সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


রাসসুন্দরী দাসী। ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

ক্ষমতায়নের নিয়মই হল তার বিপরীতে থাকা মানুষটিকে বা শ্রেণিসমূহকে সবসময় অবদমিত করে রাখা। সেই প্রবণতা থেকেই হয়তো ভারতীয় মহিলাদের পড়াশোনা না শেখানোর সিদ্ধান্তটা আধিপত্যকামী পিতৃতন্ত্র যেনতেন প্রকারে বহুযুগ ধরে বাস্তবায়িত করে এসেছে। উনিশ শতকের ইউরোপীয় শিক্ষার সংস্পর্শে আসার পরে নারীদের পড়াশোনা শেখানোর একটা প্রয়োজন অনুভূত হলেও সেই প্রয়োজনের গুরুত্বও নির্ধারিত হয়েছিল পুরুষের প্রয়োজনের নিরিখেই। একজন পুরুষের যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে ওঠার জন্য, দিনান্তে তার মনোরঞ্জনের জন্য, যতটুক প্রয়োজন ততটুকুই পড়াশোনার মেয়াদ বরাদ্দ ছিল নারীটির জন্যও। আলাদা করে নারীর ব্যক্তিত্ব বিকাশের খাতিরে নয়, উপরন্তু পুরুষতন্ত্র আরোপিত নারীর ধারণাকে আরও মজবুত করার উদ্দেশ্যেই, নারীকে ব্যক্তি মানুষ থেকে কেবলমাত্র নিছক অবয়বহীন ধারণায় পর্যবসিত করার জন্যই তাঁদের সমস্ত পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার প্রচেষ্টায় ব্রতী হয়েছে।

কিন্তু উনিশ শতকে কৌলীন্যপ্রথার আগ্রাসনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও কিছু নারী নিজেদের ব্যক্তিজীবন বিকাশের পথ নিজেরাই করে নিয়েছেন, নিজেদের তাগিদেই। এমনই একজন সেকালের মহীয়সী হলেন রাসসুন্দরী দাসী। ১২১৬ বঙ্গাব্দে বর্তমান বাংলাদেশ পাবনার পোতাজিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী রাসসুন্দরী দাসী হলেন বাংলাসাহিত্যের প্রথম পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী লেখিকা। ছেলেবেলা থেকে বাড়ির ছেলেদের পড়াশোনা করতে দেখে নিজে নিজেই পড়তে শিখেছিলেন। রাসসুন্দরী দেবীর বাড়িতেই ছিল বাংলা স্কুল, প্রতিদিন সেখানে বাড়ির ও পাড়ার সব ছেলেরা মেমসাহেবের কাছে লেখাপড়া শিখত৷ সকালে পার্টি শিক্ষার প্রচলন থাকায় রাসসুন্দরী বাকি ছাত্রদের দেখাদেখি পার্সিও শিখেছিলেন। কিন্তু আচমকাই একদিন বাড়িতে আগুন লেগে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় স্কুল, আর তারপর বারো বছর বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় রাসসুন্দরীর। শ্বশুরবাড়িতে যতদিন শাশুড়ি জীবিত ছিলেন ততদিন কন্যাস্নেহেই তিনি ছিলেন সেখানে। জীবন যে কতটা কঠিন হতে পারে তা অনুধাবন করতে পারলেন শাশুড়ির মৃত্যুর পরে। চাকর-চাকরানিসহ শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন প্রায় ২০-২৫ জন। প্রায় ২০-২৫ জনের রান্না তাঁকে প্রতিদিন করতে হত। মাঝে মাঝে ১০ সের চাল রান্নার বর্ণনাও তাঁর আত্মজীবনীতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া বিগ্রহ পূজা, পথিক এবং অতিথি সেবার মতো একাধিক কাজ তো ছিলই। প্রায় বন্দিদশাতেই কেটেছে তাঁর সারাটা জীবন। সংসারের কাজে সমস্যা হবে বলে মায়ের কাছে গিয়ে বেশিদিন থাকার অনুমতিও ছিল না, আর গেলেও সঙ্গে থাকত ১০-১৫ জন লোক, ২৬ জন সরদার এবং দু’জন দাসী। এমনকী মায়ের মৃত্যুকালেও যাওয়ার অনুমতি মেলেনি। কেবল মেয়ে হওয়ার কারণেই যে এই দুর্দশা ভোগ করতে হয়েছে, তাও উল্লেখ করেছেন। নারী হয়ে জন্মগ্রহণ করায় আক্ষেপ করেছেন। তিনি যে পিঞ্জরাবদ্ধ পাখি—এ কথা আত্মজীবনীর অনেকাংশেই উল্লেখ করে বলেছেন—’এখন কখন মনে পড়ে সেই দিন/ পিঞ্জরেতে পাখী বন্দী, জালে।’

পড়ার আগ্রহ তো ছিল চিরকালই। হঠাৎই এক ভোরের স্বপ্নে দেখলেন যে তিনি ‘চৈতন্যভাগবত’ পড়ছেন। এক অদ্ভুত পুলকে উদ্বেলিত হয়ে উঠল দেহ-মন, এ যেন স্বয়ং ঈশ্বরেরই আদেশ। কিন্তু বাড়িতে অসংখ্য বই থাকলেও এত বইয়ের মধ্যে থেকে চৈতন্যভাগবত খুঁজে বের করা সহজ কাজ ছিল না। অতঃপর খুঁজে পাওয়া গেল চৈতন্য ভাগবত। অপরিসীম আহ্লাদে বইটির একটি পাতা লুকিয়ে রাখলেন রান্নাঘরে। বইয়ের অক্ষর, তালপাতায় লেখা অক্ষর আর লোকের কথার সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে বহু কষ্টে পড়ে শেষ করলেন ‘চৈতন্যভাগবত’। বাড়িতে পুরাণ পাঠ এবং সংকীর্তনের প্রচলন থাকলেও তাতে অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না, তাই ঘরেই পুঁথি পাঠ করবেন বলে মনস্থির করলেন। তিন বিধবা ননদের সঙ্গে ‘আহ্নিক-পূজা আহারাদির’ সময়ই নির্জন স্থানে পুঁথি পড়বেন বলে ঠিক করলেন। প্রতিবেশী কয়েকজনও সঙ্গী হিসেবে যোগ দিলেন। কেউ যেন দেখে না ফেলে, তাই একজন প্রহরীও নিযুক্ত করা হল। এদের মধ্যে দু’জন কয়েক দিন লেখাপড়াও শিখলেন তাঁর কাছে। যদিও এরপর আর গোপনে পড়ার প্রয়োজন হয়নি। বই পড়ার আগ্রহ উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকল। একে একে শেষ করলেন ‘চৈতন্যভাগবত’, ‘চৈতন্যচরিতামৃত’, ‘জৈমিনিভারত’, ‘গোবিন্দলীলামৃত’, ‘বিদগ্ধমাধব’, ‘প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা’, ‘বাল্মীকি পুরাণ’। বাল্মীকি পুরাণের কেবল আদিকাণ্ড ছিল। গ্রামে সপ্তকাণ্ড পাওয়া গেল না। পঞ্চম পুত্র দ্বারকানাথ থাকতেন কলকাতায়। তার মাধ্যমেই বাড়িতে আনালেন সপ্তকাণ্ড। পড়া তো দিব্যি চলছিল। কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়। সপ্তম পুত্র কিশোরীলাল মাকে আবদার করে বসলেন তাঁরা রাসসুন্দরী দেবীকে যেসমস্ত চিঠি লেখেন সেইসব চিঠির উত্তর তাঁকে পুত্রদের দিতে হবে। ছেলের যেমন কথা তেমন কাজ। চলে এল মায়ের জন্য দোয়াত, কালি, কাগজ। রাসসুন্দরী তো পড়লেন মহা বিপদে। কে জানত সেদিনের সেই বিপদই হবে তার আগামীতে বঙ্গসাহিত্যমঞ্চে বাংলার প্রথম আত্মজীবনীকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ। কীভাবে যে তিনি শেষমেশ লিখতে শিখলেন সেকথা জানা যায় না। তবে মনে হয় যখন তার স্বামী চিকিৎসার জন্য জ্যেষ্ঠ পুত্রের কাছ গিয়েছিলেন সেই সময়ে খানিক ফুরসত পেয়েছিলেন লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করার।

‘আমার জীবনে’ প্রথম খণ্ডের শেষের দিকে রাসসুন্দরীর স্বামীর প্রসঙ্গ এসেছে তার স্বামীর মৃত্যুর বর্ণনার মধ্য দিয়ে—’আমার শিরে স্বর্ণমুকুট ছিল, কিন্তু এতকাল পরে সেই মুকুটটি খসিয়া পড়িল।’ (‘আমার জীবন’, পৃ. ৬৯।) স্বামীর জয়হরি নামে একটি ঘোড়া ছিল। কোনও কারণে সেই ঘোড়া বাড়ির ভেতর এলে তার সামনে কোনওভাবেই যেতেন না তিনি, কারণ ঘোড়াটি তার স্বামীর। ঘোড়ার সামনে পড়া আর স্বামীর সামনে পড়া একই ব্যাপার৷ নিষ্ঠুর শোনালেও কোথাও যেন জীবনীতে তার স্বামীর এহেন উপস্থিতির মধ্যে কোথাও যেন এক সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা লুকিয়ে রয়েছে। এই ব্যঞ্জনা যেন মহিলাদের তৎকালীন পরিস্থিতির সাপেক্ষে খানিটা ঋণাত্মক তাৎপর্যই বহন করে। ‘স্বামী’ এই নির্দিষ্ট প্রভুত্বসূচক ক্ষমতায়নের গণ্ডিতেই মেয়েদের সমগ্র জীবন, সমগ্র আত্মপরিচয়, ব্যক্তিত্ব আচ্ছাদিত হয়ে থাকত আজীবন। রাসসুন্দরীর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তার আত্মজীবনীতে স্বামীর সঙ্গে তার পারস্পরিক সম্পর্কের বিশেষ কোনও উল্লেখই নেই। রাতের আগে দুজনের কোনও দেখাই হত না, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার স্বাভাবিক ব্যক্তিগত রসায়ন গড়ে ওঠার কোনও পরিসরই ছিল না। গোলাম মুরশিদ তার গ্রন্থ—’হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’তে বলেছেন, ‘স্বামী জীবিত থাকলে তিনি হয়তো তার আত্মজীবনী কোনোকালেই লিখতেন না, প্রকাশও করতেন না।’ স্বামীর মৃত্যুর এক বছর পরে ১৮৭০ সালে ৬০ বছর বয়সে রাসসুন্দরী তার আত্মজীবনী লেখার কাজে হাত দিয়েছিলেন। প্রথম খণ্ডের পরে দ্বিতীয় খণ্ডও রচনা করেছিলেন। স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির বাইরে গিয়ে মেয়েদের নিজেদের আত্মবিকাশের কোনও সুযোগই কখনও পেত না সেকথা লেখিকা তাঁর রচনায় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন—’তখন মেয়েছেলেরা লেখাপড়া শিখিত না, সংসারে খাওয়া-দাওয়ার কর্ম সারিয়া যে কিঞ্চিৎ অবকাশ থাকিত, তখন কর্তাব্যক্তি যিনি থাকিতেন, তাঁহার নিকট অতিশয় নম্রভাবে দণ্ডায়মান থাকিতে হইত। যেন মেয়েছেলের গৃহ কম্ম বৈ আর কোনো কম্মই নাই। তখনকার লোকের মনের ভাব ঐ রূপ ছিল। বিশেষত তখন মেয়েছেলের এই প্রকার নিয়ম ছিল, যে বউ হইবে, সে হাতখানেক ঘোমটা দিয়া ঘরের মধ্যে কাজ করিবে, আর কাহারও সঙ্গেই কথা কহিবে না, তাহা হইলেই বড় ভালো বউ হইল।’ (‘আমার জীবন’, পৃ ২৯) বস্তুত কত ভালো পণ্য হিসাবে বাড়ির বউটি উৎকৃষ্টতা অর্জন করতে পারে, সম্পদ হিসাবে শ্বশুরবাড়ি নামক বাজারনীতিতে কত দামি অথচ সুলভে নিজেকে বিকোতে পারে সেই শিক্ষাই তাঁকে সারাজীবন ধরে দেওয়া হত বিভিন্নরকমভাবে। স্বামীর মৃত্যুর পরেই তাই জীবনের সায়াহ্নে এসে নিজের জন্য খানিকটা সময় পান রাসসুন্দরী, আর তখনই তিনি লেখার কাজ আরম্ভ করেন।

কালের গভীরে ইতিহাসের কত বিবর্তনের কাহিনিই না লুকিয়ে থাকে। মানুষ যেটুকু চোখের সামনে ছাপার হরফে দেখতে পায় সেটা তো ব্যক্তি ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গির রকমফের মাত্র। এই দৃষ্টিভঙ্গির জোরেই ‘সতী’ নারীর একশো আটটি ধারণা এযাবৎকাল মেয়েদের ঘাড়ে চাপিয়ে আসা হচ্ছে, চাপিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিমাটুকু, আদলটুকুর রূপান্তর ঘটেছে মাত্র, বাদবাকি ক্ষেত্রে ‘সেই ট্র্যাডিশান আজও চলিতেছে।’ কিন্তু আমাদের জীবনে এইটুকুই প্রাপ্তি যে আমরা আমাদের জাতীয় জীবনে এই সমস্ত অনন্যাকে আমরা আমাদের মাঝে পেয়েছি, তাঁদের সৃষ্টি ইতিহাসকে, বঙ্গজীবনকে প্রসিদ্ধ করেছে। আগামীতে তাঁদের কীর্তিকে অবলম্বন করেই আমরা সংগ্রহ করে নেব আমাদের পাথেয় এই মনোবলেই আগামীর প্রতিটি দিন আরম্ভ হোক, মানুষ ফের আশায় বুক বাঁধুক, হাতে হাত রেখে বাঁধা হোক মানবতার গান।

Skip to content