বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

জরাসন্ধের বিনাশ হল। আর তেমন প্রতিবাদী রাজা রইলেন কই! পাণ্ডবেরা নিষ্কণ্টক হয়ে রাজপাট গুছিয়ে বসলেন ইন্দ্রপ্রস্থে। সঙ্গে পেলেন সহায় কৃষ্ণকে। পাণ্ডব ভাইয়েরা রাজসূয়যজ্ঞ করবার মানসে একের পর এক রাজ্যজয় করতে বেরিয়ে পড়লেন। এমন বিপুল আয়োজন যে যজ্ঞের তাতে বহু অর্থের প্রয়োজন। অধিকাংশ রাজাই সানন্দে রাজসূয়যজ্ঞের জন্য কর দিলেন। যে রাজা যুধিষ্ঠিরের সম্রাট হওয়ার অভিলাষ মেনে নিলেন না, সেখানে হয়তো সামান্য যুদ্ধ হল। তবে ওই সামান্যই। জরাসন্ধকে নিয়ে তাঁরা যতটা চিন্তিত ছিলেন, তেমনটা আর হল না। একে একে পাণ্ডবভাইয়েরা বহু রত্নসম্ভার নিয়ে জড়ো করলেন রাজধানীতে। রাজসূয়যজ্ঞ বলে কথা! এ তো আর যে-সে আয়োজন নয়! সুবিশাল আয়োজন হল সে যজ্ঞের। সে যজ্ঞে নিমন্ত্রিতের সংখ্যাও বড় কম ছিল না। উপস্থিত হলেন সমস্ত প্রতিবেশী রাজগণ। এমন কাজ তো যুধিষ্ঠিরের প্রথম। তাই দুর্যোধন প্রভৃতিরা যতই শত্রুতা করে থাকুন না কেন, নিমন্ত্রিতের তালিকা থেকে বাদ গেলেন না কেউই। ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর যেমন এসে উপস্থিত হলেন ইন্দ্রপ্রস্থে তেমনি এলেন দুর্যোধনও তাঁর ভাইদের সঙ্গে করে। এত বাধাবিপত্তি পার করেও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আজ সম্রাট হবার পথে পা বাড়িয়েছেন যুধিষ্ঠির। কীভাবে এতসব সম্ভব হল, এ প্রশ্ন কুরে কুরে খাচ্ছে দুর্যোধনকে। শুধু দুর্যোধন কেন, এ প্রশ্ন তো আরও অনেকের। ইন্দ্রপ্রস্থে ময়দানবের সে আশ্চর্য সভা দেখতে দুর্যোধনের সঙ্গী হলেন স্বয়ং গান্ধারদেশের রাজা সুবল আর তাঁর পুত্র শকুনি। অঙ্গরাজ কর্ণও যোগ দিলেন সে দলে।

এদিকে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের মতো প্রভাবশালী পুরুষের বন্ধুত্ব পেয়ে এতটাই আপ্লুত হলেন যে কৃষ্ণকেই তাঁর হয়ে যজ্ঞ করবার কথা বলে বসলেন। বুদ্ধিমান কৃষ্ণ এ প্রস্তাব হেসে উড়িয়ে দিলেন। যুধিষ্ঠিরকে সাহস জোগালেন তিনি। কথা দিলেন সমস্ত প্রয়োজনে তিনি পাণ্ডবদের সহায় হবেন। আশ্বস্ত হলেন যুধিষ্ঠির। শুরু হল যজ্ঞের আয়োজন। প্রথা অনুযায়ী যজ্ঞ আরম্ভ করবার আগে গুরু, পুরোহিত,শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ, রাজা, বন্ধু প্রভৃতিদের মধ্যে যিনি দীর্ঘদিন ধরে যজমানের সঙ্গে বাস করছেন, এমন কোনও পূজ্যব্যক্তিকে সম্মান জানাতে হয়। কিন্তু পাণ্ডবেরা তো দীর্ঘদিন দেশছাড়া। সঙ্গে বয়ঃজ্যেষ্ঠ বলতে মা-ই ছিলেন। শেষে পিতামহ ভীষ্মের পরামর্শে স্থির হল কৃষ্ণ এই সম্মান পাওয়ার যোগ্য। কৃষ্ণের মতো বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী, পূজনীয় ব্যক্তি আর কেই-বা রয়েছেন পাণ্ডবদের জীবনে!

কৃষ্ণকে অর্ঘ্যদানের প্রস্তাব মেনে নিলেন না উপস্থিত নিমন্ত্রিত রাজাদের অনেকেই। বিরোধী রাজাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন চেদিরাজ শিশুপাল। কৃষ্ণ রাজা ছিলেন না কিন্তু তিনি বহু মানুষের আশ্রয় ছিলেন। যেমন তাঁকে ভালোবাসার লোক ছিল অসংখ্য তেমনি শত্রুও নেহাত কম ছিল না। তেমনই এক শত্রু ছিলেন চেদিরাজা শিশুপাল। মামাতো ভাই কৃষ্ণের সঙ্গে শত্রুতা তো তাঁর আজন্ম। যাদবরা কৃষ্ণ বলতে পাগল! আজ নিজের রাজ্য থেকে এত দূরে এই ইন্দ্রপ্রস্থে এসেও কৃষ্ণের জয়গান শিশুপালের মনে জ্বালা ধরাল। ভীষ্মের সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলেন তিনি। রাজসূয়যজ্ঞের সে সভা উত্তপ্ত হয়ে উঠল বাদানুবাদে। শিশুপালপক্ষীয় রাজারা কৃষ্ণ এবং তাঁকে সাহায্যকারী পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে লাগলেন। আর যৎপরোনাস্তি কটুকথায় পিতামহ ভীষ্মকে বিদ্ধ করতে লাগলেন শিশুপাল। এ পর্যন্ত শিশুপালের সমস্ত কটুকথা কৃষ্ণ সহ্য করছিলেন। প্রতিপক্ষের এমন নীরবতাও যেন শিশুপালের অসহ্য বলে মনে হতে লাগল। এবার তিনি সরাসরি কৃষ্ণকেই যুদ্ধে আহ্বান করলেন। শিশুপালের কাল যেন শিশুপালকে গ্রাস করল ধীরে। খুব ছোট থেকেই কৃষ্ণকে মোটেই সহ্য করতে পারতেন না শিশুপাল। কারণে অকারণে নানা কটূক্তি করতেন কৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে। শিশুপালের মা অর্থাত্‍ কৃষ্ণের পিসি ছেলের এই আচরণকে সমর্থন করতে পারতেন না। হাজার হোক কৃষ্ণ তাঁর দাদার ছেলে। সবাই তাকে ভালোবাসে। শুধু তাঁর ছেলেই যে কেন এমন আচরণ করে! ভয় পেতেন মা। কিন্তু ছেলে মায়ের কথা শুনলে তো! শেষে আকুল হয়ে কৃষ্ণেরই শরণাপন্ন হন, কৃষ্ণ যেন শিশুপালের এমন আচরণ ক্ষমা করে দেন, হাজার হোক ভাই তো। পিসির মুখের দিকে চেয়ে কৃষ্ণের দয়া হয়। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, শিশুপালের একশোটা দোষ মাপ করে দেবেন।

কৃষ্ণের একে একে সেসব কথা মনে পড়ল। পিসিকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেসবের সীমা আজ পার করে গেছেন শিশুপাল। কৃষ্ণের চক্রে শিশুপালের ভবলীলা সাঙ্গ হল। সভাস্থ সকলে কৃষ্ণের এমন তেজেরও সাক্ষী রইল।

এদিকে রাজসূয়যজ্ঞকে উপলক্ষ করে ইন্দ্রপ্রস্থে আসা ইস্তক দুর্যোধন মোটেই স্বস্তিতে নেই। তার ওপরে ময়দানবের তৈরি আশ্চর্য সভায় বেশ কয়েকবার অযথা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। জলাশয়ের জলকে স্ফটিক ভেবে তাতে পড়ে গিয়ে সে কী কাণ্ড! আবার সকলের মুখ চাপা হাসিকে কোনওমতে পাশ কাটিয়ে স্ফটিকময় প্রাচীরকে দরজা মনে করে তাতে আহত হলেন। মনে মনে পাণ্ডবদের এমন সমৃদ্ধি দেখে ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে খাক তো হচ্ছিলেনই। এবার যেন আগুনে ঘি পড়ল। রাগে অপমানে লজ্জায় কোনও মতে বিদায় নিয়ে ফিরে এলেন হস্তিনানগরে। পাণ্ডবদের অপকারের ইচ্ছাটা যেন এবার আরও তীব্র হল। কিন্তু সকলেই তো তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কাকেই বা বলেন মনের কথা। মামা শকুনি ইদানীং দুর্যোধনের ছায়াসঙ্গী ছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, কিছু একটা চিন্তা দুর্যোধনকে গ্রাস করেছে। কী সেটা শকুনির প্রশ্নে ঈর্ষা, ক্ষোভ মেশানো স্বরে ফেটে পড়লেন দুর্যোধন। পাণ্ডবদের এই উন্নতি তিনি আর সহ্য করতে পারছেন না। এমন দিন দেখার চাইতে মৃত্যুবরণ করা বরং ভালো। গান্ধাররাজপুত্র ভাগনের কষ্টটা বুঝতে পারছিলেন। আর এও বুঝতে পারছিলেন, একে সংযত হতে বলা এখন দুষ্কর। তিনি বুঝতে পারেন দুর্যোধনের ভবিতব্য আরও অন্ধকার পথে নিয়ে চলেছে তাঁকে। তবুও তাঁকে বোঝাবার বৃথা চেষ্টা করেন। মামার কোনও কথাই দুর্যোধনের কর্ণে প্রবেশ করে না। তিনি প্রলাপের মতো বলে চলেন, যেন তেন প্রকারেণ যুধিষ্ঠিরকে জয় করতে হবে। তীক্ষ্ণবুদ্ধি শকুনি বোঝেন, যে অন্যায়ের পথে দুর্যোধন মন চলেছে, সে পথ থেকে তাকে নিবৃত্ত করা কঠিন। এ পথই হয়তো কঠোর ভবিতব্যের পথে আরও ঠেলে দেবে। অগত্যা শকুনি অসৎপথের সন্ধান দেন তাঁকে। তিনি বলে চলেন, যুদ্ধে নয়, একমাত্র পাশাখেলায় যুধিষ্ঠিরকে পরাস্ত করা সম্ভব। যুধিষ্ঠির পাশা খেলতে তেমন দড় নন। কিন্তু এর আকর্ষণ হয়তো উপেক্ষা করতে পারবেন না। পাণ্ডবদের অধীনে আনার সেটাই হয়তো দুর্যোধনের কাছে একমাত্র উপায়! দুর্যোধন মামার এই প্রস্তাব লুফে নিলেন। মামা শকুনির মতো পাশায় দক্ষ খেলোয়াড় আর কেই-বা আছে। এবার শুধু বড়দের কোনওমতে বুঝিয়েসুঝিয়ে অনুমতি আদায়ের অপেক্ষা। ভেবেই আনন্দে আটখানা হয়ে ওঠেন দুর্যোধন।

ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

Skip to content