ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
এদিকে মৃতসঞ্জীবনী দেবতারা লাভ করবার পর ইন্দ্রকে গিয়ে বললেন, এইবার শত্রুসংহার সময় এসে গিয়েছে। তাই আপনি এ বিষয়ে যত্নবান হোন। ইন্দ্রও সে কথা মেনে নিয়ে তাঁর অভিযান শুরু করলেন। প্রথমেই তিনি বায়ুরূপ ধারণ করে যেতে যেতে দেখলেন, এক অপূর্ব উদ্যানসংলগ্ন সরোবরে কয়েকজন ক্রীড়ারতা সুন্দরী কন্যাকে দেখতে পেলেন। ভালো করে নজর করে তিনি বুঝতে পারলেন, এই দলে রয়েছে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী এবং দৈত্যরাজ বৃষপর্বার আদরের কন্যা শর্মিষ্ঠা। তিনি স্থির করে ফেললেন তাঁর কর্মপদ্ধতি। ভাবলেন, এই সুযোগ শুক্রাচার্য আর দানবদের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেবার। তিনি বাতাসের মতো হয়ে স্নানরত কন্যাদের বস্ত্রগুলো পরস্পর মিলিয়ে দিলেন।
এরপর যথারীতি স্নানশেষে নিজের বস্ত্র চিনতে না পেরে শর্মিষ্ঠা দেবযানীর বস্ত্র পরিধান করলেন। আর তাতে দেবযানীর আঁতে ঘা লাগল। স্বভাবগত দম্ভে পূর্বের সখীত্ব ভুলে গিয়ে বলে উঠলেন, অসুরের মেয়ে, তদুপরি তাঁর শিষ্যকন্যা হওয়া সত্ত্বেও এমন কাজ করার সাহস কীভাবে পেতে পারেন শর্মিষ্ঠা! অন্যদিকে শর্মিষ্ঠাও তাঁর অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য এই অপমান সহ্য করলেন না। রাজার মেয়ের অহমিকা ঝরে পড়ল তাঁর কণ্ঠে। বিষোদ্গার করে উঠলেন তিনিও। দেবযানীর পিতা শুক্রাচার্য তাঁর পিতা রাজা বৃষপর্বার অধীন। রাজাই শ্রেষ্ঠ। সেই রাজার কন্যা তিনি। তাই দরিদ্র ব্রাহ্মণকন্যার প্রতি তিনি হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন। এমনটাই বুঝি ইন্দ্র চেয়েছিলেন। সঞ্জীবনীবিদ্যা জানেন শুক্রাচার্য। তাই তিনি দৈত্যদের বল। সেই দৈত্যগুরু আর দৈত্যরাজের কন্যাদের মধ্যে বিবাদ-এর অর্থই হল গুরু আর শিষ্যদের মধ্যে সম্পর্কে ভাঙন ধরা। দুই কন্যার বিবাদের ফল হল এই যে, শর্মিষ্ঠা দেবযানীকে একটি কূপের মধ্যে ফেলে দিয়ে তাঁকে মৃতা ভেবে নিয়ে নিজের ভবনে চলে গেলেন। এদিকে ঠিক সেইসময় রাজা যযাতি ঘোড়া চড়ে শিকারে বেরিয়েছিলেন। তিনি তৃষ্ণার্ত অবস্থায় সেই কূপের ধারে এসে উপস্থিত হলেন জলের খোঁজে। সৌভাগ্যবশত সেই কূপে জল ছিল না।ফলত দেবযানীর মৃত্যু হয়নি। যযাতি জলের খোঁজে এসে পেলেন দেবযানীকে। দেবযানীর পরিচয় জেনে তাঁকে উদ্ধার করে যযাতি চলে গেলেন তাঁর রাজধানীতে।
এদিকে দেবযানী যতটা না পতনে কষ্ট পেয়েছিলেন, তাঁর পিতার দারিদ্র এবং শর্মিষ্ঠাকৃত অপমান তাঁকে আরও দগ্ধ করতে লাগল। পিতা গৃহে ফিরলে পিতার কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত বলে এর প্রতিকার চাইলেন। শুক্রাচার্য কন্যাকে এ সমস্ত কিছু ক্ষমা করে দিতে বললেন। কারণ ক্রোধই কর্তব্যাকর্তব্য বিবেকশূন্য করে মানুষকে। কিন্তু দেবযানী সে কথা শুনলে তো? শর্মিষ্ঠার কটুবাক্য তাঁর হৃদয়ে যে জ্বালা ধরেছিল, শুক্রাচার্যের মধুর স্তোকবাক্য তাতে কোনও প্রলেপ লাগাতে সক্ষম হল না। একসময়, শুক্রাচার্যও কন্যার প্ররোচনায় সদসদ্বিবেকবুদ্ধিরহিত হয়ে উঠলেন এবং পুরোনো ক্ষোভ প্রকাশ করলেন দৈত্যরাজ বৃষপর্বার কাছে। বৃহস্পতিপুত্র কচকে বধের জন্য দায়ী করলেন বৃষপর্বাকে। আর এদিকে শর্মিষ্ঠাকৃত দেবযানীর অপমানেও অপমানিত বোধ করেছেন পিতা। বলে উঠলেন তিনি, অসুরদের রাজ্যে তিনি আর থাকতে রাজি নন। বৃষপর্বা বাস্তবিকই কচহত্যার বিষয়ে কিছু জানতেন না। আর আচম্বিতে ঘটে যাওয়া দেবযানীর অপমানের বিষয়ে তো নয়ই। তিনি শুক্রাচার্যকে যেতে দিতে নারাজ। শিষ্যের বারংবার অনুনয়ে গুরু বলে উঠলেন, একমাত্র দেবযানী প্রসন্ন হলে তবেই তাঁর পক্ষে এ রাজ্যে থাকা সম্ভব। কারণ কন্যা তাঁর বড় আদরের ধন। কন্যার অপমান তিনি মেনে নেবেন না। বৃষপর্বা মেনে নিলেন শুক্রাচার্যের এ অন্যায় আবদার। দেবযানী গুরুকে ফিরিয়ে আনতে কাতর বদ্ধপরিকর রাজার কাছে চাইলেন হাজার সখীসহ শর্মিষ্ঠার দাসিত্ব। অহমিকাগ্রস্ত হয়ে বলে উঠলেন তিনি, দেবযানীর শ্বশুরগৃহেও দাসী হয়ে শর্মিষ্ঠাকে অনুগমন করতে হবে। শর্মিষ্ঠা তাঁর জ্ঞাতিকুলের স্বার্থে স্বেচ্ছায় স্বীকার করে নিলেন এই দাসিত্ব। দেবযানীও খুশি হলেন। খুশি হলেন শুক্রাচার্যও।
এদিকে তার বেশ কিছু কাল পর একদিন সেই একই বনে দেবযানী ভ্রমণ করতে গেলেন। আর তাঁকে অনুগমন করলেন সখীদের সঙ্গে শর্মিষ্ঠা| সেখানে সখীদের সঙ্গে শর্মিষ্ঠাকে দেবযানীর পদসেবা করতে দেখলেন রাজা। অপরূপরূপলাবণ্যময়ী দৈত্যরাজকন্যাকে দেখে যযাতি যুগপত্ মুগ্ধ ও বিস্মিত হলেন। দেবযানীকে রাজা চিনতে পারেননি। মুগ্ধদৃষ্টি রাজাকে নিজেদের পরিচয় দিলেন দেবযানী। এমন সুন্দরী কন্যা যাঁর কোনও মতেই দাসিত্ব শোভা পায় না, তাঁর দাসিত্বের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন রাজা। দেবযানী সে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেলেন। রাজার প্রতি তিনি পূর্বেই আসক্ত হয়েছিলেন। রাজার পরিচয় পেয়ে তিনি রাজাকে নিজের মনোগত কামনা ব্যক্ত করলেন। রাজা যযাতিকে তিনি পতিরূপে বরণ করতে চান। যেহেতু যযাতি তাঁকে ইতিপূর্বেই কূপ হতে উদ্ধার করেছিলেন, সুতরাং তিনি পাণিগ্রহণ করেছেন অমতাবস্থায় অন্য পুরুষকে বিবাহ করা দেবযানীর পক্ষে সম্ভব নয়। যযাতি অগত্যা নিমরাজি হলেন। কিন্তু শর্মিষ্ঠাকে তিনি ভুললেন না। যথাসময়ে শুক্রাচার্যের উপস্থিতিতে দেবযানীর সঙ্গে বিবাহ হল রাজা যযাতির। বিবাহের আগে শুক্রাচার্য রাজাকে সাবধান করলেন, রাজা যেন কখনও শর্মিষ্ঠাকে শয্যাসঙ্গিনী না করেন। রাজা না জানলেও পিতার তো দুশ্চিন্তা ছিলই। একে কোনও মতে রোধ করা গেছে দেবযানী শর্মিষ্ঠার বিবাদ। অপূর্ব সুন্দরী রাজকন্যা শর্মিষ্ঠা দেবযানীর দাসী হয়ে অনুগমন করছেন। যদি রাজাকে কেন্দ্র করে শর্মিষ্ঠা দেবযানীর এ বিবাদ পুনরাবৃত্ত হয়!
পূর্বের স্থির করা কথামতো সখীদের নিয়ে শর্মিষ্ঠা দেবযানীর অনুগমন করলেন। দেবযানী গেলেন রাজভবনে আর শর্মিষ্ঠার স্থান হল রাজোদ্যানের কাছে একটি নতুন বাড়িতে। এমন করে বেশ কিছু কাল পেরিয়ে গেল। দেবযানী সন্তানবতী হলেন। আর অন্যদিকে ঋতুমতী শর্মিষ্ঠাও রাজাকে কামনা করে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত্ হওয়া অসম্ভব জেনেও বিষণ্ণ মনে প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। অবশেষে একদিন দৈবাত্ রাজার সঙ্গে তাঁর একাকী সাক্ষাৎ হল। তিনি নিজের মনোগত বাসনার কথা রাজাকে জানালেন। রাজা শর্মিষ্ঠার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তাই শর্মিষ্ঠাকে প্রত্যাখ্যানের প্রশ্নই ওঠে না। বরং তাঁর আনন্দিত হবার কথা। কিন্তু শুক্রাচার্যের সাবধানবাণী বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়ে গেল। শর্মিষ্ঠা যখন তাঁকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে, বিশেষ ক্ষেত্রে মিথ্যা বললে তা দোষের হয় না। এক্ষেত্রে শর্মিষ্ঠা ঋতুমতী। এবং দেবযানীর সখী ও বটে, আবার দাসীও। সুতরাং তিনি যে রাজাকে পতিত্বে বরণ করতে চাইছেন, এ বাসনা রাজার পূর্ণ করা উচিত। রাজা আর নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারলেন না।
শর্মিষ্ঠার গর্ভে যযাতির তিন পুত্রের জন্ম হয়। অন্যদিকে দেবযানীর গর্ভেও দুই পুত্রের জন্ম হয়। এদিকে ধীরে সত্য আর গোপন থাকে না। শর্মিষ্ঠাপুত্রদের পরিচয় জেনে দেবযানী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। এবং পুনরায় পিতার কাছে গিয়ে উপস্থিত হন। শুক্রাচার্য নিজের আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত জেনে ক্রুদ্ধ হয়ে রাজাকে অভিশাপ দেন। শুক্রের অভিশাপে রাজার যৌবন চলে যায় আর জরা এসে গ্রাস করে। ভোগপরায়ণ রাজা যযাতির ভোগস্পৃহা তখনও প্রশমিত হয়নি। তাই শুক্রাচার্যের কাছে এ শাপের প্রতিকার প্রার্থনা করলে দৈত্যগুরু বলে ওঠেন, এ জরা তিনি অন্য কারও শরীরে দিয়ে দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি আবার যৌবন ফিরে পাবেন। রাজার জরা কোনও পুত্রই নিতে রাজি হলেন না। কেই বা নিজের যৌবনকে স্বেচ্ছায় ত্যাগ করতে চায়! সকলেই ভোগী পিতার অভিশাপ বরণ করলেন। একমাত্র কনিষ্ঠপুত্র পুরু রাজবাক্যে সম্মত হলেন। পুরুকে নিজের জরা দিয়ে তার নবযৌবন নিয়ে আরও বহুকাল এ পৃথিবীতে সুখভোগ করলেন রাজা। অবশেষে যখন তাঁর প্রত্যয় হল যে, ভোগ কেবল কামনা বাড়িয়ে তোলে, উপশম করে না, তিনি ক্ষান্ত হলেন। ফিরে এলেন প্রিয় পুত্রের কাছে, ফিরিয়ে দিলেন তার যৌবন আর রাজ্য। এই ধৈর্যশীল রাজা পুরু থেকেই উদ্ভব পৌরব বংশের। পিতা রাজা যযাতির সুবিশাল রাজ্য এবং অশেষ আশিসের উত্তরাধিকারী হন তিনি। যুধিষ্ঠিরাদি পাণ্ডব ও কৌরবেরা হলেন এই পৌরববংশেরই উত্তরপুরুষ।
এরপর যথারীতি স্নানশেষে নিজের বস্ত্র চিনতে না পেরে শর্মিষ্ঠা দেবযানীর বস্ত্র পরিধান করলেন। আর তাতে দেবযানীর আঁতে ঘা লাগল। স্বভাবগত দম্ভে পূর্বের সখীত্ব ভুলে গিয়ে বলে উঠলেন, অসুরের মেয়ে, তদুপরি তাঁর শিষ্যকন্যা হওয়া সত্ত্বেও এমন কাজ করার সাহস কীভাবে পেতে পারেন শর্মিষ্ঠা! অন্যদিকে শর্মিষ্ঠাও তাঁর অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য এই অপমান সহ্য করলেন না। রাজার মেয়ের অহমিকা ঝরে পড়ল তাঁর কণ্ঠে। বিষোদ্গার করে উঠলেন তিনিও। দেবযানীর পিতা শুক্রাচার্য তাঁর পিতা রাজা বৃষপর্বার অধীন। রাজাই শ্রেষ্ঠ। সেই রাজার কন্যা তিনি। তাই দরিদ্র ব্রাহ্মণকন্যার প্রতি তিনি হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন। এমনটাই বুঝি ইন্দ্র চেয়েছিলেন। সঞ্জীবনীবিদ্যা জানেন শুক্রাচার্য। তাই তিনি দৈত্যদের বল। সেই দৈত্যগুরু আর দৈত্যরাজের কন্যাদের মধ্যে বিবাদ-এর অর্থই হল গুরু আর শিষ্যদের মধ্যে সম্পর্কে ভাঙন ধরা। দুই কন্যার বিবাদের ফল হল এই যে, শর্মিষ্ঠা দেবযানীকে একটি কূপের মধ্যে ফেলে দিয়ে তাঁকে মৃতা ভেবে নিয়ে নিজের ভবনে চলে গেলেন। এদিকে ঠিক সেইসময় রাজা যযাতি ঘোড়া চড়ে শিকারে বেরিয়েছিলেন। তিনি তৃষ্ণার্ত অবস্থায় সেই কূপের ধারে এসে উপস্থিত হলেন জলের খোঁজে। সৌভাগ্যবশত সেই কূপে জল ছিল না।ফলত দেবযানীর মৃত্যু হয়নি। যযাতি জলের খোঁজে এসে পেলেন দেবযানীকে। দেবযানীর পরিচয় জেনে তাঁকে উদ্ধার করে যযাতি চলে গেলেন তাঁর রাজধানীতে।
এদিকে দেবযানী যতটা না পতনে কষ্ট পেয়েছিলেন, তাঁর পিতার দারিদ্র এবং শর্মিষ্ঠাকৃত অপমান তাঁকে আরও দগ্ধ করতে লাগল। পিতা গৃহে ফিরলে পিতার কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত বলে এর প্রতিকার চাইলেন। শুক্রাচার্য কন্যাকে এ সমস্ত কিছু ক্ষমা করে দিতে বললেন। কারণ ক্রোধই কর্তব্যাকর্তব্য বিবেকশূন্য করে মানুষকে। কিন্তু দেবযানী সে কথা শুনলে তো? শর্মিষ্ঠার কটুবাক্য তাঁর হৃদয়ে যে জ্বালা ধরেছিল, শুক্রাচার্যের মধুর স্তোকবাক্য তাতে কোনও প্রলেপ লাগাতে সক্ষম হল না। একসময়, শুক্রাচার্যও কন্যার প্ররোচনায় সদসদ্বিবেকবুদ্ধিরহিত হয়ে উঠলেন এবং পুরোনো ক্ষোভ প্রকাশ করলেন দৈত্যরাজ বৃষপর্বার কাছে। বৃহস্পতিপুত্র কচকে বধের জন্য দায়ী করলেন বৃষপর্বাকে। আর এদিকে শর্মিষ্ঠাকৃত দেবযানীর অপমানেও অপমানিত বোধ করেছেন পিতা। বলে উঠলেন তিনি, অসুরদের রাজ্যে তিনি আর থাকতে রাজি নন। বৃষপর্বা বাস্তবিকই কচহত্যার বিষয়ে কিছু জানতেন না। আর আচম্বিতে ঘটে যাওয়া দেবযানীর অপমানের বিষয়ে তো নয়ই। তিনি শুক্রাচার্যকে যেতে দিতে নারাজ। শিষ্যের বারংবার অনুনয়ে গুরু বলে উঠলেন, একমাত্র দেবযানী প্রসন্ন হলে তবেই তাঁর পক্ষে এ রাজ্যে থাকা সম্ভব। কারণ কন্যা তাঁর বড় আদরের ধন। কন্যার অপমান তিনি মেনে নেবেন না। বৃষপর্বা মেনে নিলেন শুক্রাচার্যের এ অন্যায় আবদার। দেবযানী গুরুকে ফিরিয়ে আনতে কাতর বদ্ধপরিকর রাজার কাছে চাইলেন হাজার সখীসহ শর্মিষ্ঠার দাসিত্ব। অহমিকাগ্রস্ত হয়ে বলে উঠলেন তিনি, দেবযানীর শ্বশুরগৃহেও দাসী হয়ে শর্মিষ্ঠাকে অনুগমন করতে হবে। শর্মিষ্ঠা তাঁর জ্ঞাতিকুলের স্বার্থে স্বেচ্ছায় স্বীকার করে নিলেন এই দাসিত্ব। দেবযানীও খুশি হলেন। খুশি হলেন শুক্রাচার্যও।
এদিকে তার বেশ কিছু কাল পর একদিন সেই একই বনে দেবযানী ভ্রমণ করতে গেলেন। আর তাঁকে অনুগমন করলেন সখীদের সঙ্গে শর্মিষ্ঠা| সেখানে সখীদের সঙ্গে শর্মিষ্ঠাকে দেবযানীর পদসেবা করতে দেখলেন রাজা। অপরূপরূপলাবণ্যময়ী দৈত্যরাজকন্যাকে দেখে যযাতি যুগপত্ মুগ্ধ ও বিস্মিত হলেন। দেবযানীকে রাজা চিনতে পারেননি। মুগ্ধদৃষ্টি রাজাকে নিজেদের পরিচয় দিলেন দেবযানী। এমন সুন্দরী কন্যা যাঁর কোনও মতেই দাসিত্ব শোভা পায় না, তাঁর দাসিত্বের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন রাজা। দেবযানী সে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেলেন। রাজার প্রতি তিনি পূর্বেই আসক্ত হয়েছিলেন। রাজার পরিচয় পেয়ে তিনি রাজাকে নিজের মনোগত কামনা ব্যক্ত করলেন। রাজা যযাতিকে তিনি পতিরূপে বরণ করতে চান। যেহেতু যযাতি তাঁকে ইতিপূর্বেই কূপ হতে উদ্ধার করেছিলেন, সুতরাং তিনি পাণিগ্রহণ করেছেন অমতাবস্থায় অন্য পুরুষকে বিবাহ করা দেবযানীর পক্ষে সম্ভব নয়। যযাতি অগত্যা নিমরাজি হলেন। কিন্তু শর্মিষ্ঠাকে তিনি ভুললেন না। যথাসময়ে শুক্রাচার্যের উপস্থিতিতে দেবযানীর সঙ্গে বিবাহ হল রাজা যযাতির। বিবাহের আগে শুক্রাচার্য রাজাকে সাবধান করলেন, রাজা যেন কখনও শর্মিষ্ঠাকে শয্যাসঙ্গিনী না করেন। রাজা না জানলেও পিতার তো দুশ্চিন্তা ছিলই। একে কোনও মতে রোধ করা গেছে দেবযানী শর্মিষ্ঠার বিবাদ। অপূর্ব সুন্দরী রাজকন্যা শর্মিষ্ঠা দেবযানীর দাসী হয়ে অনুগমন করছেন। যদি রাজাকে কেন্দ্র করে শর্মিষ্ঠা দেবযানীর এ বিবাদ পুনরাবৃত্ত হয়!
পূর্বের স্থির করা কথামতো সখীদের নিয়ে শর্মিষ্ঠা দেবযানীর অনুগমন করলেন। দেবযানী গেলেন রাজভবনে আর শর্মিষ্ঠার স্থান হল রাজোদ্যানের কাছে একটি নতুন বাড়িতে। এমন করে বেশ কিছু কাল পেরিয়ে গেল। দেবযানী সন্তানবতী হলেন। আর অন্যদিকে ঋতুমতী শর্মিষ্ঠাও রাজাকে কামনা করে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত্ হওয়া অসম্ভব জেনেও বিষণ্ণ মনে প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। অবশেষে একদিন দৈবাত্ রাজার সঙ্গে তাঁর একাকী সাক্ষাৎ হল। তিনি নিজের মনোগত বাসনার কথা রাজাকে জানালেন। রাজা শর্মিষ্ঠার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তাই শর্মিষ্ঠাকে প্রত্যাখ্যানের প্রশ্নই ওঠে না। বরং তাঁর আনন্দিত হবার কথা। কিন্তু শুক্রাচার্যের সাবধানবাণী বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়ে গেল। শর্মিষ্ঠা যখন তাঁকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে, বিশেষ ক্ষেত্রে মিথ্যা বললে তা দোষের হয় না। এক্ষেত্রে শর্মিষ্ঠা ঋতুমতী। এবং দেবযানীর সখী ও বটে, আবার দাসীও। সুতরাং তিনি যে রাজাকে পতিত্বে বরণ করতে চাইছেন, এ বাসনা রাজার পূর্ণ করা উচিত। রাজা আর নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারলেন না।
শর্মিষ্ঠার গর্ভে যযাতির তিন পুত্রের জন্ম হয়। অন্যদিকে দেবযানীর গর্ভেও দুই পুত্রের জন্ম হয়। এদিকে ধীরে সত্য আর গোপন থাকে না। শর্মিষ্ঠাপুত্রদের পরিচয় জেনে দেবযানী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। এবং পুনরায় পিতার কাছে গিয়ে উপস্থিত হন। শুক্রাচার্য নিজের আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত জেনে ক্রুদ্ধ হয়ে রাজাকে অভিশাপ দেন। শুক্রের অভিশাপে রাজার যৌবন চলে যায় আর জরা এসে গ্রাস করে। ভোগপরায়ণ রাজা যযাতির ভোগস্পৃহা তখনও প্রশমিত হয়নি। তাই শুক্রাচার্যের কাছে এ শাপের প্রতিকার প্রার্থনা করলে দৈত্যগুরু বলে ওঠেন, এ জরা তিনি অন্য কারও শরীরে দিয়ে দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি আবার যৌবন ফিরে পাবেন। রাজার জরা কোনও পুত্রই নিতে রাজি হলেন না। কেই বা নিজের যৌবনকে স্বেচ্ছায় ত্যাগ করতে চায়! সকলেই ভোগী পিতার অভিশাপ বরণ করলেন। একমাত্র কনিষ্ঠপুত্র পুরু রাজবাক্যে সম্মত হলেন। পুরুকে নিজের জরা দিয়ে তার নবযৌবন নিয়ে আরও বহুকাল এ পৃথিবীতে সুখভোগ করলেন রাজা। অবশেষে যখন তাঁর প্রত্যয় হল যে, ভোগ কেবল কামনা বাড়িয়ে তোলে, উপশম করে না, তিনি ক্ষান্ত হলেন। ফিরে এলেন প্রিয় পুত্রের কাছে, ফিরিয়ে দিলেন তার যৌবন আর রাজ্য। এই ধৈর্যশীল রাজা পুরু থেকেই উদ্ভব পৌরব বংশের। পিতা রাজা যযাতির সুবিশাল রাজ্য এবং অশেষ আশিসের উত্তরাধিকারী হন তিনি। যুধিষ্ঠিরাদি পাণ্ডব ও কৌরবেরা হলেন এই পৌরববংশেরই উত্তরপুরুষ।