বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


মা সারদা।

স্বামী যোগানন্দ মায়ের প্রথম দীক্ষিত সন্তান এবং তিনিই মা সারদার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। সবসময় তিনি শ্রীমায়ের প্রতিটি প্রয়োজন লক্ষ রাখতেন। তাঁর মৃত্যুতে মা সারদা খুব শোকাতুরা হয়ে পড়েন। তাঁর সম্বন্ধে শ্রীমা বলেছিলেন, ‘ছেলে যোগেন তো হাসতে হাসতে ঠাকুরের কাছে চলে গেল। যোগীনের মতো আমাকে কেউ ভালোবাসত না। আমার যোগীনকে কেউ যদি আট আনা পয়সা দিত, সে বলত, ‘মা তীর্থে টীর্থে যাবেন, তখন খরচ করবেন’। যোগীন দু’ আনা, চার আনা, আট আনা করে ছশ’ টাকা আমার জন্যে জমিয়েছিল। সর্বক্ষণ আমার কাছে বসে থাকবে, আমাকে বলত, ‘মা, তুমি আমাকে যোগা যোগা বলে ডাকবে’।
গিরিশবাবু যোগীনকে বলেন যে, তিনি যেন নির্বাণ না চান, ঠাকুর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে, চন্দ্রসূর্য তাঁর চক্ষু-অত বড় যেন না ভাবেন, যেমন ঠাকুরটি ছিলেন তেমনটি ভেবে ভেবে তাঁর কাছে চলে যান। যোগীন মহারাজ দেহ রাখার সময় বললেন, ‘মা, আমায় নিতে আসেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবঠাকুর’। শ্রীমাকে যোগীন মহারাজ একখানা লেপ দিয়েছিলেন। অনেক কাল পর তা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেলে মা তার তুলো পিঁজিয়ে নিয়ে একটা নতুন খোল বানিয়ে লেপটির সংস্কার করার জন্য বিভূতিবাবুকে বলেছিলেন। কিন্তু সংস্কার হলে তাঁর যোগীনের দেওয়া লেপ আর তেমনটি থাকবে না, এটা ভাবতেই শ্রীমার প্রাণে যেন একটা ধাক্কা লাগল। তিনি লেপটির সংস্কারের বাসনা ত্যাগ করলেন। আবার যখন বিভূতিবাবুর সঙ্গে দেখা হয়, তখন বললেন, ‘না বিভূতি, লেপটা নিয়ে যেয়ে কাজ নেই, এই লেপ যোগীন দিয়েছিল, দেখলেই যোগীনকে মনে পড়ে’।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৪: মা সারদার সন্তানসম শিষ্যের দেহরক্ষা

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৭: সুন্দরবনের নদীবাঁধের ভবিতব্য

অন্তরের ভক্তি-ভালবাসা দিয়ে কেউ কোন জিনিস দিলে শ্রীমা সাধ্যমত তা রক্ষা করতেন আর আজীবন ব্যবহার করে ভক্তবৎসলা নামের ছাপ রেখেছেন। মহাযুদ্ধ থেকে ফিরে ফণিভূষণ অর্থাৎ ভবেশানন্দ তাঁকে দেবার জন্য একটা তুর্কী মোহর কোন ভক্তের হাত দিয়ে পাঠান। মা সারদা সেটি গ্রহণ করে বলেন যে, মোহরের আর কি দাম, স্মৃতিরই দাম। তাই শ্রীমার ইহলোক ত্যাগের পর দেখা গেল যে, সে যেভাবে কাগজে মুড়ে মোহরটি মাকে দিয়েছিল, সেটি সেভাবেই তাঁর বাক্সে রয়েছে। ভগিনী নিবেদিতা শ্রীমাকে একটা জার্মান সিলভারের কৌটো দান করেন। তাতে মা ঠাকুরের কেশ রেখে বলতেন যে, যখন পুজো করেন, তখন কৌটোটা দেখলেই তাঁর নিবেদিতাকে মনে পড়ে।

নিবেদিতা সারদা মাকে বলতেন, ‘মা আমরা আর জন্মে হিঁদু ছিলুম, ঠাকুরের কথা ওদেশে প্রচার হবে বলেই আমরা ওদেশে জন্মেছি’। একবার শ্রীমা কলকাতা থেকে দেশে গেলে তাঁর একখানা ভাল বালাপোষ খুঁজে পাওয়া গেল না। রাখার দোষে হারিয়েছে মনে করে যিনি জিনিসপত্রের দেখাশোনা করেছিলেন, তার মন খারাপ হয়ে যায়, মার মনেও দুঃখ হয়। কিন্তু খুঁজতে খুঁজতে সেটা যখন অন্য জিনিসের সঙ্গে পাওয়া গেল তখন শ্রীমা আনন্দিত হয়ে বললেন, ‘বালাপোষের জন্যে কি, বাবুরামের মা এই বালাপোষটি দিয়েছিল, সেইজন্যে’।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫১: কচ, দেবযানী ও মহান শুক্রাচার্য— প্রেম, প্রতিহিংসা, উদারতায় অনন্য তিন দৃষ্টান্ত?

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪০: ব্রণ হয়েছে? তার মানেই কি লিভার খারাপ?

দুর্গাপুজো উপলক্ষে শ্রীমা মঠে এসেছেন। ঠাকুরঘরের সামনের দেয়ালে টাঙানো ছিল যোগীন মহারাজের একটি তৈলচিত্র। মা কাছে গিয়ে সেই চিত্রটি অনেকক্ষণ ধরে দেখতে লাগলেন। তিনি ঠাকুরঘরে গিয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করেই চলে এলেন। ব্রহ্মচারি অক্ষয়চৈতন্য মন্তব্য করেছেন যে, কোন বেদনা সেদিন জননীর প্রাণে বেজেছিল, কে বলতে পারে! শ্রীমা নিজের মুখে বলেছেন যে, যোগানন্দ ঈশ্বরকোটি মহাপুরুষ ছিলেন। তিনি জন্মান্তরে কৃষ্ণসখা গাণ্ডীবী অর্জুন ছিলেন। ধর্মরাজ্য সংস্থাপনে শ্রীভগবানের লীলার সঙ্গী ছিলেন। তাঁর দেহরক্ষার কিছুকাল পর স্বামী সারদানন্দ শ্রীমার সেবাধিকার লাভ করেন এবং প্রায় একুশবছর ধরে তা গৌরবের সঙ্গে সুসম্পন্ন করেন। তাই তো মা সারদা বলতেন, ‘শরৎ আর যোগীন-এ দুটি আমার অন্তরঙ্গ’।

যোগানন্দ যখন দেহ রাখেন, সারদানন্দ তখন প্রচারকার্যে গুজরাটে ছিলেন। সেই জন্য তাঁর সহকারি কৃষ্ণলাল মহারাজ ও বুড়োবাবা এবং স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ শ্রীমার দেশে যাওয়া পর্যন্ত কয়েক মাস তাঁর সেবার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। বর্ধমানের পথে শ্রীমাকে দেশে নিয়ে যাওয়া, সেখান থেকে আবার কলকাতায় নিয়ে আসার কঠিন কাজটি ত্রিগুণাতীত মহারাজই অধিকাংশ সময় করতেন। আর শ্রীমাকে এতটুকু স্বাচ্ছন্দ্য দেবার জন্য সদা সচেষ্ট থাকতেন।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩২: কলি কলিং

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮১: কবির ‘গানের ভাণ্ডারী’ দিনেন্দ্রনাথ বৈষয়িক-কারণে শান্তিনিকেতন ত্যাগ করেছিলেন

একবার যখন মাকে তিনি গরুর গাড়ি করে বর্ধমান থেকে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন দূর থেকে রাস্তার মাঝে একটা গর্ত দেখতে পেয়েই তিনি দৌড়ে এসে তার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন। ভেবেছিলেন তার শক্তসবল দেহের ওপর দিয়ে গাড়ি অনায়াসে চলে যাবে। আর চাকা গর্তে পড়ে শ্রীমার শরীরে আঘাত লাগবে না। তখন শেষ রাত হলেও মা সবই দেখেছিলেন। তিনি গাড়োয়ানকে তখনই থামতে আদেশ দেন। আর অমন করার জন্য ত্রিগুণাতীতানন্দকে ভর্ৎসনা করে গাড়ি থেকে নেমে ঠেঁটে ওই গর্ত পার হয়ে আসেন। ১৩০৬ সালের ১৮ শ্রাবণ শ্রীমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা অভয়চরণ কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াণ করেন। সবথেকে ছোটভাইয়ের মৃত্যুতে তিনি খুবই আঘাত পেয়েছিলেন।

মায়ের বড়ভাই প্রসন্নকুমার একদিন শ্রীমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘দিদি, একপেটে জন্মেচি, আমাদের কি হবে’?উত্তরে শ্রীমা বলেন, ‘তা তো বটেই, তোদের ভয় কি’? অভয়ের মৃত্যুশযায় পালকি করে সারদা মা যখন চোরবাগান সরকার লেনে তার শয্যাপাশে এসে উপস্থিত হন ও শিয়রে বসে আদরে পালিত ছোট ভাইয়ের মাথা নিজ কোলে নিয়ে বসেন, তখন অভয় মাতৃতুল্য দিদির চোখে চোখ রেখে বলেন, ‘এরা সব রইল, এদের তুমি দেখ’। অভয়ের অসুখের সময়ে শরৎ মহারাজ ও সুশীল মহারাজ তাঁর খুব সেবা করেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৩: ইন্দিরা দেবী—ঠাকুরবাড়ির আলো!

চলো যাই ঘুরে আসি, মধ্যপ্রদেশ বা ছত্তিশগড় নয়, আমাদের এই বাংলাতেই রয়েছেন ডোকরা শিল্পীরা

অভয় ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুলে পরীক্ষা দিয়ে অল্পদিনের মধ্যে বেরিয়ে এসেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরই শ্রীমা দেশে চলে যান। ডাক্তারি পড়া আদরের ছোটভাইয়ের মৃত্যুতে মা এতটাই কষ্ট পেয়েছিলেন যে, পরবর্তি কালে তিনি তাঁর ভাইপোদের বিষয়ে বলতেন যে, তারা সব মুখ্যু সুখ্যু হয়ে বেঁচে থাক। এই কথায় আপত্তি করে যদি কোন ভাইয়ের বউ বলতেন যে, ওই রকম আশীর্বাদ করে নাকি? তার উত্তরে মা বলতেন, ‘হ্যাঁগো, হ্যাঁ, তোরা কি জানিস? আমি অভয়কে মানুষ কল্লুম, অভয় চলে গেল’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content