ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
মিত্রভেদ
১৪: তিনটি মাছের কাহিনি
কোনও এক নাম না দেশের জলাশয়ে ‘অনাগতবিধাতা’, ‘প্রত্যুত্পন্নমতি’, আর ‘যদ্ভবিষ্য’ নামে তিনটি মাছ বাস করতো। মিলে মিশে তাঁদের দিন কাটছিল বেশ ভালোই। একদিন অপরাহ্নে একদল জেলে সেই জলাশয়ের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বিশাল সেই জলাশয়টাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। একজন বললে, “অহো বহুমৎস্যোঽযং হ্রদঃ”—এ জলাশয়ে নিঃসন্দেহে অনেক মাছ আছে। এতদিন এই জলাশয়টা আমাদের চোখে পড়েনি কেন এটা ভেবেই আশ্চর্য লাগছে। আজকের মতো খাওয়া-দাওয়া তো জুটে গিয়েছে আর এ দিকে সন্ধেও প্রায় ঘনিয়ে এলো। তাই আগামীকাল সক্কাল সক্কাল আমরা এখানে আসবো।
সরোবরের তীরে জেলেদের নিজেদের মধ্যে এইরকম কথাবার্তা শুনে তিনটে মাছের মাথায় যেন বাজ পড়লো। সব মাছেদের ডেকে আপত্কালীন সভা বসালো তারা জলাশয়ের গভীরে। সবটা বুঝে শুনে অনাগতবিধাতা বললে, আপনারা তো সকলেই মত্স্যজীবিদের সমস্ত কথাবার্তা শুনলেন। এখন আমার পরামর্শ হল বাঁচতে হলে আজই রাত্রির মধ্যে নিকটবর্তী অন্য কোনও একটা জলাশয়ে আমাদের চলে যেতে হবে। পণ্ডিতেরা বলেন—
সংশ্রিতব্যোঽথবা দুর্গো নান্যা তেষাং গতির্ভবেৎ।। (মিত্রভেদ, ৩৪৮)
নিজকে যদি থেকে বলবান শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে হয়, তাহলে পালিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ; আর তা না হলে অন্তত দুর্গের ভিতরে কোথাও কোনও গোপন স্থানে লুকিয়ে থাকাটা প্রয়োজন। কারণ নির্বলকে যদি সবলের হাত থেকে বাঁচতে হয় তাহলে—পালানো বা লুকানো, এই দুটি মাত্র উপায় ছাড়া তৃতীয় কোনও উপায় নেই।
যাইহোক, এই সব পৌরাণিক আখ্যান-উপাখ্যানের কথা এখানেই থামিয়ে দেওয়াটা এখন শ্রেয়। এইসব কথার মধ্যে ঢুকে গেলে তিন মাছের কাহিনি থেকে আমরা দূরে চলে যাব।
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৮: যে শাসক বেশি কথা বলেন তাঁর পতন অনিবার্য
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২: রাজমালা অনুসারে রত্ন মাণিক্যের পিতা হলেন ডাঙ্গর ফা, তিনিই ধর্ম মাণিক্য
তাই সে বাকি মাছেদেরকে বলল, কাল সকালে সেই জেলেদের দলটা এসে এই সরোবরে সমস্ত মাছ যে ধরে নিয়ে যাবে সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহই নেই। তাই আমার যুক্তি হল, এখানে আর একটুও সময় নষ্ট করা উচিত নয় আমাদের। কারণ শাস্ত্রে বলে, যে লোকের সুখে থাকবার মতো অন্য আশ্রয় আছে, সেই বিদ্বান ব্যক্তি বিপদে-আপদে বা সময়ে-অসময়ে সেখানে আশ্রয় নিলে নিজের শরীর কিংবা কুলের বিনাশ তাঁকে দেখতে হয় না। তাই আমাদের নিকটবর্তী অন্য সরোবরে যেখানে আমরা সুখে থাকতে পারবো, আমার মনে হয়, আমাদেরও সেখানে চলে যাওয়াটাই শ্রেয় হবে।
অনাগতবিধাতার অতিসাবধান বাণী শুনে ‘প্রত্যুত্পন্নমতি’ নামক দ্বিতীয় মাছটি বলল, “অহো! সত্যমভিহিতং ভবতা” —আপনি যথার্থই বলেছেন। আমারও এই একই কথা, অন্য জায়গায় চলে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। লোকেরা বলেন—
স্বদেশে নিধনং যান্তি কাকাঃ কাপুরুষা মৃগা।। (ঐ, ৩৫০)
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৯: সুন্দরবনের ব্যাঘ্র-ইতিহাস
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৬: সারদা মায়ের ছোটকাকা ও পুত্রপ্রতিম স্বামীজির জীবনাবসান
প্রত্যুত্পন্নমতির কথা শুনে যদ্ভবিষ্য ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল— “অহো! ন ভবদ্ভ্যাং মন্ত্রিতং সম্যগেতদিতি, যতঃ বাঙ্মাত্রেণাপি তেষাং পিতৃপৈতামহকমেতত্সরস্ত্যক্তুং যুজ্যতে”। তোমাদের দু’জনের বিচারবুদ্ধি আমার মোটেও সুবিধার লাগছে না। শুধু কিছু উড়ো কথায় বিশ্বাস করে পিতৃপিতামহের আমলের জলাশয়কে ত্যাগ করে যাওয়াটা মোটেই বুদ্ধিমানের কথা নয়। আর সত্যি কথা বলতে যদি ভাগ্যে আয়ু না থাকে, তাহলে অন্য যেখানেই যাইনা কেন মৃত্যু অনিবার্য।
যদ্ভবিষ্য নামটির মাধ্যমেই তার মানসিকতাটা ঠিক কেমন সেটা বোঝাবার চেষ্টা করেছেন পঞ্চতন্ত্রকার। যিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত নন, অনেকটা “Don’t Care” ভাব, মানে ভবিষ্যতে কপালে যা আছে তাই হবে। ভবিতব্যকে খণ্ডানো যাবে না। সেই যদ্ভবিষ্যের মতে—
সুরক্ষিতং দৈবহতং বিনশ্যতি।
জীবত্যনাথোঽপি বনে বিসর্জিতঃ
কৃতপ্রযত্নোঽপি গৃহে বিনশ্যতি।। (ঐ, ৩৫২)
অর্থাৎ দৈব যদি সহায় হয় তাহলে অনাথ কাউকে বনের মধ্যে ফেলে গেলেও সে বেঁচে থাকে। আর সেই দৈবই যদি বিপরীত হয় তাহলে বাড়ির মধ্যে সযত্নে সুরক্ষিত অবস্থাতে থাকলে বিনাশ হতে পারে।
শেষে যদ্ভবিষ্য বলল, তাই আমি এই জলাশয় ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না, তোমাদের দুজনে যেটা সঠিক মনে হয় তাই করো।
“অনাগতবিধাতা” সাবধানী আর “প্রত্যুত্পন্নমতি”ও বুদ্ধি ধরে। তাই সেইদিন রাত্রের অন্ধকারেই তারা সপরিবারে চলে গেলো নিকটবর্তী অন্য জলাশয়ে। পরদিন সকালে জেলেরা যখন সেই সরোবরে জাল ফেললো তখন যদ্ভবিষ্য’র সঙ্গে সঙ্গে আর যে সব মাছেরা সেখানে রয়ে গিয়েছিলো তাদের সকলে ধরে ফেললো।
১৪ কাহিনি সমাপ্ত
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৩: ক্রোধ ও ক্ষমা, কোনটির প্রভাব বেশি? হিংসা ও প্রতিহিংসার ফল কী সুদূরপ্রসারী?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮২: রবীন্দ্রনাথ সাহেব-শিক্ষকদের কাছেও পড়েছেন
টিট্টিভী বলল, এই কারণেই আমি বলেছিলাম “অনাগতবিধাতা আর প্রত্যুত্পন্নমতি, এ দুজনেই সুখে থাকে, শুধু যদ্ভবিষ্যই বিনষ্ট হয়ে যায়।”
পুরুষ পাখীটি তাই শুনে বলল, হে কল্যাণী! তুমি কি আমাকে যদ্ভবিষ্যের মতো ভাবছো? আমার বুদ্ধির উপর কিছুটা অন্ততঃ ভরসা রাখো; এই দুষ্ট সমুদ্রটাকে আমি আমার ঠোঁট দিয়ে কেমন শুকিয়ে দিই দেখো।—চলবে।