সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪


দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ অগ্ৰজ দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন বড় দার্শনিক। অঙ্কে সুপণ্ডিত। প্রাবন্ধিক ও কবি। নানা ক্ষেত্রে কৃতিত্ব, নানা দিকে অবাধ বিচরণ। কৃতিত্ব- পারদর্শিতার সেসব কথা বলতে গিয়ে নানা বিশেষণ তাঁর নামের আগে-পরে ব্যবহার করা যেতে পারে। দ্বিজেন্দ্রনাথের সত্যি গুণপনার শেষ ছিল না! তাঁকে নিয়ে কত না গল্পকথা! সব গল্পই মজার। আপাতভাবে হাস্যরসাত্মক, আসলে তাঁর খেয়ালিমনের পরিচয়বহ। এমন কিছু ঘটনার কথা আরেক পর্বে বলাও হয়েছে। এবার নতুনতর কিছু।

পিতার মৃত্যুর পর দ্বিজেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে স্থায়ীভাবে থাকতেন। পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথ ও পৌত্র দিনেন্দ্রনাথও ছিলেন শান্তিনিকেতনের স্থায়ী অধিবাসী। দ্বিপেন্দ্রনাথের প্রথমা পত্নী সুশীলার সঙ্গে দশ বছরের বিবাহিতজীবন। দুই সন্তানসন্ততির জননী সুশীলার মৃত্যু হয় অকালে। প্রথমা পত্নীর মৃত্যুর মাত্র এক মাস পাঁচ দিন পর দ্বিপেন্দ্রনাথ হেমলতা দেবীকে বিবাহ করেছিলেন।

হেমলতা রামমোহন রায়ের পরিবারের, জ্যেষ্ঠ পুত্র রাধাপ্রসাদের দৌহিত্র ললিতমোহন চট্টোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় কন্যা। ‘আত্মীয়সভা’র সূত্রে বিবাহের পূর্বে ঠাকুরবাড়িতে হেমলতার আসা-যাওয়া ছিল। পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় তো বটেই, প্রয়াণের পরও দ্বিজেন্দ্রনাথ থাকতেন পুত্রবধূর তত্ত্বাবধানে।
দ্বিপেন্দ্রনাথের জীবনে সামান্যও শৃঙ্খলা ছিল না। খানিক বেপরোয়া জীবনযাপন। খেসারতও দিতে হয়েছিল তাঁকে। দীর্ঘ জীবনের অধিকারী হননি। রবীন্দ্রনাথের সমকালে জন্ম, মৃত্যু হয়েছিল অন্তত বছর কুড়ি আগে।

সন্তানহীনা হেমলতার কাছে আশ্রম-পড়ুয়ারা ছিল সন্তানতুল্য। খুদে পড়ুয়াদের দেখশোনা করতেন। ছিলেন অত্যন্ত স্নেহময়ী। খুদে পড়ুয়াদের দেখাশোনা, পরিচর্যা তো ছিলই, সে সব সামলে হেমলতা তাঁর শ্বশুরমশাইয়ের জন্যও অনেক সময় দিয়েছেন। সারল্যে ভরপুর দ্বিজেন্দ্রনাথ হেমলতার কাছে ছিলেন ‘ছেলেমানুষের প্রতিমূর্তি’। তাঁর লেখায় আছে, ‘শিশুপ্রকৃতির শ্বশুরমহাশয়ের শখ ছিল সামান্য, তাই চাওয়াও ছিল তাঁর যৎসামান্য।’ হেমলতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন ‘শ্বশুরমহাশয়ের বালকোচিত স্বভাবের বহু দৃষ্টান্ত। সেসব তিনি কিছু লিখেও রেখেছিলেন। ভাগ্যিস লিখে রেখেছিলেন, অমন বড় মানুষের ‘ছেলেমি’র গল্পকথা না জানলে মানুষটিকেই তো আমাদের পুরো জানা হত না!

দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমরা দ্বিজেন্দ্রনাথের খেয়ালিপনার কিছু গল্প আগে বলেছি। হেমলতার রচনার সূত্র ধরে আরও দু-একটি বলা যেতে পারে। দ্বিজেন্দ্রনাথ থাকতেন গুরুপল্লি ‘নিচুবাংলো’য়। একদিন বাড়িতে হঠাৎই হুলুস্থুল কাণ্ড। দ্বিজেন্দ্রনাথ এমন চেঁচামেচি-গোলমাল জুড়ে দিয়েছিলেন, আশপাশের গাছগাছালিতে পাখপাখালি যত ছিল, সক্কলে উড়ুৎফুড়ুৎ উড়ে গেল। গৃহভৃত্যরা ভয় পেয়ে এ-ওর মুখের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিল।

‘বাবামশায়’ যখন হইহই বাঁধিয়েছেন, নিশ্চয়ই তেমন কিছু ঘটেছে! কী ঘটেছে, প্রথমে ভৃত্যরা কেউই বুঝতে পারেনি। একটু পরেই জলের মতো স্পষ্ট হয়েছে সব। বুঝতে পেরেছে, তাঁর চশমা পাওয়া যাচ্ছে না, তাই এই হুলুস্থুল কাণ্ড! পুত্রবধূ হেমলতাই ভরসার জায়গা, তিনিই খুঁজে দিতে পারবেন, তাই শ্বশুরমশাইয়ের জরুরি তলব!

হেমলতা জানতেন, দেরি করলে ডাকাডাকি আরও বাড়বে, সুর উঠবে সপ্তমে। দৌড়ে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন শ্বশুরমশাইয়ের সামনে। দেখলেন, টেবিলে হাত ঠুকছেন আর বলছেন, ‘এখন আমি কী করি, কী করে দেখি, কী করে পড়ি, চশমা না হলে আমার একদণ্ডও চলবে না!’ এসব বলে দায় চাপালেন চাকরদের ঘাড়ে। বললেন, ‘চাকরদের কাণ্ড, ওরাই আমার দামি চশমা হারিয়ে ফেলেছে!’
তাদের বকাঝকা করে, ঘাড়ে সব দোষ-দায় চাপিয়ে পরম নির্ভরতায় হেমলতাকে হারানো চশমা খুঁজে দিতে বলেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ।

হেমলতা এটা সরান, ওটা সরান, এদিকে দেখেন, ওদিকে দেখেন! কাগজপত্তর, বইখাতা সব উলটেপালটে দেখেও চশমা পেলেন না। শেষে হতাশ হয়ে যেই তাঁর বাবামশাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়েছেন, মুহূর্তেই চশমা আবিষ্কৃত হয়ে যায়। বিস্ময়ের আর শেষ থাকে না।

চশমা তো চোখে! সেদিকে কারও নজর পড়েনি। হেমলতা বললেন, ‘বাবামশায় চশমা আপনি চোখেই পরে আছেন!’

সেকথা শুনে দ্বিজেন্দ্রনাথ ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। হাত দিয়ে সেই চশমার উপস্থিতি টের পাওয়ার পর উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করেছিলেন। হেমলতা লিখেছেন, ‘হাসির চোটে ঘণ্টাব্যাপী চেঁচামেচির ঝাঁজ মুহূর্তে কর্পূরের মতো গেল উবে। খুশির হাল্কা হাওয়ায় ঘর উঠল ভরে।’

হেমলতা দেবী

হঠাৎ একদিনের বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়, এমন কোনও না কোনও ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটত।

দ্বিজেন্দ্রনাথ শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা প্রতিদিনই স্নান করতেন। সাতসকালে, খুব ভোরে তাঁর এই স্নান করা হয়ে যেত। হঠাৎই তাঁর জ্বর হয়েছিল, অল্পস্বল্প নয়, থার্মোমিটারে একশো চার। সবাই আতঙ্কিত, কী করে তাঁকে সামলাবেন, স্নান করা থেকে বিরত করবেন, সেসব নিয়ে ভাবনার আর শেষ রইল না। হেমলতা দেবীই শুধু ভাবিত নন, গৃহভৃত্যদের চোখেমুখেও দুশ্চিন্তার ছাপ।

সকলেই কম-বেশি চিন্তিত। একমাত্র ব্যতিক্রম দ্বিজেন্দ্রনাথ। এত টেম্পারেচার, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, না, সেসব নিয়ে তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই। নির্বিকারভাবে কবিতা আওড়াচ্ছেন। আবার কখনও মুখে মুখে নতুন কবিতা বলে যাচ্ছেন, সে কবিতা হেমলতা দেবীকে লিখে নিতে হচ্ছে।

বাড়ির কেউই নিশ্চিন্তে নিরুদ্বেগে ছিলেন না। ছিলেন ঘোরতর দুশ্চিন্তায়। হেমলতা দেবী গৃহভৃত্যদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন, দ্বিজেন্দ্রনাথকে স্নান করতে আগেভাগে নিষেধ করা যাবে না, নিষেধ করলে বায়নাক্কা করবেন, জিদ দেখাবেন।

বাড়ির ভৃত্যদের হেমলতা বলে দিয়েছিলেন, বাবামশায় জ্বর নিয়ে রোজের মতো স্নান করতে উঠলেই তাড়াতাড়ি খবর দিতে। আগ বাড়িয়ে এখনই মুখে কিছু বলার দরকার নেই, সে-সময়ই না হয় থামানো যাবে!

তখনও ভালো করে সকাল হয়নি। দ্বিজেন্দ্রনাথ রোজের মতো সেদিনও উঠে পড়েছিলেন। আড়াল থেকে সব দিকে গৃহভৃত্যরা নজর রাখছিল। কালবিলম্ব না করে তখনই তারা ছুটল হেমলতা দেবীর কাছে। জানাল, দ্বিজেন্দ্রনাথ স্নানের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন।

হেমলতা দেবী পড়ি-মরি তখনই ছুটে এসেছিলেন। এসে যা দেখেছিলেন, তা অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল তাঁর!

বউমা যদি কোনওভাবে খবর পেয়ে যায়, তাহলে তো ঘোরতর বিপদ! হেমলতা আসার আগেই তাই দ্বিজেন্দ্রনাথ নিমেষে কাজ সেরে ফেলেছিলেন। মগ দিয়ে গায়ে মাথায় জল না ঢেলে, জল রাখা মস্ত এক টবে গিয়ে বসে পড়েছিলেন। মনের সুখে, আনন্দে স্নান সেরে নিয়েছিলেন।

দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর

এত জলে স্নান, ঠান্ডা লাগবে নির্ঘাত, বকুনি আছে কপালে, এসব ভেবে দ্বিজেন্দ্রনাথ শেষে কম্বলমুড়ি দিয়ে গিয়ে বসেছিলেন বারান্দায়। তাঁকে এই অবস্থায় দেখে হেমলতা দেবী একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলেন, মুহূর্তে চিন্তার আঁকিবুকি ফুটে উঠেছিল চোখেমুখে!

দ্বিজেন্দ্রনাথ আশ্বস্ত করেছিলেন বউমাকে। বলেছিলেন, ‘রোগের জন্য ভাবো কেন, আমি নিজের চিকিৎসা নিজে খুব ভালো জানি।’ এই বলে ফরমাশ করেছিলেন, ‘যাও, খিচুড়ি তৈরি কর গিয়ে।’

দিনভর চলত এমন কত কাণ্ড! সবই মজাদার। দ্বিজেন্দ্রনাথের মনে কোনও জট-জটিলতা ছিল না। তাই এসব করতেন, বলতেন সহজভাবে। প্রতিদিন খুব ভোরে উঠে বেড়াতে বের হতেন তিনি। পা ফেলতেন সংখ্যা গুনে গুনে। সে সময় সামনে গিয়ে কেউ পড়লে, সংখ্যা গণনায় বিঘ্ন ঘটত। খুব রেগে যেতেন দ্বিজেন্দ্রনাথ।

দ্বিজেন্দ্রনাথের খেয়ালিপনার শেষ ছিল না। হঠাৎ-হঠাৎ এমন সব কথা তাঁর মনে হত, যা শুনলেই সকলে হো-হো করে হাসত। হয়তো কখনও মনে হত, ‘একি লুচি, ঘি চপচপ করছে সারা গায়ে!’ একটু থেমে হয়তো বলতেন, ‘লুচি তেলে নয়, জলে ভাজতে হয়।’

হেমলতা দেবীর লেখা থেকে জানা যায়, এমন সব কথা বলার পর দ্বিজেন্দ্রনাথ সরল মনে স্বীকারও করতেন, ‘আচ্ছা কাণ্ড আমার, কী বলতে কী বলি, তোমাদের জ্বালিয়ে মারি! তোমরা যা ভালো বোধ কর, তাই কর…।’ এসব বলেই সশব্দে তাঁর পাড়া-জাগানো হাসি।

শিশুর সারল্যে দ্বিজেন্দ্রনাথ এ-সব বলতেন, করতেন। কৃতিত্বের শিখরস্পর্শ করা মানুষটির মধ্যে অনাবিল সারল্য ছিল। একটু বেশি রকমই ছিল। এমন প্রাণবন্ত, প্রাণরসে উজ্জীবিত মানুষ খুব বেশি দেখা যায় না।

ছবি সৌজন্যে: লেখক

* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content