শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


তিরিশ বছর আগে। মাঝখানে ডা: সুনীল ঠাকুর।

সালটা ছিল ২০০৭, অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক পনেরো বছর আগের ঘটনা। সেই বছরই মুক্তি পেয়েছিল হরনাথ চক্রবর্তী পরিচালিত এবং মিঠুন চক্রবর্তী অভিনীত ‘তুলকালাম’ সিনেমাটি। সেই সময় সিঙ্গুরে জমি দখল করে শিল্প স্থাপনকে ইস্যু করে বিভিন্ন বিরোধী দল আন্দোলন করছিলেন। তুলকালাম সিনেমাটিও ছিল এই কৃষি জমি দখলকে নিয়েই। আর ছিল এই সিনেমাটির প্রধান চরিত্রে মিঠুন চক্রবর্তীর লার্জার দ্যান লাইফ হিরোইক ইমেজ। ফলে দুয়ে দুয়ে চার হতে বেশি সময় লাগেনি। ছবি হয়ে গেল সুপার ডুপার হিট। আজও কিছুদিন বাদে বাদে টিভির পর্দায় এই সিনেমাটি দেখানো হয় এবং দর্শকেরা যথারীতি আগের মতোই এটি উপভোগ করেন। ঘটনাচক্রে এই ছবিতে আমি মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করার সুযোগ পাই একটি গুরুত্বপূর্ণ রোলে। সিনেমাটি হিট হওয়াতে আমার অভিনীত চরিত্রটিও হিট হয়ে যায়। তিন তিনবার সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত মিঠুনের সঙ্গে সেই আমার প্রথম এবং শেষ কাজ।

পাপ্পু ওরফে অমিত ছিল হরনাথদা’র প্রধান সহকারী পরিচালক। একদিন ফোন করে বলল, হরদা আপনার সঙ্গে কথা বলবে। ফোন ধরলাম। হরদা বললেন, আপনার জন্য একটি সুখবর আছে অমিতাভদা। আপনি আমার নতুন ছবি তুলকালামে মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে একজন ডিএসপি পদমর্যাদার পুলিশ অফিসারের রোল করবেন। শুনে আনন্দে আটখানা হয়ে বললাম, সত্যি বলছেন হরদা! হরদা মজা করে বললেন, সত্যি সত্যি সত্যি, তিন সত্যি।
হরদা-র ঘরে ইতিমধ্যেই আমি আটটি সিনেমায় অভিনয় করে ফেলেছি। কিন্তু মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে অভিনয়! স্বপ্নেও ভাবেনি কোনও দিন।

অবশেষে সেই স্বপ্ন সত্যি হল। ইন্ডিগো ফ্লাইটে যখন ব্যাঙ্গালোরে এসে নামলাম, তখন ভরদুপুর। এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে দেখলাম প্রোডাকশনের প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর সঙ্গে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি ছুটল মাইশোরের দিকে। তিন দিন আগেই পুরো ইউনিট চলে এসেছিল সেখানে। পুরোদমে কাজও শুরু হয়ে গিয়েছিল। মাইশোরে হোটেলে পৌঁছে স্নান-খাওয়া করতে না করতেই পাপ্পু ফোন করল, নীচে গাড়ি রেডি আছে দাদা, আপনি লোকেশনে চলে আসুন। চোখ কপালে তুলে বললাম, আজকেই শ্যুটিং আমার! বলল, হ্যাঁ, এক্ষুনি লাগবে আপনাকে। গাড়ি চেপে দুরু দুরু বক্ষে শ্যুটিং লোকেশনে পৌঁছলাম, হোটেল থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে এক বাংলো প্যাটার্নের বাড়িতে। মেকআপ করে পুলিশ অফিসারের পোশাক পরে আমার ডায়লগগুলো মন দিয়ে বারবার পড়ছিলাম, কিন্তু মনঃসংযোগ করতে পারছিলাম না। একটা চাপা টেনশনে ভেতরটা কুরে কুরে খাচ্ছিল।

তুলকালাম সিনেমায় বাঘের পাশে এক চুহা।

অথচ এমন নয় যে মিঠুনকে আমি এই প্রথম দেখব। আজ থেকে বছর তিরিশেক আগে অর্থাৎ যে বছর (২০০৭) তুলকালামের শ্যুটিং করেছিলাম, সেই বছর থেকে আরও ১৫ বছর আগে মিঠুন চক্রবর্তীকে আমি দু-তিন বার দেখেছি, তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি, একবার থ্যালাসেমিয়ার জন্য টাকা তুলতেও গিয়েছিলাম ওঁর সঙ্গে। থ্যালাসেমিয়া নিয়ে কলকাতা প্রেসক্লাবের এক অনুষ্ঠানে মিঠুনের সঙ্গে আমাকে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আমার মাস্টারমশাই প্রখ্যাত অস্থি রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ সুনীল ঠাকুর। মিঠুনের সমাজসেবার কথা আপনারা অনেকেই জানেন। বহু দুঃস্থ মানুষকে এবং সমাজসেবী সংস্থাকে এক সময় উনি বহু বছর ধরেই নিয়মিত অর্থ সাহায্য করে গেছেন। রাজনীতির পাকেচক্রে পড়ে এখন আর তিনি এমনটা করেন কি না, জানি না! তবে তখন করতেন। ডাকলেই চলে আসতেন বহু অনুষ্ঠানে। শর্ত থাকত, তাঁর হাতে নগদ ২৫ হাজার টাকা তুলে দিতে হবে এবং যেটি তিনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই থ্যালাসেমিয়া নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের কারও হাতে তুলে দিতেন। এই ঘটনার সাক্ষী আমি নিজেই। একবার ওঁর সঙ্গে হাওড়াতে এইরকম একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়েছিলাম। মিঠুনকে ধরে টানাহেঁচড়া হয়েছিল চোখের সামনেই। তখনও বাউন্সারের যুগ আসেনি। এখন যেমন পাড়ার চুনোপুঁটি নেতা, প্রোমোটার, সিন্ডিকেটের দালাল থেকে দু-চারটে সিরিয়ালে মুখ দেখানো অনেক অভিনেতাও বাউন্সার রাখেন, তখন তেমনটি ছিল না। দু-তিনজন বডিগার্ড বা দেহরক্ষী রাখতেন কেউ কেউ। মিঠুনেরও তেমন কয়েকজন ছিল। তারাই অনেক কষ্টে ওঁকে উদ্ধার করে গাড়িতে তুলে দিয়ে সেই যাত্রা বাঁচিয়েছিল। তখন কলকাতায় মিঠুনের ছায়াসঙ্গী থাকতেন সুজিত বসু, যিনি বর্তমানে মন্ত্রী। ডাঃ সুনীল ঠাকুরের ছেলে সুমন্তর বিয়ের বউভাতের অনুষ্ঠানে আমি শেষবার মিঠুন চক্রবর্তীকে দেখেছিলাম। তারপর আজ আবার দেখব। শুধু দেখব নয়, একসঙ্গে অভিনয়ও করব। এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতেই আমার ডাক পড়ল শ্যুটিং জোনে। তখন টিফিন ব্রেক চলছে। বেশ বড়সড় একটা আরামকেদারায় বসে পায়ের উপর পা তুলে মিঠুন ঠোঙা থেকে মুড়ি খাচ্ছিলেন। হরদা ওই অবস্থায় মিঠুনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাকে। আমি হাতজোড় করে নমস্কার করলাম। মিঠুন প্রত্যুত্তরে মুড়ি বদ্ধ ডান হাতের মুষ্টি উপরে তুললেন।

শুরু হল শ্যুটিং। প্রথমে একটা মাস্টার শট, যেখানে আমার অফিসে টেবিলের উলটোদিকে দাঁড়িয়ে মিঠুন, আর আমি আমার চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে, এককথায় দুজনে মুখোমুখি। বাঘের উলটোদিকে দাঁড়িয়ে এক চুহা। একবার রিহার্সালের পর শট নেওয়া হল। এক শটেই ওকে। আমার তো ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। কনফিডেন্স লেভেলটাও যেন ধুম করে হঠাৎ বেড়ে গেল। এবার ক্লোজ শট নেওয়া হবে, লাইট চেঞ্জ হবে, কিছুক্ষণ বিরতি। হরদা ডেকে নিয়ে মিঠুনের পাশে বসালেন। টিফিন এল। ওদের গল্প শুনতে শুনতে মুড়ি তেলেভাজা চা উদরস্থ করতে লাগলাম। ক্লোজ শটে ক্যামেরা প্রায় আমার মুখের উপর। মিঠুনের সংলাপের পালটা বলব আমি। সাধারণত, এক্ষেত্রে ক্যামেরার পিছনে দাঁড়িয়ে মিঠুনের সংলাপ বলবেন যে কোনও একজন সহকারী পরিচালক। কিন্তু হঠাৎ মিঠুন তাঁর আরামকেদারা ছেড়ে উঠে এসে ক্যামেরার পিছনে দাঁড়িয়ে বললেন, হর, আমি আমার সংলাপগুলো বলছি। আমার তো এটা শুনেই অবস্থা খারাপ হয়ে গেল, যেটুকু কনফিডেন্স লেভেল বেড়েছিল, তার সবটাই নেমে গিয়ে মাইনাসে চলে গেল। আমার উলটোদিকে ক্যামেরার পিছনে দাঁড়িয়ে আবার সেই বাঘ, আমাকে তার চোখে চোখ রেখে গরম গরম সংলাপ বলতে হবে। আমার অবস্থা দেখে সহকারী পরিচালক পাপ্পু এগিয়ে এসে কানে কানে বলল, আপনার সংলাপ আমি বলে বলে যাব, আপনি শুনে শুনে বলবেন। একটু যেন আত্মসম্মানে লাগল আমার, বললাম প্রয়োজন নেই, সংলাপ আমার মুখস্থই আছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে, মানুষ যেমন ঘুরে দাঁড়িয়ে একবার বাঁচার শেষ চেষ্টা করে, আমিও সেভাবেই মরিয়া হয়ে মিঠুনের চোখে চোখ রেখেই সংলাপ বললাম। ডিরেক্টর হরদা ‘কাট’ বলতেই মিঠুন মৃদু হেসে একটা থামস আপ দেখালেন। তখন আর আমায় পায় কে! আমিও পালটা একটা অস্কার জয়ী দাঁত ক্যালানো হাসি দিলাম। মিঠুন সেটা দেখতে পেলেন কি না, তা আর খেয়াল করলাম না।

এই দৃশ্যটি অবশ্য পরে বাদ গিয়েছিল।

সত্যি কথা বলতে কি, এরপর থেকেই মিঠুনের সঙ্গে আমি অনেকটা সহজ হয়ে গেলাম। ডাক্তার-অভিনেতা বলে হরদা-র ইউনিটে প্রথম থেকেই আমার একটা সম্মানের জায়গা ছিল, ভালোবাসা-খাতির একটু বেশি বেশিই পেতাম। আজকের পর থেকে সেটা আরও বেড়ে গেল। আমাদের সিনের পরেই শ্যুটিং প্যাক-আপ হয়ে গেল। তখন অব্দি জানতাম, মিঠুনের সঙ্গে সিনেমার শেষ দৃশ্য আমার একটি ক্লাইম্যাক্স সিন আছে, অনেক লম্বা চওড়া ডায়লগও আছে। আসলে তুলকালামে মিঠুন একজন আইবি অফিসার, তাঁকে আমি একটি গ্রামীণ থানায় কিছু দায়িত্ব দিয়ে পাঠাচ্ছি, সেখানকার দুষ্কৃতীদের দমন করে আইনের শাসন ফিরিয়ে আনতে। অনেক লড়াইয়ের পর মিঠুন সেই ব্যাপারে সফল হন এবং আমি গ্রামে এসে গ্রামবাসীদের পুরো ব্যাপারটা বলে মিঠুনকে সসম্মানে ফিরিয়ে নিতে আসব—এমনটাই ছিল মূল চিত্রনাট্যে। সেদিনের শ্যুটিং শেষ হওয়ার পর ছবির সিনেমাটোগ্রাফার আমাকে বললেন, অমিতাভদা আপনার শ্যুটিং তো শেষ, রাতের ফ্লাইটেই ব্যাক করে যান। আমি বললাম, সে কী! স্ক্রিপ্টে তো দেখলাম, আমার একটা লম্বা সিন আছে সিনেমার একদম শেষে। আছে জানি, তবে প্রতিটি সিনই মিঠুনদার সঙ্গে কথা বলে তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী সাজানো হচ্ছে। মনে হয় এই সিনটায় আপনাকে লাগবে না, জানালেন সিনেমাটোগ্রাফার।

কথাটা শুনে একটু খারাপ লাগল। কিন্তু আমার তো দু’দিন পরের ফেরার টিকিট কাটা আছে ফ্লাইটের। হোটেলে ফিরে একটু রেস্ট নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় রিসেপশন থেকে বাড়িতে ফোন করছিলাম। দেখলাম সদলবলে হরদা লিফট থেকে বেরিয়ে রিসেপশনে চাবি জমা দিলেন। আমায় দেখে বললেন, ফ্রি থাকলে চলুন, মিঠুনদার হোটেল থেকে ঘুরে আসি। আমি তো একপায়ে খাড়া। আমরা জনা পাঁচেক টাটা সুমো চেপে মিনিট তিরিশের মধ্যেই হাজির হলাম মিঠুনের হোটেলে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, উটি ছাড়াও আরও কয়েকটি জায়গায় সেই সময় মিঠুনের হোটেল ছিল (এখন আছে কি না জানি না), যার মধ্যে মাইশোর ছিল অন্যতম। হোটেল চত্বর জুড়ে অনেকগুলো সুদৃশ্য কটেজ। আমরা একটি কটেজে ঢুকে ড্রইং স্পেসে বসলাম। মিঠুন চক্রবর্তী একটু বাদে স্নান সেরে খালি গায়ে একটি লুঙ্গি পরে আমাদের উলটোদিকের ডিভানে বসলেন। একটা কথা এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, মিঠুনের মধ্যে একটা সহজ স্বাভাবিক আটপৌরে ব্যাপার বরাবরই ছিল। আসলে তীব্র অভাবের সঙ্গে লড়াই করে উত্তর কলকাতার এঁদো গলি থেকে উঠে আসার সেইদিনগুলোকে মিঠুন কোনওদিনই ভুলতে পারেননি। মিঠুন কিন্তু তখন শুধু একজন সফল অভিনেতা নন, একজন সফল শিল্পপতিও বটে। অথচ আমার উলটোদিকে বসে থাকা ৫৮ বছর বয়সি পেটানো চেহারার বাদামি ত্বকের স্বল্প কেশের মানুষটিকে দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই। হাসি মশকরায় একাই আসর জমিয়ে দিলেন। কাজু-কুকিজ সহযোগে চা পানের সঙ্গে সঙ্গে আমি মানুষটাকে দুচোখ ভরে দেখে যেতে থাকলাম। কারণে-অকারণে যখন হো হো করে হেসে ওঠেন, তখন মানুষটিকে আরও সুন্দর লাগে। আড্ডা মারতে মারতে মাঝে মাঝেই লুঙ্গিটাকে হাঁটু অবধি তুলে ফেলছিলেন। দেখছিলাম আর আমি ভাবছিলাম, এই দুটো ঠ্যাং ডিস্কো ড্যান্সার-এ কী নাচটাই না নেচেছিল! আজ সারা দিন যেসব শট নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো ল্যাপটপের স্ক্রিনে মিঠুনকে দেখানো হল। উনি নানারকম মতামত দিলেন, কিছু কারেকশনের কথাও বললেন। এরপর হরদা আগামীকালের সিনগুলো নিয়ে আলোচনায় বসলেন। দেখলাম এবং শুনলাম, আমার কোনও সিন আগামীকালের শিডিউলে নেই। তবে কি সিনটা বাদ গেল, নাকি পরশু হবে! কিন্তু পরশু তো মর্নিং ফ্লাইটে আমি ব্যাক করব। টিকিটও কাটা আছে। কী হবে তাহলে! ফেরার পথে হরদাকে সব বললাম। শুনে বললেন, চিন্তার কিছু নেই আপনার সিনটা কলকাতায় ফিরে গিয়েই করব। সেই সিন কিন্তু আর হয়নি। শুধু তাই নয়, আমার রোলটাও পালটে গেল এই সিনেমায়। সে গল্প আগামী পর্বে বলব।

Skip to content