শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

তোমরা সবাই জানো আগামী ৭ মার্চ সোমবার থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। ১১ মার্চ ইতিহাস পরীক্ষা। পরীক্ষার্থীদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ সিলেবাস কমিয়ে দিয়েছে। এবার পরীক্ষায় নীল বিদ্রোহ খুব গুরুত্বপূর্ণ। অধ্যায়টি থেকে পরীক্ষায় প্রশ্ন আসতে পারে। তাই আজ নীল বিদ্রোহ নিয়ে আলোচনা করছি, যা তোমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতেও কাজে লাগতে পারে।

শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডে বস্ত্রশিল্পে প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। এই শিল্পের একটি প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ছিল নীল। তখনও কৃত্রিম নীল আবিষ্কৃত হয়নি। তাই ইংরেজ বণিকরা ভারতে এসে জমি কিনে নিয়ে নীলচাষ করত এবং উৎপাদিত নীল ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দিয়ে যথেষ্ট লাভবান হতো। এই কারণে নীলকর সাহেবরা বাংলার চাষিদের উপর প্রচণ্ড অত্যাচার করে তাদের নীলচাষ করার জন্য বাধ্য করত। এধরনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলার নীলচাষিরা ১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে একটি শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, যা ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত ছিল।

নীল বিদ্রোহের কারণ

● নীলকরদের অত্যাচার : ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৮৩৩-এর সনদ অনুযায়ী নীলচাষকে ইউরোপীয়দের কাছে উন্মুক্ত ঘোষণা করলে বহু ইউরোপীয় ভারতে এসে নীলচাষের ব্যবসায় নামে! নীলচাষিদের ঘরে আগুন লাগানো, চাষের সরঞ্জাম লুট করা, বাড়ির মেয়েদের সম্মানহানি করা ইত্যাদি অত্যাচার চালানো হতো, যার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য নীলচাষিরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

● দাদন প্রথা : নীলকর সাহেবরা নীলচাষের জন্য কৃষকদের বিঘা প্রতি দুই টাকা করে দাদন (অগ্রিম) দিতেন। কৃষক পরিবারগুলি অভাবের তাড়নায় দাদন নিত, দাদনের দ্বারা এককালীন কিছু টাকা পেয়ে পরিবারগুলির সাময়িক দারিদ্র মোচনে হলেও তারা দাদনের ঋণের জালে যেভাবে জড়িয়ে পড়ত তা থেকে কোনওদিন আর মুক্তি পাওয়ার আশা ছিল না।

● প্রতারণা ও কারচুপি : নীলকর সাহেবরা নীলচাষিদের বিভিন্নভাবে প্রতারিত করত। নীল কেনার সময় নীলকর সাহেবরা চাষিদের নীলের ওজন কম দেখাত, কম দামে নীল বিক্রি করতে চাষিরা বাধ্য থাকত। তাছাড়া জোর করে বিভিন্নভাবে নীলকর সাহেবরা নীলচাষিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করত।

● পঞ্চম আইন : ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক পঞ্চম আইন পাশ করে ঘোষণা করেন যে, কোনও চাষি দাদন দিয়ে নীল চাষ না করলে তাকে গ্রেফতার করা হবে ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। এর ফলে নীলচাষিদের উপর অত্যাচার অনেক বেড়ে গিয়েছিল।

● পূর্বেকার বিদ্রোহের প্রভাব : নীল বিদ্রোহকে প্রভাবিত করেছিল এর পূর্বেকার বিভিন্ন কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহগুলি। ফরাজী, ওয়াহাবি, সাঁওতাল ও মুন্ডা বিদ্রোহের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নীলচাষিরা বিদ্রোহ ঘটিয়েছিল।

● অন্যায্য বিচার : প্রশাসন এমনকী বিচার করাও নীলকর সাহেবদের পক্ষে থাকায় নীলচাষিরা অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে কোনওরূপ সুবিচার পেত না। ফলত নীলচাষিরা নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের রাস্তায় অগ্রসর হয়।

উপরোক্ত কারণগুলির ফলস্বরূপ নীলচাষিরা বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস-এর নেতৃত্বে নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। নীল বিদ্রোহের প্রথম সূচনা হয় নদীয়া জেলার চৌগাছা গ্রামে। ক্রমেই বিদ্রোহ বর্ধমান, বাঁকুড়া, মালদা, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর, পাবনা, ফরিদপুর, খুলনা প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

বিদ্রোহের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী

● নীল কমিশন গঠন : নীল বিদ্রোহের তীব্রতায় সরকার বাধ্য হয়ে বাংলার ছোটলাট জেপি গ্রান্ট ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ৩১ ডিসেম্বর নীল কমিশন গঠন করে। এই কমিশন তার রিপোর্টে ‘তিন কাঠিয়া প্রথা’ অর্থাৎ বিঘা প্রতি কাঠা জমিতে নীলচাষ করা যাবে বলে উল্লেখ করে। এছাড়া নীলচাষিদের উপর অত্যাচারের বহু তথ্য উঠে আসে এই রিপোর্টে।

● বাঙালি জাতির মনোবল বৃদ্ধি : নীল বিদ্রোহের সাফল্য, ভবিষ্যতের কৃষক আন্দোলনের শক্তি যে জাগ্রত বাঙালি জাতির মধ্যেই রয়েছে তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। নীল বিদ্রোহই ছিল সর্বপ্রথম ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ গণ আন্দোলন। বাঙালি জাতি যে কতটা আত্ম বলে বলিয়ান তা প্রমাণ করেছিল এই বিদ্রোহ।

● জাতীয় চেতনার উন্মেষ : এই বিদ্রোহে জয়ের মাধ্যমে নীলচাষিরা যে নৈতিক শক্তির অধিকারী হয়ে উঠেছিল তার দ্বারা জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে।

নীল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য

● নীলকর বিরোধী বিদ্রোহ : নীল বিদ্রোহ ছিল নীলকর বিরোধী বিদ্রোহ। এটি অন্যান্য বিদ্রোহের মতো জমিদার বা মহা জনবিরোধী বিদ্রোহ ছিল না। নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচার ও জোর-জবরদস্তির বিরুদ্ধে নীলচাষিরা সংঘবদ্ধ হয়েছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল নীলচাষ প্রথার পুরোপুরি অবসান ঘটানো।

● কৃষকদের কঠোর মনোভাব : নীল বিদ্রোহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল কৃষকদের কঠোর মনোভাব। এই বিদ্রোহে কৃষকরা দৃঢ়তার সঙ্গে মনস্থির করেছিল যে, ‘মরব তবু নীলচাষ করব না’। শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী কৃষকরা বাংলা থেকে নীলচাষ বন্ধ করেছিল।

● বিদ্রোহে খ্রিস্টান মিশনারিদের সমর্থন :
নীল বিদ্রোহ খ্রিস্টান মিশনারিরা বিদ্রোহীদের সমর্থন করেছিল। তারা নীলচাষিদের উপর নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ও সোচ্চার হয়েছিল। জেমস লং নীলদর্পণ নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, নীল বিদ্রোহ বাঙালি সমাজে ব্যাপক চাঞ্চল্য ও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় নীলচাষিদের বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিল। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকায় নীলচাষিদের সমর্থনে লেখা প্রকাশ করতেন। এছাড়া দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি নীল বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

ছাত্র-ছাত্রীরা তোমরা সবাই নীল বিদ্রোহ সংক্রান্ত প্রশ্নগুলি খুব মন দিয়ে পড়বে। আরেকটা বিষয় অবশ্যই মনে রাখবে ইতিহাসে ভালো নম্বর পেতে গেলে পয়েন্ট দিয়ে উত্তর লেখার চেষ্টা করবে।

যে সব প্রশ্ন আসতে পারে
নীল বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল
আলোচনা করো। ( ৮ নম্বর)
নীল বিদ্রোহের তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর। (৪ নম্বর)
নীল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য কী ছিল? ( ৪ নম্বর)
নীল বিদ্রোহ কবে হয়েছিল? এই বিদ্রোহের দুজন নেতার নাম লেখ। (১+২ নম্বর)
নীলদর্পণ নাটকটি কে লিখেছিলেন? (১ নম্বর)
নীলদর্পণ নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ কে করেছিলেন? (১ নম্বর)
ভারতের মানচিত্রে নীল বিদ্রোহের কেন্দ্র চিহ্নিত করো। (১ নম্বর)

Skip to content