রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


রবীন্দ্রনাথ : যখন বালক।

রবীন্দ্রনাথ শিক্ষক হিসেবে কেমন ছিলেন সে সুখকর বিবরণ আছে নানাজনের স্মৃতিচর্চায়। আশ্রম শিক্ষক অজিতকুমার চক্রবর্তীকে তিনি লিখেছিলেন, ‘ছেলেদের পড়াতে এত ভালো লাগছে যে, এর সঙ্গে আর কোনো কাজের তুলনা হয় না…।’ একজন আদর্শ শিক্ষকের যে যে গুণ থাকা দরকার, সবই ছিল রবীন্দ্রনাথের।

আশ্রম-শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ ছাত্রদের সঙ্গে মিশতেন। ছিল বড়োই স্নেহ-মধুর সম্পর্ক। বড়দের থেকে ছোটদের পড়াতে বেশি ভালবাসতেন কবি। কৃত্রিম দূরত্ব, বানানো গাম্ভীর্য নয়, পরতে পরতে ছিল স্নেহময়তা। তাঁর পড়ানো কখনো নিরস পুঁথিসর্বস্ব হয়ে ওঠেনি। ছিল প্রাণের ছোঁয়া, আনন্দ। ছেলেবেলায় তিনি নিজে অবশ্য পড়াশোনার মধ্যে এমন আনন্দ খুঁজে পাননি। স্নেহের স্পর্শ তো দূরের কথা, কোনও কোনও শিক্ষকের আচরণ ছিল বড়ই হৃদয়বিদারক, তা মর্মযন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠেছিল। শৈশব-বাল্যে শিক্ষকদের নিয়ে ভালো অভিজ্ঞতার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের তিক্ত অভিজ্ঞতাও হয়েছিল অনেক। হরনাথ পণ্ডিতকে তিনি একেবারেই শ্রদ্ধাই করতে পারতেন না। নর্মাল স্কুলের এই শিক্ষক তো কথায় কথায় ‘কুৎসিত ভাষা’ ব্যবহার করতেন। রবীন্দ্রনাথের বাংলা পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়া নিয়ে কী জল ঘোলাই না করেছিলেন তিনি। যিনি সর্বাধিক নম্বর দিয়েছিলেন, শিক্ষক মধুসূদন বাচস্পতি পক্ষপাতিত্ব করেছেন, এমনও বলতে তাঁর কুণ্ঠা হয়নি।
ছেলেবেলার শিক্ষকেরা অনেকেই সেভাবে বালক রবীন্দ্রনাথকে আকৃষ্ট করতে পারেননি। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ সঞ্চার করতেও পারেননি। মেডিকেল কলেজের ছাত্র অঘোরনাথ এসেছিলেন ইংরেজি পড়াতে। তিনি যখন প্যারীচরণ সরকারের ‘ফার্স্টবুক’ বোঝাতেন, রবীন্দ্রনাথের ‘প্রথমে উঠত হাই, তারপর আসত ঘুম, তারপর চলন্ত চোখ-রগড়ানি।’

সংখ্যায় কম হলেও দু’ একজন ঘরের মাস্টারমশায়ের, দু’ একজন স্কুলের মাস্টারমশায়ের পড়ানো ভালো লাগত রবীন্দ্রনাথের। যেমন, সীতানাথ দত্ত। হাতে কলমে বিজ্ঞান পড়াতেন, শেখাতেন। প্রতি রবিবার আসতেন তিনি। না এলে রবিবারটাকে ‘রবিবার’ বলেই মনে হত না। রবীন্দ্রনাথের জীবনে সাহেব-মাস্টারমশায়দের ভূমিকা রয়েছে। তাঁদের সম্পর্কে কেমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল কবির, তা জানার জন্য আমাদের কৌতূহলও কম নয়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮১: কবির ‘গানের ভাণ্ডারী’ দিনেন্দ্রনাথ বৈষয়িক-কারণে শান্তিনিকেতন ত্যাগ করেছিলেন

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৮: সুন্দরবনের ব্যাঘ্র-পরিচয়

রবীন্দ্রনাথ সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের স্কুল-বিভাগে কিছুকাল পড়েছেন। স্কুলে ছিল সাহেব-শিক্ষক। পড়াতেন ফাদার ডি পেনেরান্ডা। এই স্পেনীয়-শিক্ষক রবীন্দ্রনাথকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন। তাঁকে ঘিরে রবীন্দ্রনাথেরও এক অদ্ভুত ভালো লাগা ছিল। সে উপলব্ধি অন্তর থেকে উৎসারিত। কোন খাদ ছিল না। জীবনের মধ্যপর্বে ‘জীবনস্মৃতি’ লিখতে বসে কবি ফিরে গিয়েছিলেন দূর-অতীতে। মনে হয়েছে তাঁর, ‘তিনি সর্বদাই আপনার মধ্যে যেন একটি দেবোপাসনা বহন করিতেছেন, অন্তরের বৃহৎ এবং নিবিড় স্তব্ধতায় তাঁহাকে যে আবৃত করিয়া রাখিয়াছে।’ ক্লাসের সব ছেলেরাই তখন লেখায় মগ্ন। ব্যতিক্রম শুধু রবীন্দ্রনাথ। অত ছেলের মাঝেও ফাদারের নজর থাকত তাঁর দিকে। পিছনে এসে দাঁড়িয়ে সস্নেহে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘টাগোর, তোমার কি শরীর ভালো নাই?’

রবীন্দ্রনাথ : যখন কিশোর।

সাহেব-শিক্ষকের এই স্নেহময়তা, ভালোবাসা রবীন্দ্রনাথের মনে এক সুদূর প্রসারিত প্রভাব বিস্তার করেছিল। ‘জীবনস্মৃতি’ লিখতে বসে কবির মনে পড়েছে, সেই ফাদারের কথা। কবি তাঁর ‘ভিতরকার একটি বৃহৎ মনকে’ দেখতে পেয়েছিলেন। ফাদার ডি পেনেরান্ডারকে কবি ভুলতে পারেননি কখনো। ও দেশে গিয়েও রবীন্দ্রনাথ একাধিক সাহেব-শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। চোখে মুখে স্বপ্ন নিয়ে পড়াশোনার প্রয়োজনে ও দেশে সফর গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তখন তাঁর বছর সতেরো বয়েস। বিলেতে গিয়ে, লন্ডন শহরে এক এমন শিক্ষকের সংস্পর্শে এসেছিলেন, যিনি প্রায়শই ভাবের ঘোরে, বে-খেয়ালে থাকতেন। তাঁর প্রতি কবির গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জাগ্ৰত হয়েছিল। পড়াতে পড়াতে কখনও কখনও খুবই অন্যমনস্ক হয়ে পড়তেন। মনে হত, মুখের কথা তিনি হারিয়ে ফেলেছেন, কী বলবেন বুঝে পাচ্ছেন না। নিজের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি যে বিপুল পরিশ্রম করতেন, তা অভাবনীয়। তাঁর জন্য রবীন্দ্রনাথের কাতরতাও কম ছিল না। লিখেছেন কবি, ‘অনশনক্লিষ্ট লোকটিকে দেখিলে আমার বড়োই বেদনা বোধ হইত।’
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-২৮: পেপসি-টেপসি

লন্ডনে রবীন্দ্রনাথ ল্যাটিন এবং গ্রিক পণ্ডিত বার্কারের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তিনি অবশ্য সেভাবে কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনে ছাপ ফেলতে পারেননি, বরং হেনরি মর্লি গভীরভাবে আপ্লুত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে রবীন্দ্রনাথ ‘ছেলেবেলা’ নামে যে বইটি লিখেছিলেন, সে বইতে কবি মনে মনে ফিরে গিয়েছিলেন লন্ডনে। স্মৃতির পাতা ওল্টাতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে মনে পড়েছে মর্লিকে। লিখেছেন, ‘সাহিত্য তাঁর মনে, তাঁর গলার সুরে, প্রাণ পেয়ে উঠত— আমাদের এই মরমে পৌঁছত যেখানে প্রাণ চায় আপন খোরাক, মাঝখানে রসের কিছুই লোকসান হত না।’

রবীন্দ্রনাথ : জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পেন্সিল-স্কেচ অবলম্বনে গগনেন্দ্রনাথের আঁকা।

ও দেশের শিক্ষাধারা, শিক্ষাদান সম্পর্কে আধুনিক ভাবনা রবীন্দ্রনাথ স্পর্শ করেছিল। সেসব তাঁর মনে ছিল। সব না হলেও কিছু কিছুর বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিলেন আশ্রম-বিদ্যালয়ে। হেনরি মর্লির কথা ভুলতে পারেননি তিনি। সুখস্মৃতি মনের কোণায় চিরজীবী হয়েছিল। অনেক পরে রানি চন্দকে বলেছিলেন সেই আনন্দময় অভিজ্ঞতার কথা। হেনরি-সান্নিধ্য কবির কাছে ছিল বড়ো প্রাপ্তি। রানী চন্দকে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘হেনরি মর্লির মতো শিক্ষক পাওয়া আমার জীবনের বড়ো একটা সৌভাগ্য।’
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫২: রামচন্দ্রের বনবাসগমনের সিদ্ধান্তে নৈতিকতার জয়? নাকি পিতার প্রতি আনুগত্যের জয় ঘোষণা?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৫: মা সারদার ভ্রাতৃবিয়োগ

হেনরির পড়ানোর ধরনের মধ্যে নতুনত্ব ছিল। পড়ানোর বিষয়টি তিনি এমনভাবে আবৃত্তি করে বলে যেতেন যে, বুঝতে একটুও অসুবিধা হত না। কতখানি বোঝা গিয়েছে, তাও তিনি জরিপ করে দেখতেন। তাঁর নির্দেশ মতো ক্লাসের ছেলেরা যা পড়ানো হয়েছে, তা প্রবন্ধের মতো করে লিখে, নিজের নাম না জানিয়ে চুপিচুপি রেখে আসত হেনরির ডেস্কের ভেতরে। পরে সেই সব লেখা নিয়ে তিনি আলোচনা করতেন। ছাত্র-দরদী এই সাহেব-শিক্ষক সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘তিনি কখনও কারও লেখার সমালোচনা করতে গিয়ে কাউকে আঘাত করতেন না, কারণ তাঁর মনে করুণা ছিল।’ হেনরির পাঠদান, তাঁর মাধুর্যময় কথাবার্তা, ছাত্রদের সঙ্গে আন্তরিক মেলামেশা—এসব রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল, শুধু মুগ্ধতা নয়, এই সাহেব-শিক্ষকের প্রভাব রবীন্দ্র-মনে রয়ে গিয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ : যখন শিক্ষক।

রবীন্দ্রনাথ সাহেব-শিক্ষকদের কাছে পড়েছেন। তাঁদের ভালোটুকু গ্রহণ করেছেন। কখনো কখনো নির্ভরও করেছেন। কন্যা মাধবীলতার জন্য সাহেব-শিক্ষক রেখেছিলেন, মেম-শিক্ষিকা রেখেছিলেন। মূলত তাঁরা ইংরেজি পড়াতেন। মাধবীলতাকে বিভিন্ন সময় পড়াতে আসতেন তিন মেম-শিক্ষক মিস পার্সনস, মিস এলজিত ও মিস লিনটন। পড়াতেন সাহেব-শিক্ষক লরেন্স। লরেন্স ছিলেন এক আপনভোলা খেয়ালি মানুষ। পত্নী ‘ভবতারিণী’ সহসা ‘মৃণালিনী’ হয়ে ওঠেননি। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে তিলে তিলে তৈরি করেছিলেন। লোরেটো স্কুলে বছরখানেক ইংরেজি পড়েছিলেন মৃণালিনী। হ্যাঁ, মেম-শিক্ষিকারাই পড়াতেন।

রবীন্দ্রনাথ নিজে শিক্ষক হিসেবে কেমন ছিলেন, তা ধরা আছে বহু স্মৃতিচারণে। তিনি পুত্রবধূ প্রতিমাকে ইংরেজি পড়াতেন। কবির কাছে পাঠ নেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা প্রতিমা এ ভাবে ব্যক্ত করেছেন, ‘আমার ইংরেজি ক্লাস একদিনও বাদ যেত না। এই দিনব্যাপী ব্যস্ততার মধ্যেও নিভৃত একটু সময় আমাকে পড়ানোর জন্য দিতেন। তিনি আজন্ম শিক্ষক ছিলেন। তাঁর কাছে পড়ার সুযোগ যার না হয়েছে, সে বুঝতে পারবে না, কত সহজে অতি কঠিন বিষয়ও হৃদয়ঙ্গম হতে পারে।’

ছবি: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content