও প্রায় সেরকমভাবেই প্রথমদিকে৷
বেজপাড়ায় গাছতলায় একটা কুড়েঘর বানিয়ে সুকোমলবাবুর বাবা বসবাস শুরু করেন৷ মাস্টারি ও যজমানি করে কোনোরকমে সংসার চালাতেন৷ অসীম ধৈর্য আর বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর৷ ইতিমধ্যে সুকোমলবাবুর আরও দুটো বোন হল৷ তাঁর এক ভাই আগেই ভারতে চলে যান৷
এদিকে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠতেই পাকিস্তানি সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ল পূর্ব বাংলার ওপর৷ যশোরেও খুঁজে খুঁজে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করতে লাগল৷ রাজাকারদের হাতে মারা গেলেন সুকোমলবাবুর বাবা৷ স্বামীকে ছেড়ে যেতে চাননি স্ত্রী৷ চোখের সামনে স্বামীর এই করুণ পরিণতি দেখেও এক ফোঁটা চোখের জল ফেলতে পারেননি সুকোমলবাবুর মা৷ কারণ, সেই মুহূর্তে ভদ্রমহিলা নিজেই অর্ধমৃত অবস্থায়৷ তাঁর শরীরে কয়েকবার ছুরি চালিয়েছিল নিষ্ঠুর রাজাকাররা৷
ওই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে এখনও কেঁপে ওঠেন সুকোমলবাবু৷ বললেন, ‘আমার ছোট্ট বোইনটার বয়স তখন মাত্র ৪ বচ্ছর৷ চারপাশে গণ্ডগোলের খবর শুইনা ওকে লইয়া আমাদের বাড়ি হইতে কিছুটা দূরে এক মুসলমান বন্ধুর বাড়িতে রাইখা আসতে গেলাম৷ সেই সময়ই রাজাকাররা বিহারী মুসলমান গুণ্ডাদের লইয়া আমাদের বাড়ি আক্রমণ করে৷ পরে আমারই এক মুসলমান বন্ধু মা-কে তার মা পরিচয় দিয়া হাসপাতালে নিয়া যায়৷ ভাগ্যের জোরে মা ক্রমশ সুস্থ হইয়া ওঠেন৷
আমি, আমার এক ভাই ও বোনেরা হগ্গলে মিলা ভারতে পলাইয়া যাই৷ আসামে থাকতাম৷ ইতিমধ্যে মা-ও কলকাতায় আইয়া পড়লেন৷ মাসে ৩০০ টাকা পাইতাম এক ওষুধের দোকানে কাজ কইরা৷ টাকাটা কলকাতায় পাঠাইতাম৷ মা-কে দেখার লাইগা ছট্ফট্ করতাম৷ কলকাতায় আইলাম, মা আমারে দেইখা কান্না করতে লাগলেন৷ বাবার জন্য খুব কষ্ট হইতাছিল৷ কেন এমন হইল?
কলকাতায় ও অন্যান্য জায়গায় আত্মীয়-স্বজনদের মুখগুলা তো দেখলাম! স্বার্থ আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যই শুধু৷ মন ভাইঙা গেল৷ ফিরা আইলাম আবার নতুন বাংলাদেশে৷ সব মিলাইয়া অখন নিজের ভিটা-মাটিতে মোটামুটি আছি৷’
ভবতোষ ঘোষ সুকোমলবাবুর পাশেই বসেছিলেন৷ ব্যাংকে কাজ করতেন৷ বছর কয়েক হল অবসর নিয়েছেন৷ মাগুড়া জেলায় ২৫ বিঘা ধানিজমি আছে তাঁর৷ এত জমি নিয়মিত দেখাশোনা করাও সম্ভব নয়৷ বেদখল হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে৷ ভবতোষবাবু কিছুটা স্বস্তির সুরে বললেন, ‘সেই সম্ভাবনা কিন্তু উড়াইয়া দেওয়া যায় না৷ এই দ্যাশে যখন তখন যা খুশি হইতে পারে৷ তবে আমার কপাল এখনও ভালাই আছে৷ বেদখল কিছু হয় নাই৷ আবার হইতেও বা কতক্ষণ?’
সুকোমলবাবু ও ভবতোষবাবুর মুখে শুনলাম, শ্রীযুক্ত তারাপদ দাসের কথা৷ তারাপদবাবু যশোর সম্মিলনী সুকলের নামকরা মাস্টারমশাই ছিলেন৷ বাংলা ও ইংরেজি দুটো সাবজেক্টই পড়াতেন৷ বয়স এখন তাঁর আশির ওপর৷ অনেক পাবলিক অনুষ্ঠানেই তারাপদবাবুকে প্রধান অতিথি করে নিয়ে যাওয়া হয়৷ বাংলাদেশের মন্দির সম্বন্ধেও তিনি খোঁজখবর রাখেন৷ তারাপদবাবু রামকৃষ্ণ মিশনের ভক্ত৷
এরকম একজন জ্ঞানীগুণী মানুষের সঙ্গে আমার দেখা করার ইচ্ছা ছিল৷ শেষপর্যন্ত সময়াভাবে তা হয়নি৷
রাতে বাংলাদেশের দু’জন আর্মড পুলিশকে পাহারা দিতে দেখলাম রামকৃষ্ণ মিশনে৷ বাংলাদেশে যতগুলো রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন রয়েছে, সব জায়গায় পুলিশ প্রহরা৷ বড় বড় মন্দিরসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও সরকার থেকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ তবুও হামলার বিপদ শিয়রে শুয়ে থাকে৷
রামকৃষ্ণ মিশন মানেই সুস্বাদু ঘরোয়া খাবারদাবার৷ রাতে সুদেব মহারাজ ও জয় মহারাজের সঙ্গে ডাইনিং হলে খেতে বসলাম৷ গরম গরম ভাতের সঙ্গে সজনে ডাঁটার চচ্চড়ি বড়ই উপাদেয়৷ আর ঘন মুসুরির ডাল৷ রাতেও আস্ত দুটো ফলিমাছের ঝোল৷ এখনও বাংলাদেশের মাছের স্বাদের তুলনা নেই৷
খেতে খেতে সুদেব মহারাজ আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন—আপনি যশোরেশ্বরী মন্দিরে যাবেন না? আমাদের আশ্রম থেকে যশোরেশ্বরী মন্দির কিন্তু অনেকটা পথ৷ সকাল সকাল বেরলে সন্ধ্যায় আবার আশ্রমে ফিরে আসতে পারবেন৷ আসল ব্যাপার হল, কাল মঙ্গলবার৷ শনি-মঙ্গল এ দু’দিনই যশোরেশ্বরী মন্দির খোলা থাকে৷
বললাম, ‘আগামীকালই আমার যাওয়ার ইচ্ছা৷ তবে কাউকে সঙ্গী হিসেবে পেলে ভালো হত৷ অনেকটা পথ তো৷ গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে৷’
এবার সুদেব মহারাজ জয় মহারাজের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি তো এখনও যশোরেশ্বরী মন্দিরে যাননি? যান না মিঃ গুপ্তর সঙ্গে গিয়ে ঘুরে আসুন৷ দু’জনে একসঙ্গে গেলে ভালোই হবে৷’
জয় মহারাজ এককথায় আমার সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে গেলেন৷
ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে আশ্রমের মাঠে সুদেব মহারাজের সঙ্গে গল্প করছিলাম৷ কথাবার্তার মধ্যেই এক যুবক এসে সুদেব মহারাজকে প্রণাম করল৷ যুবকের নাম দীপু কুমার৷ আশ্রমের কাছেই হরিজন পাড়ায় থাকে৷ ধর্ম-সংক্রান্ত বিশেষ কয়েকটা প্রশ্ণ ছিল এই হরিজন যুবকের৷ যশোর কলেজে কমার্স নিয়ে পড়াশুনো করছে৷
সুদেব মহারাজ বললেন, ‘মিঃ গুপ্ত, এবার গিয়ে শুয়ে পড়ুন৷ কাল সকাল সকাল উঠতে হবে৷’ তিনিও একসময় ঢাকা রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে ছিলেন৷ তাঁর সন্ন্যাস নাম স্বামী সদ্বিদ্যানন্দজি৷
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
সৌজন্যে দীপ প্রকাশন