বুধবার ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪


মা সারদা।

১৬ বোসপাড়া লেনে একটি বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়। ১৩০৭ সালের কার্তিক মাসে শ্রীমা তাঁর কাকা নীলমাধব, ভানুপিসি আর অভয়ের স্ত্রী সুরবালার সঙ্গে কলকাতায় এসে এখানে কয়েক মাস থাকেন। শ্রীমা যথারীতি প্রায় প্রতিদিন গঙ্গা স্নানে যেতেন। সেই সময় মা ও ঠাকুরের ভক্ত কেদারনাথ দাসের শ্রীমাকে দর্শন লাভের সৌভাগ্য ঘটে ও মার প্রতি তাঁর অগাধ ভক্তি জন্মায়। একবার কেদার খড়ের ব্যবসায় আশাতীত লাভ করেন। তখন থেকে তাঁর মা সারদার জন্য স্থায়ী বাসস্থানের ব্যবস্থা করার কথা মনে হয়। এই কারণে তিনি মায়ের বাসভবনের জন্য তিন কাঠা চার ছটাক জমি কিনে দান করেন।
১৩০৮ সালের ভাদ্র মাসে স্বামীজির লেখা চিঠি থেকে জানা যায় যে, মা তখন দেশে ছিলেন। পুজোর আগে তিনি দেশ থেকে কলকাতায় আসেন এবং পুজোর পরও কিছুকাল থাকেন। ১৩০৯ সালের ২০ আষাঢ় স্বামীজি যখন লোকান্তরিত হন, শ্রীমা তখন তাঁর পিত্রালয়ে। এই মর্মান্তিক সংবাদ শুনে সেসময় মা সারদা কিরূপ আচরণ করেছিলেন, তার কোনও কিছুই জানা যায় না। তবে শ্রীমা ভক্তদের কাছে স্বামীজির গৌরবময় জীবনের ঘটনাগুলি সবসময় কীর্তন করতেন। মা প্রিয় নরেনের অকালে চলে যাওয়ার ব্যথা নীরবে সহ্য করেছেন। কখনও প্রকাশ করেননি। ১৩১০ সালের পৌষ মাসে শরৎ মহারাজ বাগবাজার স্ট্রিটের ২-১ নম্বর বাড়ি ভাড়া করে রাখেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৫: মা সারদার ভ্রাতৃবিয়োগ

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১: রাজমালা ও ইতিহাসের আলোকে ত্রিপুরা

মাঘমাসে শ্রীমা কলকাতার এই বাড়িতে একবছরের বেশি সময় থাকেন। বিরজানন্দ, গণেন্দ্রনাথ ও যোগীনমার সঙ্গে জয়রামবাটি গিয়ে শরৎ মহারাজ বর্ধমানের পথে শ্রীমাকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। মার সঙ্গে, মার কাকা নীলমাধব, ভানুপিসি ও অনেকে ছিলেন। এই বাড়ি থেকেই শরৎ মহারাজ মায়ের সেবা পরিচালনা করতেন। এই সময় থেকে মিসেস বুল শ্রীমায়ের সেবায় মাসে ষাট টাকা করে দিতেন। এখান থেকেই মা ভক্তদের আমন্ত্রণে রথযাত্রার দিন এন্টালি শ্রীরামকৃষ্ণ অর্চনালয়ে এবং জন্মাষ্টমীর মহোৎসবে কাঁকুড়গাছির যোগোদ্যানে যান। যোগোদ্যান মঠে অতিরিক্ত গরম ও ভিড়ে মা প্রায় সারাদিন একইভাবে বসে থেকেছেন। দলে দলে অসংখ্য ভক্তদের দর্শন দিয়ে কৃতার্থ করেছেন আর তাদের প্রণাম গ্রহণ করেছেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৮: সুন্দরবনের ব্যাঘ্র-পরিচয়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৬: বুকে ব্যথা মানেই কি গ্যাসের ব্যথা? হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ না কি গ্যাসের ব্যথা, বুঝবেন কী ভাবে?

১৩১১ সালে অঘ্রাণের মধ্যভাগে স্বামী প্রেমানন্দ, নীলমাধবকাকা, লক্ষ্মীদেবী, গোলাপমা, নিকুঞ্জদেবী, ও চুনীলাল বসুর স্ত্রী প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে মা আবার পুরী যান। তখন নিজের মাতা ও ভাইদের স্ত্রীদের দেশ থেকে নিয়ে আসার জন্য আশুতোষকে পাঠান। মায়ের তৃতীয় ভ্রাতা কালীকুমার সহ সেসময় আরও অনেকে পুরী গিয়েছিলেন। তার কিছুদিন পর মাস্টার মশাইর সঙ্গে মার আরও এক ভাই বরদাপ্রসাদ পুরী যান। মায়ের ছোটভাইয়ের বউ সবসময় মার সঙ্গেই ছিলেন। তাঁর মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না। তিনি শ্যামাসুন্দরী ও অপর তিন ভাইয়ের বউকে পুরীধামে হঠাৎ দেখে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে মার মুখের ওপর হাত নেড়ে বলতে থাকেন, ‘কমলালেবুর প্রাণ, তোমার ভেতর এত রস কে জানে সন্ধান, তোমার ভাল ভাজ, (অর্থাৎ বরদাপ্রসাদের স্ত্রী ইন্দুমতী যিনি তাঁর থেকে ছোট ছিলেন, তাই মা তাকে স্নেহ করতেন। এইজন্য তিনি তাকে “ভাল ভাজ” বলেছেন)। সকলকে নিয়ে এসেচ’। শ্রীমা বলেন, ‘তা আনবনি? আমার বুড়ো মা, তোকে এনেচি, আর তাঁকে আনবনি?’।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, পর্ব-১৪: শোভনাসুন্দরী—ঠাকুরবাড়ির এক সরস্বতী!

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮২: রবীন্দ্রনাথ সাহেব-শিক্ষকদের কাছেও পড়েছেন

এই সময় পায়ের একটি ফোঁড়া নিয়ে মা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলেন। ফোঁড়া পেকে গেলেও তিনি কাউকে ছুঁতে দিতেন না। একবার মন্দির দর্শনে গিয়ে অতি ভিড় দেখে পায়ে চোট লাগার ভয়ে মা চিৎকার করে ওঠেন। তখন আশুতোষ মাকে শূন্যে উঁচু করে তুলে কোনওরকমে বাইরে আনেন। এ বার বাবুরাম মহারাজের পরামর্শে একজন ডাক্তার মাকে দেখতে এসে প্রণাম করেই ছুরি দিয়ে ফোঁড়ার মুখটা চিরে দেন। কোনও ভক্ত এসেছেন শুনে শ্রীমা ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আর আশুতোষ মায়ের পা চেপে রেখেছিলেন। তাদের হঠাৎ এরকম করতে দেখে মা চিৎকার করে ওঠেন আর আশুতোষকে তিরস্কার করেন। বাবুরাম মহারাজ ভয়ে আর ভেতরে প্রবেশ করেননি। ডাক্তারও শীঘ্র তার কাজ সেরে ‘মা আমার অপরাধ নেবেন না’ বলে চলে আসেন। পুরীর মন্দিরে শ্রীজগন্নাথের বালভোগ ‘কর্মা বাঈয়ের খিচুড়ি’ সকলে মিলে মাকে খাওয়ান, মাও সকলকে খাওয়ান।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫২: রামচন্দ্রের বনবাসগমনের সিদ্ধান্তে নৈতিকতার জয়? নাকি পিতার প্রতি আনুগত্যের জয় ঘোষণা?

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৩: লিপ ইয়ার

শ্রীমা স্বয়ং বলেন, ‘তোমরা আমার মুখে প্রসাদ দাও’। পুরীতে ক্ষেত্রবাসী বাড়িতে অবস্থানকালে সকলের সঙ্গে বসে মা পুরুষোত্তমখণ্ড শ্রবণ করেন ও শোনার পর পাণ্ডাভোজন করান। কিছুদিন পুরীতে থাকার ফলে শ্রীমায়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। দু’ দিন তিনি সমুদ্রস্নানও করেন। গুণ্ডিচাবাড়ি ও নরেন্দ্রসরোবর প্রভৃতি স্থানে ভ্রমণ করেন। জগন্নাথদেবের বৃহৎ রন্ধনশালাও দেখেন। লক্ষ্মীদেবী একবার শ্রীমার সঙ্গে ভুবনেশ্বরে যান বলেও শোনা যায়। ব্রহ্মচারি অক্ষয়চৈতন্য মনে করেন যে, এই সময়েই মা ভুবনেশ্বর ও লিঙ্গরাজাদি মন্দির দর্শন করেন। পুরী থেকে কালীকুমার ও তাঁর স্ত্রী সহ কয়েকজন পৌষমাসের মধ্যে দেশে ফিরে যান। অন্য সকলে মাঘমাসের প্রথমভাগে শ্রীমার সঙ্গে কলকাতায় আসেন। কলকাতায় আসার দুমাস পর মার কাকা নীলমাধব হাঁপানি রোগে দেহত্যাগ করেন। শ্রীমার অনুরোধে গণেন্দ্রনাথ নীলমাধব আর শ্যামাসুন্দরীর ফটো তুলে দিয়েছিলেন।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content