রাজকন্যা শান্তা। অঙ্গরাজ রোমপাদের আদরের কন্যা। পদ্মের পাপড়ির মতো টানা টানা চোখ তার। সে ‘মহাভাগা’—সৌভাগ্যবতী। তাকে সম্প্রদান করলেন অঙ্গরাজ বিভাণ্ডক মুনির পুত্র, মহাতপা মুনিবর ঋষ্যশৃঙ্গের হাতে। তবেই তো নামল আকাশ-ভাঙা বৃষ্টি অঙ্গদেশের শুকনো, রুক্ষ, পিপাসার্ত মাটিতে। নিষ্পাপ শিশুহৃদয়ের এই ব্রহ্মজ্ঞানী তপস্বীকে স্বামী হিসেবে পেয়ে তখন কী হয়েছিল রাজকুমারীর মনের অবস্থা, সে কথা অবশ্য রয়ে গিয়েছে কবির হৃদয়েই।
ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির গল্প বলতে বলতে অযোধ্যাপতি দশরথের মন্ত্রী সুমন্ত্র একই সুতোয় গাঁথলেন শান্তার গল্পকেও। সব সংস্করণে নয়, তবে রামায়ণের বঙ্গদেশীয় সংস্করণে সে গল্পের দীর্ঘায়িত, পূর্ণাঙ্গ রূপ চোখে পড়ে। প্রক্ষিপ্ত কাহিনী? হবেও বা। সে যুক্তিতে আজ তাকে বাদ দিয়ে বসলে রসভঙ্গই হবে। অঙ্গরাজের কন্যা শান্তা, ঋষ্যশৃঙ্গের পত্নী শান্তা কিংবা বিভাণ্ডক মুনির পুত্রবধূ শান্তা— এটুকুই কি পরিচয় তার? না কি তার আড়ালে আরও কিছু রয়ে গিয়েছে বাকি?
আসলে শান্তা হল দশরথেরই কন্যা! রামের জন্মের বেশ কিছু বছর আগে জন্ম নিয়েছিল সে দশরথ রাজার ঘরে। সুমন্ত্র সে রহস্য এবার ভাঙলেন। আদিকবি অবশ্য আড়ম্বর করে বলতে চাননি শান্তার কথা। সে সকলের আদরের কন্যা, স্বামীর ভালবাসাও সে কম পায়নি ঠিকই, কিন্তু বড় অল্প কথায় আঁকা তার জীবনালেখ্যটি। অথবা এও বলা যায়, রামের অগ্রজা শান্তার স্থানও ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’দের তালিকায়ই। কিন্তু নীরব হলেও মহাকাব্যের আখ্যানে শান্তার ভূমিকাটুকু অগ্রাহ্য করার মতো নয়। রামায়ণ মহাকাব্যের কেন্দ্রে যিনি নায়ক, অযোধ্যাপতি দশরথের পুত্র রাম— তাঁরই জন্মকথার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শান্তার জীবনের কিছু অংশও! দশরথের আত্মজা হয়ে, অঙ্গরাজের পালিতা কন্যা হয়ে, মহাতেজস্বী ঋষ্যশৃঙ্গের পত্নী হয়ে সে শুধু কাব্যের সুতোটুকু গেঁথে দিয়ে গেল। তাই তার জীবনকথা, সে যতই ক্ষুদ্র, অনাড়ম্বর হোক না কেন, একটুখানি জায়গা তার না হয় থাক পাঠকের মনে।
দশরথ বহুবল্লভ রাজা। রাজ-অন্তঃপুরে স্ত্রীর সংখ্যা তাঁর তিনশ’ বাহান্ন। রামের বনবাস যাত্রার সময় তাদের উল্লেখ মেলে। প্রধানা রাজমহিষী তিনজন, তাঁদের নামই জানি আমরা— কৌশল্যা, কৈকেয়ী আর সুমিত্রা। রাজার পুত্রহীনতার দুঃখ, তার প্রতিকারের উপায়, পুত্রলাভের ইতিবৃত্ত —সবই ছড়িয়ে আছে আদিকাণ্ডে। কিন্তু রাজা তো নিঃসন্তান ছিলেন না। কন্যা শান্তার মাতৃপরিচয়ই বা কি? তার উল্লেখও মহাকাব্যে নেই। এই কন্যাকে নিঃসন্তান অঙ্গরাজ রোমপাদ পালিতা কন্যা রূপে বন্ধুত্বের দাবিতে চেয়ে নিলেন দশরথের কাছ থেকে। একমাত্র কন্যা হলে অঙ্গরাজ এমন দাবি করতেন বলে তো বোধ হয় না। তাহলে কি একাধিক কন্যা ছিল তাঁর? শান্তা ছাড়া আর কারও উল্লেখ নেই মহাকাব্যে। এসব উত্তরহীন প্রশ্ন কিংবা সংশয় উত্তরকালের পাঠকের মনে ঘুরপাক খেতেই থাকে।
দশরথ ছিলেন রোমপাদের অভিন্নহৃদয় বন্ধু। অপত্যহীন অঙ্গরাজ দশরথকন্যাকে চেয়েছিলেন পুত্রিকা রূপে— ‘যাচতে পুত্রকৃত্যায় শান্তা প্রিয়তমাত্মজা’। শাস্ত্রনির্দেশে পিতামাতার প্রতি পুত্রের অবশ্যকরণীয় কৃত্য যা কিছু, সেসব পালনের অধিকার থাকে পুত্রিকাকন্যা বা পুত্রস্থানীয় কন্যারও। বন্ধুর সে অনুরোধ ফেলতে পারেননি কোশলপতি। দান করলেন রূপে-গুণে অতুলনীয়া প্রিয়তমা কন্যাটিকে। আবার সেই কন্যাকে অঙ্গরাজ পরম আদরে বড় করলেন, তাকে পত্নী রূপে সঁপে দিলেন মহাতেজা অথচ সরল হৃদয় ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির হাতে। ঋষ্যশৃঙ্গও এমন রাজকন্যা পেয়ে, রাজ-সমাদরে বেশ খুশি হয়েই থেকে গেলেন অঙ্গরাজ্যে। পিতা বিভাণ্ডক মুনির আশ্রমে ফিরে যাওয়ার কথা তাঁর মনেই রইল না। কন্যার সঙ্গে জামাতাকেও কাছে পেলেন রোমপাদ, সংসারজীবন ভরে উঠল তাঁর।
সুমন্ত্রের কাছে রাজা দশরথ শুনছিলেন আসলে পুত্রলাভের উপায়। তারই মাঝে উঠল কন্যা শান্তার কথা। যে মেয়ের কথা কবি নিজ মুখে কিছুই প্রায় বলতে চাননি, তার মুখে দেননি একটিও সংলাপ, তার কথা উঠে এল হঠাৎ। আসলে সুমন্ত্র জানতেন, দশরথের অশ্বমেধ যজ্ঞের সংকল্প, তাঁর পুত্র লাভের অভিলাষ— এসব পূরণ করতে পারবেন একজনই, তিনি ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি। তিনি শান্তার স্বামী, সম্পর্কে রাজার জামাতা। কাজেই সেই আত্মীয়তার সূত্র ধরেই ঋষিকে অযোধ্যায় বরণ করে নিয়ে আসতে হবে। তবেই ইক্ষ্বাকুরাজবংশের যশ-খ্যাতি-কীর্ত্তি-সম্মানের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় পড়বে না যতিপাত। জগৎ আলো-করা অমিত শক্তিশালী চারটি পুত্র হবে রাজার। কিন্তু অমন মহাশক্তিধর ঋষিকে এই উদ্দেশ্যে আনতে চাইলেই কি আসবেন তিনি? সেই পথ মসৃণ করে সম্পর্কের সহজ সেতুটি গড়ে দিল শান্তা।
সুমন্ত্রের পরামর্শে রাজা নিজেই গেলেন অঙ্গরাজ্যে জামাতা ঋষ্যশৃঙ্গকে আনতে। পরিচয় হল মুনির সঙ্গে- তপস্যার শক্তিতে মুনিবর উজ্জ্বল যেন আগুনের দীপ্ত শিখা। তবে দশরথ গিয়েই বলে ফেললেন না আসার আসল উদ্দেশ্য। সাত-আটদিন বন্ধুগৃহে আমোদে আহ্লাদে কাটানোর পর অঙ্গরাজকে খুলে বললেন সব কথা। বললেন— ‘দেখো বন্ধু, বড় করে পুত্রলাভের যজ্ঞ করবো বলে মনস্থির করেছি। ঋষ্যশৃঙ্গের সাহায্য চাই। শান্তা তো এখন তোমারই মেয়ে। আপত্তি না থাকে তো দিন-কয়েকের জন্য মেয়ে-জামাইকে অযোধ্যায় নিয়ে যাই।’ অঙ্গরাজ সব শুনে খুশি হয়ে রাজাকে নিয়ে গেলেন ঋষ্যশৃঙ্গের কাছে। পরম বন্ধু দশরথের কাছ থেকে শান্তাকে লাভ করার বৃত্তান্ত জানালেন মুনিবরকে। নতুন করে পরিচয় করালেন—’যেমন আমি, তেমনই দশরথও তোমার শ্বশুরমশায়। এঁর প্রার্থনা পূরণে সাহায্য করাই উচিত।’ সব কথা শুনে ঋষ্যশৃঙ্গ খুশি মনেই শান্তাকে নিয়ে দশরথের সঙ্গে চললেন অযোধ্যায়। সেজে উঠল অযোধ্যা আলোয়, ফুলের মালায়, ধূপের গন্ধে। রাজা ঋষিকে আনতে পেরে যেন ধন্য হয়ে গেলেন। আর অন্তঃপুরের মহিলারা খুশি হলেন এতদিন পরে ঘরের মেয়েকে ঘরে পেয়ে। সত্যিই তো, কোনও কারণ ছাড়াই শুধু মেয়ের সঙ্গ উপভোগ করবেন বলে শান্তাকে কি ডেকে আনতেন অযোধ্যাপতি?
অমন ক্ষমতাশালী মুনির পত্নী হয়েই তো বহু বছর পরে পিতার গৃহে আসার সুযোগটুকু মিলেছিল তার! অযোধ্যার রাজপ্রাসাদে যেন ইন্দ্রের পুরীতে দেবগুরু বৃহস্পতির মর্যাদায় শান্তাকে নিয়ে সুখে দিন কাটাতে লাগলেন ঋষ্যশৃঙ্গ। এর কিছুকাল পরে বসন্তকালে শুরু হল অশ্বমেধ যজ্ঞের বিপুল কর্মকাণ্ড। রাজার সেবাযত্নে প্রসন্ন ঋষ্যশৃঙ্গ সে মহাযজ্ঞের হোতা। সুষ্ঠুভাবে যজ্ঞকর্ম সুসম্পন্ন হল। রাজা নিজের ইচ্ছা মেলে ধরলেন ঋষিদের কাছে। যশস্বী, পরাক্রমশালী চারজন পুত্র লাভের আকাঙ্ক্ষা তাঁর। অশ্বমেধ যজ্ঞের ফলে কেটে গিয়েছে রাজার জন্ম-জন্মান্তরের পাপ। পাপমুক্ত রাজার জন্য এবার পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করলেন ঋষ্যশৃঙ্গ। যজ্ঞের আগুন থেকে উঠে এলেন জ্যোতির্ময় প্রাজাপত্য পুরুষ, হাতে তাঁর সোনার পাত্রে ধরা যজ্ঞের ফলস্বরূপ দিব্য পায়স। পুত্রলাভের জন্য সেই পায়স ভাগ করে দিতে হবে রাজমহিষীদের মধ্যে। অন্তঃপুরে গিয়ে রাজা তিন রানির মধ্যে ভাগ করে দিলেন সেটি। এর ফলে রানিদের গর্ভে জন্ম নেবেন বিষ্ণুর সাক্ষাৎ চারটি ভাগ- সকল গুণের আধার, চার পুত্র- রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন।
শেষ হল পুত্রেষ্টি যজ্ঞ। এমন সফল যজ্ঞ শেষে আনন্দিত সবাই। এবার সবার ফেরার পালা। ফিরে গেলেন দেবতা, ঋষি, রাজারা। দশরথ সরযূ তীরের যজ্ঞভূমি থেকে ফিরলেন নগরীতে। ঋষ্যশৃঙ্গ আর শান্তাও কি বিদায় নিলেন? না, রাজার কন্যা-জামাতা তাঁরা। তাঁরা থেকে গেলেন আরও কিছুকাল আদরে, সমারোহে। অবশেষে তাঁদের বিদায় বেলা এল। রাজা আদরিণী কন্যাকে কত যে উপহার দিলেন, ইয়ত্তা নেই তার। সাজিয়ে দিলেন তাকে বহুমূল্য আভরণে। সঙ্গে দিলেন মণি-মাণিক্য, সাদা গাভীর দল, চলার পথে আরামের জন্য কম্বলের আসন, পরিচর্যার জন্য দাসদাসী। অনেকটা পথ তাঁদের এগিয়ে দিলেন স্বয়ং রাজা। কুলগুরু বশিষ্ঠ, অন্তঃপুরিকারা আর পুরবাসীরাও চললেন সঙ্গে। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে তাঁরা বিদায় দিলেন মেয়েকে। যে মেয়েকে ছোট্ট বেলায় পালক পিতার হাতে তুলে দিয়েছেন, আজ সেই মেয়েকেই নতুন করে বিদায় জানাতে বুক ভেঙে যাচ্ছে পিতার। আবেগ ধরে রাখতে না পেরে উচ্চস্বরে কেঁদে ফেলে তিনি রানীদের বলছেন— ‘শান্তাকে ভাল করে দেখে নাও গো সবাই। আবার কবে তাকে দেখতে পাবে কে জানে?’ আকুলভাবে জড়িয়ে ধরে যাত্রাকালে স্বস্তিবাক্য বলে মাথায় আশিসচুম্বন এঁকে দিলেন রানিরা। পিতৃগৃহ থেকে একরাশ ভালবাসা, আশীর্বাদ, শুভ উপদেশ মাথায় নিয়ে শান্তা বিদায় নিল স্বামীর সঙ্গে। যেদিন সে অযোধ্যায় এসেছিল মহাতপা মুনির গরবিনী পত্নী রূপে, সেদিনের আদরে আপ্যায়নে কিছুটা যেন লৌকিকতার আবরণ ছিল, সেদিন অনেক বেশি প্রয়োজন ছিল মুনিবরকে সন্তুষ্ট রাখার। আজ শান্তার বিদায়বেলায় স্নেহের টানে সেই লৌকিকতার আবরণ খসে পড়েছে। কবি ফুটিয়ে তুলেছেন নিপুণ তুলির আঁচড়ে, বাপের বাড়ি ছেড়ে আদরের মেয়ের স্বামীর সঙ্গে দূর দেশ যাত্রার ছবি।
বিদায় নিল মেয়ে। রাজা দশরথের মন জুড়ে এবার পুত্রজন্মের অধীর অপেক্ষা। —চলবে
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির গল্প বলতে বলতে অযোধ্যাপতি দশরথের মন্ত্রী সুমন্ত্র একই সুতোয় গাঁথলেন শান্তার গল্পকেও। সব সংস্করণে নয়, তবে রামায়ণের বঙ্গদেশীয় সংস্করণে সে গল্পের দীর্ঘায়িত, পূর্ণাঙ্গ রূপ চোখে পড়ে। প্রক্ষিপ্ত কাহিনী? হবেও বা। সে যুক্তিতে আজ তাকে বাদ দিয়ে বসলে রসভঙ্গই হবে। অঙ্গরাজের কন্যা শান্তা, ঋষ্যশৃঙ্গের পত্নী শান্তা কিংবা বিভাণ্ডক মুনির পুত্রবধূ শান্তা— এটুকুই কি পরিচয় তার? না কি তার আড়ালে আরও কিছু রয়ে গিয়েছে বাকি?
আসলে শান্তা হল দশরথেরই কন্যা! রামের জন্মের বেশ কিছু বছর আগে জন্ম নিয়েছিল সে দশরথ রাজার ঘরে। সুমন্ত্র সে রহস্য এবার ভাঙলেন। আদিকবি অবশ্য আড়ম্বর করে বলতে চাননি শান্তার কথা। সে সকলের আদরের কন্যা, স্বামীর ভালবাসাও সে কম পায়নি ঠিকই, কিন্তু বড় অল্প কথায় আঁকা তার জীবনালেখ্যটি। অথবা এও বলা যায়, রামের অগ্রজা শান্তার স্থানও ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’দের তালিকায়ই। কিন্তু নীরব হলেও মহাকাব্যের আখ্যানে শান্তার ভূমিকাটুকু অগ্রাহ্য করার মতো নয়। রামায়ণ মহাকাব্যের কেন্দ্রে যিনি নায়ক, অযোধ্যাপতি দশরথের পুত্র রাম— তাঁরই জন্মকথার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শান্তার জীবনের কিছু অংশও! দশরথের আত্মজা হয়ে, অঙ্গরাজের পালিতা কন্যা হয়ে, মহাতেজস্বী ঋষ্যশৃঙ্গের পত্নী হয়ে সে শুধু কাব্যের সুতোটুকু গেঁথে দিয়ে গেল। তাই তার জীবনকথা, সে যতই ক্ষুদ্র, অনাড়ম্বর হোক না কেন, একটুখানি জায়গা তার না হয় থাক পাঠকের মনে।
দশরথ বহুবল্লভ রাজা। রাজ-অন্তঃপুরে স্ত্রীর সংখ্যা তাঁর তিনশ’ বাহান্ন। রামের বনবাস যাত্রার সময় তাদের উল্লেখ মেলে। প্রধানা রাজমহিষী তিনজন, তাঁদের নামই জানি আমরা— কৌশল্যা, কৈকেয়ী আর সুমিত্রা। রাজার পুত্রহীনতার দুঃখ, তার প্রতিকারের উপায়, পুত্রলাভের ইতিবৃত্ত —সবই ছড়িয়ে আছে আদিকাণ্ডে। কিন্তু রাজা তো নিঃসন্তান ছিলেন না। কন্যা শান্তার মাতৃপরিচয়ই বা কি? তার উল্লেখও মহাকাব্যে নেই। এই কন্যাকে নিঃসন্তান অঙ্গরাজ রোমপাদ পালিতা কন্যা রূপে বন্ধুত্বের দাবিতে চেয়ে নিলেন দশরথের কাছ থেকে। একমাত্র কন্যা হলে অঙ্গরাজ এমন দাবি করতেন বলে তো বোধ হয় না। তাহলে কি একাধিক কন্যা ছিল তাঁর? শান্তা ছাড়া আর কারও উল্লেখ নেই মহাকাব্যে। এসব উত্তরহীন প্রশ্ন কিংবা সংশয় উত্তরকালের পাঠকের মনে ঘুরপাক খেতেই থাকে।
দশরথ ছিলেন রোমপাদের অভিন্নহৃদয় বন্ধু। অপত্যহীন অঙ্গরাজ দশরথকন্যাকে চেয়েছিলেন পুত্রিকা রূপে— ‘যাচতে পুত্রকৃত্যায় শান্তা প্রিয়তমাত্মজা’। শাস্ত্রনির্দেশে পিতামাতার প্রতি পুত্রের অবশ্যকরণীয় কৃত্য যা কিছু, সেসব পালনের অধিকার থাকে পুত্রিকাকন্যা বা পুত্রস্থানীয় কন্যারও। বন্ধুর সে অনুরোধ ফেলতে পারেননি কোশলপতি। দান করলেন রূপে-গুণে অতুলনীয়া প্রিয়তমা কন্যাটিকে। আবার সেই কন্যাকে অঙ্গরাজ পরম আদরে বড় করলেন, তাকে পত্নী রূপে সঁপে দিলেন মহাতেজা অথচ সরল হৃদয় ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির হাতে। ঋষ্যশৃঙ্গও এমন রাজকন্যা পেয়ে, রাজ-সমাদরে বেশ খুশি হয়েই থেকে গেলেন অঙ্গরাজ্যে। পিতা বিভাণ্ডক মুনির আশ্রমে ফিরে যাওয়ার কথা তাঁর মনেই রইল না। কন্যার সঙ্গে জামাতাকেও কাছে পেলেন রোমপাদ, সংসারজীবন ভরে উঠল তাঁর।
সুমন্ত্রের কাছে রাজা দশরথ শুনছিলেন আসলে পুত্রলাভের উপায়। তারই মাঝে উঠল কন্যা শান্তার কথা। যে মেয়ের কথা কবি নিজ মুখে কিছুই প্রায় বলতে চাননি, তার মুখে দেননি একটিও সংলাপ, তার কথা উঠে এল হঠাৎ। আসলে সুমন্ত্র জানতেন, দশরথের অশ্বমেধ যজ্ঞের সংকল্প, তাঁর পুত্র লাভের অভিলাষ— এসব পূরণ করতে পারবেন একজনই, তিনি ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি। তিনি শান্তার স্বামী, সম্পর্কে রাজার জামাতা। কাজেই সেই আত্মীয়তার সূত্র ধরেই ঋষিকে অযোধ্যায় বরণ করে নিয়ে আসতে হবে। তবেই ইক্ষ্বাকুরাজবংশের যশ-খ্যাতি-কীর্ত্তি-সম্মানের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় পড়বে না যতিপাত। জগৎ আলো-করা অমিত শক্তিশালী চারটি পুত্র হবে রাজার। কিন্তু অমন মহাশক্তিধর ঋষিকে এই উদ্দেশ্যে আনতে চাইলেই কি আসবেন তিনি? সেই পথ মসৃণ করে সম্পর্কের সহজ সেতুটি গড়ে দিল শান্তা।
সুমন্ত্রের পরামর্শে রাজা নিজেই গেলেন অঙ্গরাজ্যে জামাতা ঋষ্যশৃঙ্গকে আনতে। পরিচয় হল মুনির সঙ্গে- তপস্যার শক্তিতে মুনিবর উজ্জ্বল যেন আগুনের দীপ্ত শিখা। তবে দশরথ গিয়েই বলে ফেললেন না আসার আসল উদ্দেশ্য। সাত-আটদিন বন্ধুগৃহে আমোদে আহ্লাদে কাটানোর পর অঙ্গরাজকে খুলে বললেন সব কথা। বললেন— ‘দেখো বন্ধু, বড় করে পুত্রলাভের যজ্ঞ করবো বলে মনস্থির করেছি। ঋষ্যশৃঙ্গের সাহায্য চাই। শান্তা তো এখন তোমারই মেয়ে। আপত্তি না থাকে তো দিন-কয়েকের জন্য মেয়ে-জামাইকে অযোধ্যায় নিয়ে যাই।’ অঙ্গরাজ সব শুনে খুশি হয়ে রাজাকে নিয়ে গেলেন ঋষ্যশৃঙ্গের কাছে। পরম বন্ধু দশরথের কাছ থেকে শান্তাকে লাভ করার বৃত্তান্ত জানালেন মুনিবরকে। নতুন করে পরিচয় করালেন—’যেমন আমি, তেমনই দশরথও তোমার শ্বশুরমশায়। এঁর প্রার্থনা পূরণে সাহায্য করাই উচিত।’ সব কথা শুনে ঋষ্যশৃঙ্গ খুশি মনেই শান্তাকে নিয়ে দশরথের সঙ্গে চললেন অযোধ্যায়। সেজে উঠল অযোধ্যা আলোয়, ফুলের মালায়, ধূপের গন্ধে। রাজা ঋষিকে আনতে পেরে যেন ধন্য হয়ে গেলেন। আর অন্তঃপুরের মহিলারা খুশি হলেন এতদিন পরে ঘরের মেয়েকে ঘরে পেয়ে। সত্যিই তো, কোনও কারণ ছাড়াই শুধু মেয়ের সঙ্গ উপভোগ করবেন বলে শান্তাকে কি ডেকে আনতেন অযোধ্যাপতি?
অমন ক্ষমতাশালী মুনির পত্নী হয়েই তো বহু বছর পরে পিতার গৃহে আসার সুযোগটুকু মিলেছিল তার! অযোধ্যার রাজপ্রাসাদে যেন ইন্দ্রের পুরীতে দেবগুরু বৃহস্পতির মর্যাদায় শান্তাকে নিয়ে সুখে দিন কাটাতে লাগলেন ঋষ্যশৃঙ্গ। এর কিছুকাল পরে বসন্তকালে শুরু হল অশ্বমেধ যজ্ঞের বিপুল কর্মকাণ্ড। রাজার সেবাযত্নে প্রসন্ন ঋষ্যশৃঙ্গ সে মহাযজ্ঞের হোতা। সুষ্ঠুভাবে যজ্ঞকর্ম সুসম্পন্ন হল। রাজা নিজের ইচ্ছা মেলে ধরলেন ঋষিদের কাছে। যশস্বী, পরাক্রমশালী চারজন পুত্র লাভের আকাঙ্ক্ষা তাঁর। অশ্বমেধ যজ্ঞের ফলে কেটে গিয়েছে রাজার জন্ম-জন্মান্তরের পাপ। পাপমুক্ত রাজার জন্য এবার পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করলেন ঋষ্যশৃঙ্গ। যজ্ঞের আগুন থেকে উঠে এলেন জ্যোতির্ময় প্রাজাপত্য পুরুষ, হাতে তাঁর সোনার পাত্রে ধরা যজ্ঞের ফলস্বরূপ দিব্য পায়স। পুত্রলাভের জন্য সেই পায়স ভাগ করে দিতে হবে রাজমহিষীদের মধ্যে। অন্তঃপুরে গিয়ে রাজা তিন রানির মধ্যে ভাগ করে দিলেন সেটি। এর ফলে রানিদের গর্ভে জন্ম নেবেন বিষ্ণুর সাক্ষাৎ চারটি ভাগ- সকল গুণের আধার, চার পুত্র- রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন।
শেষ হল পুত্রেষ্টি যজ্ঞ। এমন সফল যজ্ঞ শেষে আনন্দিত সবাই। এবার সবার ফেরার পালা। ফিরে গেলেন দেবতা, ঋষি, রাজারা। দশরথ সরযূ তীরের যজ্ঞভূমি থেকে ফিরলেন নগরীতে। ঋষ্যশৃঙ্গ আর শান্তাও কি বিদায় নিলেন? না, রাজার কন্যা-জামাতা তাঁরা। তাঁরা থেকে গেলেন আরও কিছুকাল আদরে, সমারোহে। অবশেষে তাঁদের বিদায় বেলা এল। রাজা আদরিণী কন্যাকে কত যে উপহার দিলেন, ইয়ত্তা নেই তার। সাজিয়ে দিলেন তাকে বহুমূল্য আভরণে। সঙ্গে দিলেন মণি-মাণিক্য, সাদা গাভীর দল, চলার পথে আরামের জন্য কম্বলের আসন, পরিচর্যার জন্য দাসদাসী। অনেকটা পথ তাঁদের এগিয়ে দিলেন স্বয়ং রাজা। কুলগুরু বশিষ্ঠ, অন্তঃপুরিকারা আর পুরবাসীরাও চললেন সঙ্গে। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে তাঁরা বিদায় দিলেন মেয়েকে। যে মেয়েকে ছোট্ট বেলায় পালক পিতার হাতে তুলে দিয়েছেন, আজ সেই মেয়েকেই নতুন করে বিদায় জানাতে বুক ভেঙে যাচ্ছে পিতার। আবেগ ধরে রাখতে না পেরে উচ্চস্বরে কেঁদে ফেলে তিনি রানীদের বলছেন— ‘শান্তাকে ভাল করে দেখে নাও গো সবাই। আবার কবে তাকে দেখতে পাবে কে জানে?’ আকুলভাবে জড়িয়ে ধরে যাত্রাকালে স্বস্তিবাক্য বলে মাথায় আশিসচুম্বন এঁকে দিলেন রানিরা। পিতৃগৃহ থেকে একরাশ ভালবাসা, আশীর্বাদ, শুভ উপদেশ মাথায় নিয়ে শান্তা বিদায় নিল স্বামীর সঙ্গে। যেদিন সে অযোধ্যায় এসেছিল মহাতপা মুনির গরবিনী পত্নী রূপে, সেদিনের আদরে আপ্যায়নে কিছুটা যেন লৌকিকতার আবরণ ছিল, সেদিন অনেক বেশি প্রয়োজন ছিল মুনিবরকে সন্তুষ্ট রাখার। আজ শান্তার বিদায়বেলায় স্নেহের টানে সেই লৌকিকতার আবরণ খসে পড়েছে। কবি ফুটিয়ে তুলেছেন নিপুণ তুলির আঁচড়ে, বাপের বাড়ি ছেড়ে আদরের মেয়ের স্বামীর সঙ্গে দূর দেশ যাত্রার ছবি।
বিদায় নিল মেয়ে। রাজা দশরথের মন জুড়ে এবার পুত্রজন্মের অধীর অপেক্ষা। —চলবে
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।