রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

 

১৪: তিনটি মাছের কাহিনি

কোনও এক নাম না দেশের জলাশয়ে ‘অনাগতবিধাতা’, ‘প্রত্যুত্পন্নমতি’, আর ‘যদ্ভবিষ্য’ নামে তিনটি মাছ বাস করতো। মিলে মিশে তাঁদের দিন কাটছিল বেশ ভালোই। একদিন অপরাহ্নে একদল জেলে সেই জলাশয়ের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বিশাল সেই জলাশয়টাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। একজন বললে, “অহো বহুমৎস্যোঽযং হ্রদঃ”—এ জলাশয়ে নিঃসন্দেহে অনেক মাছ আছে। এতদিন এই জলাশয়টা আমাদের চোখে পড়েনি কেন এটা ভেবেই আশ্চর্য লাগছে। আজকের মতো খাওয়া-দাওয়া তো জুটে গিয়েছে আর এ দিকে সন্ধেও প্রায় ঘনিয়ে এলো। তাই আগামীকাল সক্কাল সক্কাল আমরা এখানে আসবো।
সরোবরের তীরে জেলেদের নিজেদের মধ্যে এইরকম কথাবার্তা শুনে তিনটে মাছের মাথায় যেন বাজ পড়লো। সব মাছেদের ডেকে আপত্কালীন সভা বসালো তারা জলাশয়ের গভীরে। সবটা বুঝে শুনে অনাগতবিধাতা বললে, আপনারা তো সকলেই মত্স্যজীবিদের সমস্ত কথাবার্তা শুনলেন। এখন আমার পরামর্শ হল বাঁচতে হলে আজই রাত্রির মধ্যে নিকটবর্তী অন্য কোনও একটা জলাশয়ে আমাদের চলে যেতে হবে। পণ্ডিতেরা বলেন—

অশক্তৈর্বলিনঃ শত্রোঃ কর্তব্যং প্রপলাযনম্।
সংশ্রিতব্যোঽথবা দুর্গো নান্যা তেষাং গতির্ভবেৎ।। (মিত্রভেদ, ৩৪৮)


নিজকে যদি থেকে বলবান শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে হয়, তাহলে পালিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ; আর তা না হলে অন্তত দুর্গের ভিতরে কোথাও কোনও গোপন স্থানে লুকিয়ে থাকাটা প্রয়োজন। কারণ নির্বলকে যদি সবলের হাত থেকে বাঁচতে হয় তাহলে—পালানো বা লুকানো, এই দুটি মাত্র উপায় ছাড়া তৃতীয় কোনও উপায় নেই।
পাঠকদেরকে ভাগবতের পৌরাণিক উপাখ্যান স্মরণ করতে বলবো। কংসের মৃত্যুর পর তাঁর দুই বিধবা পত্নী অস্তি এবং প্রাপ্তি —দু’ জনে মগধে গিয়ে পিতা জরাসন্ধকে সমস্ত বার্তা জানালে জরাসন্ধ মথুরা আক্রমণ করলেন। প্রসঙ্গত, জেনে রাখাটা দরকার, যে সময়ে কৃষ্ণ জন্মেছিলেন সে সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা কিন্তু একেবারেই তাঁর অনুকূলে ছিল না। সে সময়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভরকেন্দ্রটা প্রায় পুরোটাই ছিল পূর্ব-মধ্য ভারতীয়দের দখলে, যার প্রধান ছিলেন তিনজন— মগধরাজ জরাসন্ধ, চেদিরাজ শিশুপাল, আর পুণ্ড্রবর্ধনের রাজা পৌণ্ড্রবাসুদেব। মানে আজকের দিনের উত্তরপ্রদেশের পূর্ব ভাগ আর ছত্তিশগড়ের একটা সামান্য কিছু অংশ থেকে শুরু করে বিহারের উত্তরাঞ্চল এবং বাংলার উত্তরভাগ নিয়ে ছিল বিশাল এই সাম্রাজ্য, যার নায়ক ছিলেন মগধরাজ জরাসন্ধ এবং সমগ্র রাজমণ্ডল তাঁর কথাতেই ওঠা-বসা করতেন। আর কৃষ্ণের মামা কংস ছিলেন, এই জরাসন্ধেরই জামাই এবং মগধরাজের মথুরার প্রতিনিধি মাত্র। ফলে জামাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে জরাসন্ধের মথুরা আক্রমণটা খুব একটা অযৌক্তিক ছিল না। শ্রীমদ্ভাগবতের তথ্য অনুযায়ী জরাসন্ধ নাকি ১৮ বার মথুরা আক্রমণ করেছিলেন এবং প্রত্যেকবারই কৃষ্ণ এবং বলরামের হাতে পরাজিত হয়েছিলেন। কীভাবে পরাজিত হয়েছিলেন সে কাহিনি এখানে বিস্তৃত করবো না, উত্সাহী পাঠককে শুধু বলবো শ্রীভাগবতের পাতায় অনুসন্ধান করতে। শুধু এইটুকু বলবো যে শ্রীকৃষ্ণে রণনীতি এবং অলৌকিক ক্ষমতার জন্যেই মথুরা বার বার জরাসন্ধের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু বার বার এই আক্রমণ মথুরাবাসীদের কাছে যে অসহ্য হয়ে উঠেছিল সে খবর আমরা ভাগবত থেকে জানতে পারি। শক্তিশালী জরাসন্ধের সৈন্যবাহিনীর সামনে মথুরার এই সেনা যে দুর্বল ছিল এতে কোনও সন্দেহ নেই। তাই যাদবেরা শ্রীকৃষ্ণের পরাপর্শে জরাসন্ধের এই ক্রমাগত আক্রমণ থেকে নিষ্কৃতি পেতেই মথুরা ছেড়ে দ্বারকায় চলে গিয়েছিলেন। বলা ভালো, সকলে পালিয়ে গিয়েছিলেন। রাজনৈতিক অভিসন্ধি সিদ্ধির কারণে কিছুদিন লুকিয়ে থাকা বা পালিয়ে যাওয়াটা কিছু নতুন নয়। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরও বারাণাবতে লাক্ষাগৃহে আগুন লাগবার পর একচক্রা নগরীতে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে লুকিয়ে ছিলেন সপরিবারে। কারণ সেই সময়ে বলবান দুর্যোধনের সামনে আত্মপ্রকাশ করাটা নিরাপদ ছিল না। দ্রৌপদীকে বিবাহ করবার পর দ্রুপদের মতো শক্তিশালী রাজার যখন সহযোগীতা পেলেন তাঁরা তখনই পাণ্ডবরা আত্মপ্রকাশ করেছিন।
যাইহোক, এই সব পৌরাণিক আখ্যান-উপাখ্যানের কথা এখানেই থামিয়ে দেওয়াটা এখন শ্রেয়। এইসব কথার মধ্যে ঢুকে গেলে তিন মাছের কাহিনি থেকে আমরা দূরে চলে যাব।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৮: যে শাসক বেশি কথা বলেন তাঁর পতন অনিবার্য

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২: রাজমালা অনুসারে রত্ন মাণিক্যের পিতা হলেন ডাঙ্গর ফা, তিনিই ধর্ম মাণিক্য

অনাগতবিধাতার মতে রাত্রেই সেই সরোবর ছেড়ে চলে যাওয়াটাই শ্রেয়। মাছটির ‘অনাগতবিধাতা’ নাম দিয়েই কিন্তু পঞ্চতন্ত্রকার তার চারিত্রিক এবং মানসিক বৈশিষ্টগুলি চিহ্নিত করে দিয়েছেন। “অনাগত” শব্দের অর্থ হল “যা এখনও আসেনি” এক্ষেত্রে অর্থ করতে হবে “যে বিপদ এখনও আসেনি”; সেই অনাগত বিপদ সম্পর্কে যিনি বিধান দেন তিনিই “অনাগতবিধাতা”। সোজা কথায় বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিলে কিংবা বিপদ আসবার আগেই যিনি প্রতিকারের বিধান দেন বা ব্যবস্থা নেন তিনিই “অনাগতবিধাতা”।

তাই সে বাকি মাছেদেরকে বলল, কাল সকালে সেই জেলেদের দলটা এসে এই সরোবরে সমস্ত মাছ যে ধরে নিয়ে যাবে সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহই নেই। তাই আমার যুক্তি হল, এখানে আর একটুও সময় নষ্ট করা উচিত নয় আমাদের। কারণ শাস্ত্রে বলে, যে লোকের সুখে থাকবার মতো অন্য আশ্রয় আছে, সেই বিদ্বান ব্যক্তি বিপদে-আপদে বা সময়ে-অসময়ে সেখানে আশ্রয় নিলে নিজের শরীর কিংবা কুলের বিনাশ তাঁকে দেখতে হয় না। তাই আমাদের নিকটবর্তী অন্য সরোবরে যেখানে আমরা সুখে থাকতে পারবো, আমার মনে হয়, আমাদেরও সেখানে চলে যাওয়াটাই শ্রেয় হবে।

অনাগতবিধাতার অতিসাবধান বাণী শুনে ‘প্রত্যুত্পন্নমতি’ নামক দ্বিতীয় মাছটি বলল, “অহো! সত্যমভিহিতং ভবতা” —আপনি যথার্থই বলেছেন। আমারও এই একই কথা, অন্য জায়গায় চলে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। লোকেরা বলেন—
পরদেশভযাদ্ ভীতা বহুমাযা নপুংসকা।
স্বদেশে নিধনং যান্তি কাকাঃ কাপুরুষা মৃগা।। (ঐ, ৩৫০)
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৯: সুন্দরবনের ব্যাঘ্র-ইতিহাস

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৬: সারদা মায়ের ছোটকাকা ও পুত্রপ্রতিম স্বামীজির জীবনাবসান

নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে বাস করতে যারা ভয় পায় এবং স্বদেশের মায়ায় কাজকর্ম না করে নিজের দেশেই পড়ে থাকে। সেইরকম পৌরুষহীন মানুষ কাক এবং মৃগের সমান —যে নিজের দেশেই জন্মায় এবং নিজের দেশেই মরে যায়। নিজেকে নিজে রক্ষা পর্যন্তও করতে পারে না। কিন্তু যার সর্বত্র গতি, সব জায়গাকেই যিনি নিজের মনে করেন তার কাছে স্বদেশ কী আর বিদেশই বা কী? সব জায়গাতেই তিনি মিলেমিশে থাকতে পারেন, নিজের ভেবে নিয়ে থাকতে পারেন। তাই বিপদ-আপদে কিংবা নিরপত্তার অভাবে নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। উন্নতি সেখানেই যেখানে নিরাপত্তা আছে। তাই নিরপত্তার কথা চিন্তা করে প্রয়োজনে নিজের দেশ ছেড়ে অন্যত্র যেতে যে ভয় পায় না, সেই ব্যক্তিই জীবনে উন্নতি করে। আর কাপুরুষেরা বাপের তৈরী কুঁয়োর জলই ভালো এইকথা মনের মধ্যে রেখে সগর্বে তার ক্ষার-জল খেয়েই বেঁচে থাকে। নতুন কুঁয়োর সন্ধান তারা করে না, ফলে মিষ্টি জলের আস্বাদ গ্রহণে তারা ব্যর্থ হয়। তাদের মতো লোকেদের পতন অনিবার্য— “তাতস্য কূপোঽযমিতি ব্রুবাণাঃ ক্ষারং জলং কাপুরুষাঃ পিবন্তি।”

প্রত্যুত্পন্নমতির কথা শুনে যদ্ভবিষ্য ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল— “অহো! ন ভবদ্ভ্যাং মন্ত্রিতং সম্যগেতদিতি, যতঃ বাঙ্মাত্রেণাপি তেষাং পিতৃপৈতামহকমেতত্সরস্ত্যক্তুং যুজ্যতে”। তোমাদের দু’জনের বিচারবুদ্ধি আমার মোটেও সুবিধার লাগছে না। শুধু কিছু উড়ো কথায় বিশ্বাস করে পিতৃপিতামহের আমলের জলাশয়কে ত্যাগ করে যাওয়াটা মোটেই বুদ্ধিমানের কথা নয়। আর সত্যি কথা বলতে যদি ভাগ্যে আয়ু না থাকে, তাহলে অন্য যেখানেই যাইনা কেন মৃত্যু অনিবার্য।

যদ্ভবিষ্য নামটির মাধ্যমেই তার মানসিকতাটা ঠিক কেমন সেটা বোঝাবার চেষ্টা করেছেন পঞ্চতন্ত্রকার। যিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত নন, অনেকটা “Don’t Care” ভাব, মানে ভবিষ্যতে কপালে যা আছে তাই হবে। ভবিতব্যকে খণ্ডানো যাবে না। সেই যদ্ভবিষ্যের মতে—
অরক্ষিতং তিষ্ঠতি দৈবরক্ষিতং
সুরক্ষিতং দৈবহতং বিনশ্যতি।
জীবত্যনাথোঽপি বনে বিসর্জিতঃ
কৃতপ্রযত্নোঽপি গৃহে বিনশ্যতি।। (ঐ, ৩৫২)


অর্থাৎ দৈব যদি সহায় হয় তাহলে অনাথ কাউকে বনের মধ্যে ফেলে গেলেও সে বেঁচে থাকে। আর সেই দৈবই যদি বিপরীত হয় তাহলে বাড়ির মধ্যে সযত্নে সুরক্ষিত অবস্থাতে থাকলে বিনাশ হতে পারে।
শেষে যদ্ভবিষ্য বলল, তাই আমি এই জলাশয় ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না, তোমাদের দুজনে যেটা সঠিক মনে হয় তাই করো।
“অনাগতবিধাতা” সাবধানী আর “প্রত্যুত্পন্নমতি”ও বুদ্ধি ধরে। তাই সেইদিন রাত্রের অন্ধকারেই তারা সপরিবারে চলে গেলো নিকটবর্তী অন্য জলাশয়ে। পরদিন সকালে জেলেরা যখন সেই সরোবরে জাল ফেললো তখন যদ্ভবিষ্য’র সঙ্গে সঙ্গে আর যে সব মাছেরা সেখানে রয়ে গিয়েছিলো তাদের সকলে ধরে ফেললো।
 

১৪ কাহিনি সমাপ্ত

আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৩: ক্রোধ ও ক্ষমা, কোনটির প্রভাব বেশি? হিংসা ও প্রতিহিংসার ফল কী সুদূরপ্রসারী?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮২: রবীন্দ্রনাথ সাহেব-শিক্ষকদের কাছেও পড়েছেন

উপরের কাহিনিটি কোথাও কোথাও আরেকটু ভিন্নরূপেও দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে আমরা পাই একা অনাগতবিধাতাই সেদিন রাত্রে অন্য জলাশয়ে চলে যায়। প্রত্যুত্পন্নমতি আর যদ্ভবিষ্য থেকে যায় সেই জলাশয়ে। পরদিন প্রত্যুত্পন্নমতি আর যদ্ভবিষ্য, দু’জনেই জালে ধরা পরে। কিন্তু “প্রত্যুত্পন্নমতি” তার উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগায় আর মরার মতন পরে থাকে। জেলেরা তাকে মৃত ভেবে জাল থেকে খুলে রাখলেই সে লাফিয়ে গভীর জলে মধ্যে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে, কিন্তু যদ্ভবিষ্য মারা পড়ে। পাঠক-পাঠিকাদেরকে খেয়াল করতে বলবো, এই গল্পটির মাধ্যমে পঞ্চতন্ত্রকার ভারতীয় দর্শনের দৈব ও পুরুষকার নিয়ে তৈরী হওয়া চিরন্তন দ্বন্দ্বকে কেমন সুন্দরভাবে রাজপুত্রদের কাছে তুলে ধরলেন। বিজিগীষু হতে গেলে বা উন্নতি করতে গেলে দৈবের উপর ভরসা করে থাকলে যে কিছুই হবার নয়, এই গল্পটি সেই কথাটাই বলে।
টিট্টিভী বলল, এই কারণেই আমি বলেছিলাম “অনাগতবিধাতা আর প্রত্যুত্পন্নমতি, এ দুজনেই সুখে থাকে, শুধু যদ্ভবিষ্যই বিনষ্ট হয়ে যায়।”

পুরুষ পাখীটি তাই শুনে বলল, হে কল্যাণী! তুমি কি আমাকে যদ্ভবিষ্যের মতো ভাবছো? আমার বুদ্ধির উপর কিছুটা অন্ততঃ ভরসা রাখো; এই দুষ্ট সমুদ্রটাকে আমি আমার ঠোঁট দিয়ে কেমন শুকিয়ে দিই দেখো।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content