শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


আনন্দ আশ্রম ছবিতে উত্তমকুমারের সঙ্গে দাদামণি।

চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি টিভি সিরিয়ালেও অভিনয় করেছেন অশোককুমার৷ কীভাবে নিজেকে তৈরি করেছিলেন দাদামণি? তিনি বেশ জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা যাঁরা অভিনয় করি, অন্যদের অভিনয় আমাদের বেশি করে দেখা উচিত৷ আমার মধ্যে যেটার অভাব সেটা ধীরে ধীরে মেরামত করে নিতে পারলেই আর সমস্যা থাকে না৷ আমার অভিনয়ের অনেক দোষত্রুটি ছিল৷ কিছু কিছু কাটাতে পেরেছি৷ তবে আজও মনে হয়, আমি একজন শিক্ষার্থী৷ ক্যামেরার সামনে যখন দাঁড়াই মনে করি, এই প্রথম ক্যামেরা ফেস করছি৷’

হলিউডের ছবি দেখার প্রচণ্ড নেশা ছিল অশোককুমারের৷ তাঁর প্রিয় অভিনেতা ছিলেন হামফ্রে বগার্ট, রবার্ট ডি নিরো, মার্লন ব্র্যান্ডো প্রমুখ৷ নায়িকাদের মধ্যে ভীষণ পছন্দ করতেন অড্রে হেপবার্ন, জুলি ক্রিষ্টি, সোফিয়া লোরেন এবং এলিজাবেথ টেলরকে৷ পরবর্তী প্রজন্মের পছন্দের তালিকায় প্রথমেই ছিলেন টম ক্রুজ, তারপর লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও৷ পছন্দ করতেন জুলিয়া রবার্টসকেও৷ হলিউডের ছবি, হিন্দি, বাংলা বা অন্য ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষার ছায়াছবি দেখার পর বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে বসে যেতেন দাদামণি৷ হাঁপানির কষ্ট৷ তবুও সিগারেট ছাড়তে পারেননি৷ বাংলা ছবির প্রতিও যথেষ্ট শ্রদ্ধার মনোভাব পোষণ করতেন৷ ছবি বিশ্বাসের গুণমুগ্ধ ছিলেন৷ উত্তমকুমারকেও ভীষণ পছন্দ করতেন৷ ‘হসপিটাল’, ‘হাটেবাজারে’, ‘আনন্দ আশ্রম’ প্রভৃতি বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন দাদামণি৷

অশোককুমার মারা যাওয়ার পর স্মৃতিচারণ করেছিলেন তপন সিংহ৷ বলেছিলেন, ‘পরিচালক হওয়ার পর প্রায়ই ভাবতাম, অশোককুমারকে নিয়ে একটা ছবি করি৷ অবশ্যই বাংলা ছবি৷ সুযোগও এসে গেল৷ ছবির নাম ‘হাটেবাজারে’৷ নেপাল দত্ত প্রযোজনা করেছিলেন৷ তাঁকে বলেছিলাম, এ ছবিতে অশোককুমারকে পেলে খুব ভালো হত৷ এরপর নেপালবাবু বম্বেতে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন৷ বনফুলের ‘হাটেবাজারে’ গল্পের টান ও পরিচালনা আমি করছি শুনে উনি এককথায় রাজি হয়ে যান৷ এই ছবির আউটডোর করেছিলাম ভুটানে৷’

একদিন ‘হাটেবাজারে’-র শ্যুটিং করতে করতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন অশোককুমার৷ হাঁপানির কষ্ট সেদিন একটু বেশিই বেড়েছিল৷ তপনদাও বেশ চিন্তায় পড়লেন৷ বাকি কথা তপনদার স্মৃতিচারণে শোনা যাক৷—’তখন আমাদের চিফ মিনিস্টার ছিলেন শ্রদ্ধেয় প্রফুল্ল সেন৷ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হল৷ প্রফুল্লবাবুকে একজন ডাক্তার পাঠাতে অনুরোধ করেছিলাম৷ এরপর চার আসনের একটা ছোট প্লেনে ডাঃ মণি ছেত্রীকে পাঠিয়ে দিলেন মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী৷ ওষুধ খেয়ে ভালো হয়ে উঠলেন অশোককুমার৷ আমাকে মাত্র একদিন শ্যুটিং বন্ধ রাখতে হয়৷ ওই অসুস্থতার মধ্যেও দেখেছি কাজ ছাড়া অশোককুমার থাকতে পারেন না৷ অসুস্থতা সত্ত্বেও বলতেন, তপন তুমি কাজ না করলে আমি কিন্তু আগামীকালই বম্বে ফিরে যাব৷ বাধ্য হয়ে তাঁর জন্য আমাকে হালকা কিছু শ্যুটিং রাখতে হয়েছিল যাতে শরীরের ওপর কোনও চাপ না পড়ে৷ তাঁকে নিয়ে শ্যুটিং করব শুনে অশোককুমার ভীষণ খুশি৷ আমি এত অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে কাজ করেছি, এরকম কাজপাগল মানুষ বেশি দেখিনি৷’

ধীরে ধীরে অশোককুমারের সঙ্গে তপন সিংহের এক হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে৷ দাদামণি কলকাতায় বেশ কয়েকবার তপনদার নিউ আলিপুরের বাড়িতে এসেছেন৷ তপনদাও বম্বে গেলে তাঁর বাড়িতে যেতেন৷ ততদিনে ‘দাদামণি’ বলে ডাকতে শুরু করেছেন৷ মধ্য বম্বের র্যা মপার্ট রো-এ অশোককুমারের বিরাট বাড়ি ছিল৷ বাড়িটার নাম ‘অশোককুমার হাউস’৷ সেই বাড়িতেও গিয়েছেন তপনদা৷ তিনি বম্বেতে একটা হিন্দি ছবি করেছিলেন ‘জিন্দেগি জিন্দেগি’৷ তাতে অশোককুমারও ছিলেন৷ শ্যুটিং-এর পর প্রায় প্রতিদিনই সেই বাড়িতে দাদামণির সঙ্গে যেতেন তপনদা৷ খুব গল্পগুজব হত তাঁদের৷

তপনদা বলেছিলেন, ‘অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী ছিলেন দাদামণি৷ আমি ভাবতেও পারি না একজন মানুষ এতদিন ধরে প্রায় একভাবে অভিনয় করে যেতে পারেন৷ জীবন থেকে শেখার ব্যাপারে দাদামণির প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল৷ হয় কি বম্বে ও কলকাতার নামী অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এত রোজগার করেন যে তাঁরা কীরকম অলস হয়ে যান৷ কী অভিনয়, কী জীবনযাত্রা এই অলসতা ক্রমশ ঘিরে ধরে তাঁদের৷ দাদামণির মধ্যে এই অলসতা কিন্তু কখনও দেখিনি৷ অফুরন্ত প্রাণশক্তি যাকে বলে৷ তাঁর মধ্যে সবসময় দেখতাম নতুন কিছু শিখতে চান৷ অভিনয় তো আছেই৷ প্রথম জীবনে টিউটর রেখে জার্মান ও ফরাসি ভাষা শিখেছিলেন৷ দাদামণির গাড়ির খুব শখ ছিল৷ তাঁর আট-দশখানা গাড়ি ছিল একসময়৷ একটা রোলস রয়েসও ছিল তাঁর৷ এ ব্যাপারে দাদামণির একটা অদ্ভুত অভ্যাসও ছিল৷ গাড়ির সমস্ত যন্ত্রপাতি খুলে নিজের হাতে একটা একটা করে আবার সেগুলো যথাস্থানে লাগাতেন৷’

অশোককুমার খুব ভালো সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন৷ তাঁর বাড়িতে আট-দশ রকমের সাউন্ড-এর মেশিন ছিল৷ শব্দ নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন৷ রাস্তা দিয়ে কোনও ফেরিওয়ালা ডাক দিয়ে জিনিস বিক্রি করতে করতে যাচ্ছে৷ তাকে বাড়িতে ধরে এনে হয়তো খানিকটা রেকর্ডিং করিয়ে নিলেন৷ কিশোরকুমার কখনও এলে বলতেন, ‘অ্যাই তুই একটা গান গা দেখি৷ আমি রেকর্ডিং করে রাখি৷ আসলে মানুষটা জীবনকে ভালোবেসেছিলেন৷ নয়তো এত কিছু শেখা ও জানার আগ্রহ কারও থাকে না৷

অশোককুমার অভিনেতা হিসেবে কেমন? ‘আজ সময় অনেকটাই পালটে গিয়েছে৷ ছবির ধারণাও পালটে গিয়েছে৷ সুতরাং যাঁরা অভিনয় করেন তাঁদের কারও কারও মনে হতে পারে অশোককুমার পুরনো হয়ে গিয়েছেন৷ যাঁরা একথা বলেছেন, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর তাঁরাও তো পুরনো হয়ে যাবেন৷ তাই না? সবাই কি চিরকাল নতুন থাকতে পারেন? তবুও আমার মনে হয়, অশোককুমার, বলরাজ সাহানি, দিলীপকুমার আর বাংলার ছবি বিশ্বাস ও উত্তমকুমার চিরকালীন৷’ এই মন্তব্য তপন সিংহের৷ তিনি একথাও বলেছেন, ‘আমি তো নতুন-পুরনো দুই প্রজন্মের সঙ্গেই কাজ করেছি৷ দাদামণির অভিনয় ক্ষমতার কোনও সীমা-পরিসীমা ছিল না৷ তাই তিনি বেঁচে থাকতেই কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন৷ তাঁর মতো অভিনেতা আর হবে না৷’

আশীর্বাদ ছবির একটি দৃশ্যে।

অশোককুমারের সঙ্গে প্রয়াত বিশিষ্ট পরিচালক হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল৷ হৃষীদার পরিচালনায় ‘আশীর্বাদ’ ছবিতে অশোককুমারের অনবদ্য অভিনয় আজও আলোচনার বিষয়৷ ‘রেলগাড়ি রেলগাড়ি…’ গানটিও অসাধারণ গেয়েছিলেন অশোককুমার৷ দাদামণির প্রসঙ্গে হৃষীদা বলেছিলেন, ‘ওঁর মতো সরল আর আড্ডাবাজ মানুষ বেশি চোখে পড়েনি৷ অশোককুমারের সঙ্গে বম্বেতে যেদিন আমার প্রথম আলাপ হয় স্যুটপরা এক সুদর্শন মানুষকে দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম৷ ছবিতে নায়ক-নায়িকাদের মেকআপ করার পর এমনিতেই ভালো লাগে৷ কিন্তু পর্দার বাইরে সাধারণভাবে একজন লোক এত হ্যান্ডসাম ভাবতে পারিনি৷ সেই সময় অশোককুমারকে সবাই গাঙ্গুলিমশাই বলে ডাকতেন৷ কাউকে ‘দাদামণি’ ডাকতে শুনিনি৷ অবশ্য পরে এই নামেই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁকে ডাকতেন ছোট-বড় প্রায় সবাই৷ আমার মনে পড়ে হাঁপানির কষ্ট নিয়েই ‘রেলগাড়ি রেলগাড়ি’ গানের শ্যুটিংটা দাদামণি করেছিলেন৷ তাঁর কাণ্ডকারখানা দেখে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম৷ একটা করে শট দিচ্ছেন আর ডাক্তারের কাছ থেকে ইঞ্জেকশন নিচ্ছেন৷ কাজের প্রতি এত নিষ্ঠা কম দেখা যায়৷’

‘আশীর্বাদ’ ১৯৬৮ সালে মুক্তি পায়৷ সেই বছর সেরা হিন্দি ছবি হিসেবে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিল আশীর্বাদ৷ ‘সত্যকাম’, ‘গুড্ডি’, ‘মিলি’, ‘খুবসুরত’—হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের এই ছবিগুলোতেও দাদামণি অভিনয় করেন৷ তিনি এই নিবন্ধকারকে দুটো টোটকার কথা বলেছিলেন—খুব গরম চা খেতে নেই৷ এতে দাঁত খারাপ হয়৷ চা একটু ঠান্ডা করে খেলে দাঁত ভালো থাকে৷ আশি বছর বয়সেও মাত্র একটাই দাঁত পড়েছিল তাঁর৷ দ্বিতীয় টোটকা হল, স্নানের সময় চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়ালে বহুদিন চুল কালো থাকে৷ চুলে পাক ধরে না৷ দাদামণির চুলও বহুদিন কালো কুচকুচে ছিল৷

দাদামণি ভীষণ পছন্দ করতেন কলকাতার দই-মিষ্টি, পটল ও সজনে ডাঁটা৷ আর ভালোবাসতেন ধুতি-পাঞ্জাবি৷ একবার রবীন্দ্রনাথের কবিতার আবৃত্তি শুনেছিলাম দাদামণির মুখে—’বাংলার মাটি বাংলার জল/ বাংলার বায়ু বাংলার ফল/ পুণ্য হউক পুণ্য হউক/ পুণ্য হউক হে ভগবান৷’ বলেছিলেন, ‘পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে আমি যেন বাঙালি হয়ে জন্মগ্রহণ করি৷’ ২০০১ সালের ১০ ডিসেম্বর দাদামণি চিরবিদায় নেন৷

Skip to content