শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

রবীন্দ্র সদনে যৌথ আবৃত্তি পরিবেশনের আগে নীলাদ্রিশেখর-শুভ্রা বসু। বক্তব্য রাখছেন কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত।

বাচিক শব্দটি বহু পুরনো। কিন্তু আবৃত্তি ও শ্রুতিনাটক শিল্প মাধ্যমে এই বাচিক শব্দটির ব্যবহার খুব বেশিদিনের নয়। এই যে এখন অনেককে বলা হচ্ছে বাচিক শিল্পী, স্বামী-স্ত্রীকে বলা হচ্ছে বাচিক দম্পতি, এটা কিন্তু তিন দশক আগে ছিল না। আমরা শুনতাম আবৃত্তিশিল্পী, আবৃত্তি দম্পতি, শ্রুতি দম্পতি ইত্যাদি। এই ‘আবৃত্তি দম্পতি’ শিরোনামে আমি আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে আনন্দবাজার থেকে প্রকাশিত প্রবাসী আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি ফিচারধর্মী লেখা লিখেছিলাম। যেখানে আমি ইন্টারভিউ করেছিলাম নীলাদ্রিশেখর-শুভ্রা, পার্থ-গৌরী এবং জগন্নাথ-ঊর্মিমালা জুটিকে। ওই লেখায় আমি একাধিকবার এঁদের শ্রুতি দম্পতি বলেও অভিহিত করেছিলাম। নীলাদ্রি-শুভ্রা, জগন্নাথ-ঊর্মিমালার সঙ্গে আমার আগে পরিচয় হয়ে থাকলেও পার্থ ঘোষ এবং গৌরী ঘোষের সঙ্গে এই ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমেই আমার কিন্তু প্রথম পরিচয় ঘটেছিল।

ফোনে যোগাযোগ করে একদিন সকালবেলায় হাজির হলাম দমদম গোরাবাজারে পার্থ ঘোষের ফ্ল্যাটে। পার্থদা নিজেই দরজা খুলে আমাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসালেন। প্রথম দেখাতেই সৌম্যদর্শন মানুষটিকে ভালো লেগে গেল। কথা বলেন অনুচ্চ কণ্ঠে, আমার মতো উচ্চকণ্ঠে তড়বড় করে নয়। স্পষ্ট উচ্চারণ, অথচ উচ্চকিত নয়, গলায় একটু হাসকি ভাব। মাঝে মাঝে গলায় একটু সুর খেলা করে। চলনে-বলনে একটা আভিজাত্য আছে। খুব সুন্দর একটি লেডিস কাশ্মীরি শাল গায়ে জড়িয়ে রেখেছিলেন। একটু বাদে গৌরীদি এলেন। এক্কেবারে আটপৌরে ভঙ্গি, কথায় কথায় হেসে ফেলেন, একটু যেন মাতৃভাব আছে। প্রথম পরিচয়েই খুব আপনজন বলে মনে হল দুজনকেই। আমার আসার উদ্দেশ্য দুজনকে সবিস্তারে ব্যাখ্যা করলাম। ওঁরা ছাড়াও নীলাদ্রিশেখর-শুভ্রা, জগন্নাথ-ঊর্মিমালা, এই অনুষ্ঠানে থাকবেন, তাও জানালাম। তবে দ্বিতীয়ার্ধে জগন্ময় মিত্র বোম্বে থেকে সংগীত পরিবেশন করতে আসছেন জেনে দুজনেই ভীষণ খুশি হলেন। বললেন, যাব তো বটেই, শেষ পর্যন্ত থেকে ওঁর গানও শুনে আসব।

ঘরোয়া মেজাজে পার্থ- গৌরী

এসেছিলেন দুজনই। যৌথ আবৃত্তি পরিবেশন করেছিলেন। পরে আমার লেখা একটি ছোট্ট শ্রুতিনাটক ‘রিক্তাকে নিয়ে চিঠি’ পাঠ করেছিলেন। পরবর্তীকালে পার্থদা একক পরিবেশন করতেন এই শ্রুতিনাটকটি।

১৯৯২ সালে দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত আমার প্রথম শ্রুতিনাটকের বই ‘এক ডজন শ্রুতিনাটক’-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বইমেলায় এসেছিলেন পার্থ ঘোষ। তারপরও বেশ কয়েকবার আমার আমন্ত্রণে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের কামারহাটি শাখার রজতজয়ন্তী বর্ষের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় পার্থ-গৌরীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। একবারও টাকার কথা বলেননি। আমরা যা দিতে পেরেছিলাম, সেটুকুই হাসিমুখে নিয়েছিলেন। শুধু এই অনুষ্ঠান নয়, অন্যান্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও আমার বেলায় এমনটাই ঘটেছে। একবার পার্থদার কাছে আবদার করে বসলাম, আমার নতুন শ্রুতিনাটকের বইয়ের ভূমিকা লিখে দিতে হবে। প্রথমে একটু ইতস্তত করেছিলেন। বলেছিলেন, আমি তো অত ভালো লিখতে পারি না। আমার জোরাজুরিতে সেই আবদার উনি শেষ পর্যন্ত রেখেছিলেন। ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন হাফডজন শ্রুতিনাটক বইটির, যেটি আমার কাছে আজও অমূল্য সম্পদ। রবীন্দ্র পক্ষে একবার কবির একটি কৌতুক নাটিকা ‘আশ্রমপীড়া’ আমরা অভিনয় করেছিলাম কামারহাটির নজরুল মঞ্চে। পার্থ-গৌরীও ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন। উইংস-এর পাশে বসে আমাদের পুরো অনুষ্ঠানটি দেখেছিলেন। খুব প্রশংসাও করেছিলেন। এই দম্পতিকে আমার বরাবরই একইসঙ্গে ভীষণ আভিজাত্যপূর্ণ এবং মাটির কাছাকাছির মানুষ বলেই মনে হত। গৌরীদি-র আপন দাদা ছিলেন গত শতাব্দীতে উত্তম পূর্ববর্তী যুগের প্রখ্যাত নায়ক-গায়ক রবীন মজুমদার। এ ব্যাপারে ওঁকে কোনওদিনও কোনও অহংকার করতে দেখিনি। একবার এই প্রসঙ্গ তুলে ছিলাম, খুব বিনয়ের সঙ্গে দাদার ব্যাপারে দু’চারটি কথা বলেছিলেন। তবে গত আট-দশ বছর ধরে দেখছিলাম, বার্ধক্য গ্রাস করছে দুজনকেই। অথচ পছন্দের লোকজনকে সামনে পেলে হইহই করে গল্প শুরু করতেন। বছর পাঁচেক আগে দে’জ থেকে প্রকাশিত ‘৫০টি শ্রুতিনাটক’ বইয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠান করেছিলাম বাংলা আকাদেমি সভাকক্ষে। দু-জনকেই আমন্ত্রণ জানাতে ওঁদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমার মতোই কোনও প্রিয়জনকে আগে থেকেই কথা দিয়েছিলেন, তার ডকুমেন্টারিতে অভিনয় করবেন বলে। সেই জন্য আমার অনুষ্ঠানে সেবার আসতে পারেননি। সেই শেষ যাওয়া ওঁদের বাড়িতে। সামনাসামনি বসে গল্প করা, চা খাওয়া—সবই এখন স্মৃতি। কর্ণ এবং কুন্তী, দুজনই এখন অন্য জগতে পাড়ি দিয়েছেন। যে জগৎ আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে যে, পার্থদা-র মতো দরদ দিয়ে আমার শ্রুতিনাট্য ‘রিক্তাকে নিয়ে চিঠি’ আর কেউই কোনওদিনও কোনও আসরে পড়বেন না।

বইমেলায় উর্মিমালা বসু। পাশে দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিনেতা পীযূষ।

নীলাদ্রিশেখর বসুর কথা এখন ভুলে গেছেন অনেকেই। খুব কম বয়সে চলে গেছেন উনি। আমার সঙ্গে এই আবৃত্তি দম্পতির কোথায় প্রথম দেখা হয়েছিল, কিছুতেই মনে করতে পারছি না। তবে প্রথম পরিচয়ের কিছুদিনের মধ্যেই একটা পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল, যেটা সচরাচর হয় না। আমি তখন ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে কাজ করছি। আগেই বলেছি, হাসপাতালের সাহায্যার্থে আমি রবীন্দ্রসদন এবং শিশির মঞ্চে পরপর দু’বছর দুটি বড় প্রোগ্রাম অরগানাইজ করেছিলাম। সেটা ছিল ১৯৮৫-৮৬ সাল।

নীলাদ্রিদা নেপথ্যে আমাকে ভীষণভাবে সহযোগিতা করেছিলেন এই প্রোগ্রাম দুটোর ব্যাপারে। কী করে অনুষ্ঠান সাজাতে হবে, সঞ্চালনা কেমন হবে, মঞ্চসজ্জা কেমন হবে, অতিথি আপ্যায়ন কেমন হবে, এমনকী পেপারের বিজ্ঞাপনে কার নাম আগে যাবে, কার নাম পরে যাবে… সমস্ত কিছুই নীলাদ্রিদা সাজিয়ে দিয়েছিলেন এবং অবশ্যই তার সঙ্গে যোগ্য সংগত করেছিলেন তাঁর সহধর্মিণী, আমাদের সবার প্রিয় শুভ্রাবউদি। এই দম্পতির ঘর সংসারে একাধিকবার অনুপ্রবেশ ঘটেছে আমার। আমার সামনেই বহুবার দুজনের তুমুল ঝগড়া হয়েছে, নানা বিষয়ে মতের অমিল হয়েছে, বিশেষ করে আমার প্রোগ্রাম বিষয়ক ব্যাপারে। আবার কিছুক্ষণের মধ্যে সেটা মিটেও গেছে। এক অদ্ভুত ছেলেমানুষি ছিল দাদার মধ্যে। পুরুষালি গমগমে কণ্ঠস্বর, উপর-নীচ যে কোনও পর্দায় স্বচ্ছন্দ যাতায়াত… মাঝে মাঝে অদ্ভুত লাগত আমার। বউদির ছিল সুরেলা গলা। দাদার গলায় অনেক আবৃত্তি শুনেছি। তবে কানে লেগে আছে নজরুলের ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’ এবং ‘কামাল পাশা’। দাদার জোয়ারি গলার মধ্যে আমি প্রখ্যাত আবৃত্তিকার কাজী সব্যসাচীর গলার একটা মিল খুঁজে পেতাম।

বইমেলায় জগন্নাথ বসু। পাশে সাংবাদিক পথিক গুহ এবং অভিনেতা জর্জ বেকার। পিছনে উর্মিমালা বসু।

আবৃত্তি যে একটি শিল্প এবং তার চর্চার যে একটি বিজ্ঞানসম্মত দিক আছে, এটা প্রথম জেনেছিলাম নীলাদ্রিদার কাছেই। আমার নাটকের গ্রুপেও আমরা সবাই কণ্ঠশিল্পের চর্চা করি। নীলাদ্রিদা একদিন বললেন, তোদের নিয়ে একটা কণ্ঠশিল্পের ওয়ার্কশপ করতে চাই, তুই তো গলার ডাক্তার, গলার অ্যানাটমি-ফিজিওলজিটা তুই বলবি, বাকিটা আমি। বেলঘরিয়ায় শতাব্দী প্রাচীন প্যারীমোহন গ্রন্থাগারে এই ওয়ার্কশপটি হয়েছিল। প্রায় দু’ঘণ্টার এই ওয়ার্কশপ শেষে আমি সেদিন বুঝেছিলাম, গলার ডাক্তার এবং কণ্ঠশিল্পী হয়েও গলা সম্বন্ধে আমি কত কম জানি! শুধু আবৃত্তি শিল্পী নন, নীলাদ্রিদা খুব ভালো ছড়াকারও ছিলেন। সামাজিক ক্যানসার নিয়ে একটি সুন্দর ছড়া লিখেছিলেন, যেটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করতেন। রবীন্দ্র সদনের অনুষ্ঠানে আমরা যে স্মারক পত্রিকাটি প্রকাশ করেছিলাম, তাতে সেই ছড়াটি ছেপেও ছিলাম। আসর জমাবার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল দাদার। মনে আছে, বেলঘরিয়ার নন্দন নগর হাই স্কুল প্রাঙ্গণে সেবার কামার কাহিনী নাটকটি মঞ্চস্থ হবে। নাটকের আগে আবৃত্তি পরিবেশন করতে এলেন বউদি শুভ্রা বসু। একটু ঢিমেতালে অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন তিনি। অল্পবয়সি দর্শকদের পছন্দ হল না, তাঁরা চেঁচামেচি শুরু করলেন। বেগতিক দেখে নীলাদ্রিদাকে মঞ্চে তুলে দিলাম আমরা। তিনি প্রথমেই একটি ছোটদের ছড়া দিয়ে শুরু করলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্রোতাদের পাল্স বুঝে ফেলে সেই ধরনের আবৃত্তি একের পর এক পরিবেশন করে গেলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেদিন শ্রোতারা প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে অনুষ্ঠান শুনেছিলেন।

আর সব ব্যাপারে আমরা দুজন দুজনকে পছন্দ করলেও, নীলাদ্রিদা আমার একটা ব্যাপার কিছুতেই পছন্দ করতেন না। সেটি হল, শ্রুতিনাটক নামটি। আমি যতই বলতাম, নামে কী এসে যায়, এই নামটা তো সকলের কাছে ভীষণ পপুলার! নীলাদ্রিদা কিছুতেই মেনে নিতেন না। যুক্তি দিয়ে বোঝাতেন, এটাকে কণ্ঠ নাটক কিংবা নাটক পাঠ বলা যেতে পারে, কিন্তু কখনওই শ্রুতিনাটক বলা যাবে না। দাদা আমাকে ভালোবেসে ডাকতেন খণ্ড-ৎ বলে। আসলে আমি তখন খুব রোগা ছিলাম। লম্বা মানুষ রোগা হলে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে থাকে, হয়তো সেজন্যই…।

বাংলা আকাদেমিতে বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে লেখকের সঙ্গে জগন্নাথ বসু, সুধাংশু শেখর দে ও সাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য।

অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই দাদা-বউদির সঙ্গে। আমার বিয়েতে ওঁরা শুধু এসেছিলেন তাই নয়, অনেক রাত পর্যন্ত বাসরঘরে তুমুল হইচইও করেছিলেন। এমন বিখ্যাত আবৃত্তি দম্পতির স্নেহচ্ছায়ায় আমার যৌবন পর্বের অন্তত দশটি বছর কেটেছে, এ কথা ভেবে আজও এক অদ্ভুত আত্মতৃপ্তি লাভ করি আমি। দাদার অকাল মৃত্যুর পর শুভ্রাবউদি নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নেন। প্রকাশ্যে দীর্ঘদিন আর আবৃত্তি পরিবেশন করেননি। আমাদের সঙ্গেও আর যোগাযোগ রাখেননি, আমি একাধিকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। দাদা-বউদি দুজনেই চলে গেছেন, কিন্তু আত্মিক যোগাযোগটা রয়ে গেছে আজও। আমার অ্যালবামের ফটোগুলোও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও জেগে আছে।

জগন্নাথ-ঊর্মিমালাকে আবৃত্তি দম্পতি না বলে শ্রুতি দম্পতি বলতেই আমি স্বচ্ছন্দ বোধ করি। আবৃত্তি ওঁরা করেন বটে, কিন্তু শ্রুতিনাটকে ওঁদের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। বড়ি ও শ্বশুরমশাই, দূরভাষিণী, হার মানা হার, পাকা দেখা, দম্বল… নেট সার্চ করলেই অসম্ভব জনপ্রিয় এই শ্রুতিনাটকগুলো শুনতে পাবেন। এই জুটি, নাটক পাঠে সবথেকে জোর দেন কণ্ঠের উপরে। আবহসংগীতের ব্যবহার থাকে না বললেই চলে। দৃশ্যান্তরে যান শুধুমাত্র কয়েক সেকেন্ডের নীরবতায়। শুধু কণ্ঠ দিয়ে এঁরা নাটকীয় ছবি আঁকেন দর্শকের কানে এবং মনে। শ্রুতিনাটক শব্দটিতে এদের আপত্তি কোনও কালেই ছিল না। বরং বলা ভালো এঁদের হাত ধরেই শ্রুতি নাট্যচর্চা এই রাজ্যে প্রথম শুরু হয়। জগন্নাথদার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় আকাশবাণী ভবনে। নাটকে অডিশন দিয়েছিলাম। চান্স পেলাম কিনা খোঁজখবর নিতে গিয়ে একবার ওঁর ঘরে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। অবশ্য অনেক আগেই মানুষটির কণ্ঠর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম রেডিওর মাধ্যমে। অনেকের মতো আমিও তখন রেডিওর নাটক শুনতাম। অমন রোমান্টিক গলার প্রেমে সে সময় অনেকেই পড়তেন। অন্যদিকে ঊর্মিদি-র গলার আধো-আধো, আদুরে ব্যাপারটা শ্রোতাদের ভারী পছন্দের ছিল বরাবরই।

বইমেলায় আমার বই উদ্বোধনে পার্থ ঘোষ।

জগন্নাথদা-র বাড়িতে গিয়েই একদিন ঊর্মিদি-র সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল, প্রায় ৩৭ বছর আগে। প্রথম দিন থেকেই আমি ওঁকে দিদি বলেই ডাকি। আমার প্রথম শ্রুতিনাটকের বইয়ের প্রকাশ অনুষ্ঠানে বইমেলার মঞ্চে অনেক গুণীজনের সঙ্গে এই দুজনও উপস্থিত ছিলেন এবং একটি শ্রুতিনাটকও পরিবেশন করেছিলেন। পরবর্তীকালে অন্তত দশ-বারো বার এই ধরনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছেন ঊর্মিদি। জগন্নাথদা অন্তত বারপাঁচেক। শুধুমাত্র ফোনে আমন্ত্রণ জানাতেই অনেকবার এসেছেন। কখনও-সখনও বাড়িতে গিয়েও আমন্ত্রণ জানিয়েছি। ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালের সাহায্যার্থে রবীন্দ্র সদনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আশির দশকের মধ্যভাগে আমি তিন আবৃত্তি দম্পতিকেই মঞ্চে হাজির করতে পেরেছিলাম। এই বসু দম্পতিও ছিলেন তাঁদের মধ্যে। এইভাবে এই দম্পতির সঙ্গে আমার একটা শ্রুতি বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল প্রায় চার দশক আগেই। নাটক নিয়ে আমার এই পাগলামিটাকে ওঁরা দুজনেই খুব মদত দিতেন। পরবর্তীকালে গত ১৫ বছরে আমাদের সম্পর্কটা আরও সুদৃঢ় হয়েছে, আমার মেয়ে অর্কমিতা জগন্নাথদার কাছে আবৃত্তির ক্লাস শুরু করার পর। শুধু শ্রুতি বা আবৃত্তিশিল্পী নন, জগন্নাথদা একজন খুব ভালো লেখকও। দীর্ঘদিন আকাশবাণীতে এবং দূরদর্শনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন উনি। এসেছেন বহু বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে। তাঁদের নিয়ে একাধিক বইও আছে ওঁর। আমি পড়েছিও সেগুলো। খুবই সুখপাঠ্য এবং নানা অজানা তথ্য ও ঘটনায় ভরা। আবৃত্তি বিষয়ক বইও আছে, আছে তাঁর সম্পাদনায় একাধিক শ্রুতিনাটকের সংকলনও। জগন্নাথদা-র আমন্ত্রণে সেই সংকলনগুলোর কয়েকটিতে আমার হাসির নাটকই স্থান পেয়েছে। জগন্নাথদা আমার কাছে হাসির-মজার নাটকই চাইতেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত ৫০টি শ্রুতিনাটক বইটির ভূমিকা লিখিয়েছিলাম দাদাকে দিয়ে। শ্রুতিনাটক এবং আমি, এই দুইয়েরই চমৎকার মূল্যায়ন করেছিলেন লেখাটিতে। বাংলা আকাদেমিতে এই বইয়ের উদ্বোধন করেছিলেন দাদা নিজেই। পরিবেশন করেছিলেন একটি শ্রুতিনাটকও। এই সব কিছুই আমার কাছে এক বিরাট প্রাপ্তি। আমার অনুষ্ঠানে জগন্নাথদা অনেকবারই এসেছেন, কিন্তু কখনও কোনও সময় পারিশ্রমিকের কথা বলেননি। আমার মেয়ে ডেন্টালে ভর্তি হওয়ার পর পারিবারিক গেট টুগেদারে বসু দম্পতি এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। চমৎকার কেটেছিল সেই সন্ধ্যা। ডাক্তারি ব্যাপারে অনেকবারই পরামর্শ নিয়েছেন আমার। করোনায় আক্রান্ত হয়ে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন গত বছর। মেয়ে আমাকে বলল, তোমার সঙ্গে স্যার একটু কথা বলতে চান, তুমি ফোন করো। আমি মেয়েকে বললাম, উনি তো ভর্তি আছেন করোনা নিয়ে, চিকিৎসাও হচ্ছে, আমি এ ব্যাপারে আর কী কথা বলব! তবু মেয়ের জোরাজুরিতে দাদাকে ফোন করেছিলাম। ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। কোনও পরামর্শ নয়, শুধুমাত্র আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য ওঁর এই আকুলতা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বয়স হচ্ছে জগন্নাথ-ঊর্মিমালারও। কিন্তু এই বয়সেও দুজনে অসম্ভব হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চল। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা, যাঁরা ওদের কাছে ক্লাস করেন, কিংবা করেন না, তারাও ভীষণ ভীষণ পছন্দ করেন ওঁদের। দুজনেই অসম্ভব মিশুকে, কণ্ঠে এখনও তাদের তরুণ বয়সের সজীবতা। শুধুমাত্র বই বা স্ক্রিপ্ট দেখে কিছু পাঠ করে, তাঁরা আমাদের চোখের সামনে এখনও একের পর এক নাটকীয় ছবি আঁকতে পারেন। এই তারুণ্য, এই প্রাণের উচ্ছ্বাস আমৃত্যু ধরে রাখুন এঁরা, আমাদের চোখে শ্রুতি দম্পতি হয়েই বেঁচে থাকুন, এই গুণমুগ্ধর প্রার্থনা শুধু এটাই।

ছবি: লেখক

Skip to content