শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

যথা সময়ে টিট্টিভি সমুদ্রবেলায় বেশ কতগুলি ডিম পাড়ল। এরপর সারাদিনের খাবার-দাবারের খোঁজে সে যখন আশে পাশে উড়ে গেল, তখন সুযোগ বুঝে সমুদ্র তার ঢেউ দিয়ে সেই ডিমগুলোকে লুকিয়ে ফেলল। সায়াহ্নকালে সমুদ্রের বেলা ভূমিতে সেই প্রসব স্থানে ফিরে এসে ডিমগুলোকে দেখতে না পেয়ে টিট্টিভি কান্নাকাটি শুরু করল। মা যদি তার সন্তানদের খুঁজে না পায় তার যন্ত্রণা যে কেমন হতে পারে সে নিশ্চয়ই আর ব্যাখ্যা করে বোঝানোর দরকার নেই। সন্তানহারা টিট্টিভি বিলাপ করতে করতে ক্রুদ্ধ হয়ে টিট্টিভকে বললে, “ভো মূর্খ! কথিতমাসীন্মযা তে যৎ সমুদ্রবেলযাণ্ডানাং বিনাশো ভবিষ্যতি”। আমি বলেছিলাম যে, সমুদ্রের বেলাভূমিতে ডিম নষ্ট হয়ে যাবে। এ বার দূরে কোথাও চলো। শুধু তোমার মূর্খতা আর একগুঁয়েমির জন্যই তুমি আমার কথাগুলো শুনলে না। লোকে ঠিকই বলে—

সুহৃদাং হিতকামানাং ন করোতীহ যো বচঃ।
স কূর্ম ইব দুর্বুদ্ধিঃ কাষ্ঠাদ্ ভ্রষ্টো বিনশ্যতি॥ (মিত্রভেদ ৩৪৪)

অর্থাৎ এ জগতে যে লোকেরা নিজের হিতৈষী বন্ধুদের কথা শোনে না তাদের সেই দুর্বুদ্ধি কচ্ছপটার মতো অবস্থা হয় যে মুখের কাঠটা ছেড়ে দেওয়ায় পড়ে মরে গিয়েছিল।
টিট্টিভ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কথমেতৎ”, ব্যাপারটা ঠিক কেমন? কী করে এমন হল?
টিট্টিভি তখন বলতে শুরু করল—
 

১৩: দুই হাঁস আর এক কচ্ছপের কাহিনি

কোনও এক নাম না জানা প্রদেশে বিশাল এক জলাশয় ছিল। সেখানে কম্বুগীব বলে এক কচ্ছপ বাস করতো। তার সংকট আর বিকট নামে দুই হাঁসের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব ছিল। সেই কম্বুগ্রীব প্রতিদিন সকাল বেলায় তাদের দু’ জনের সঙ্গে সরোবরের প্রান্তে ডাঙ্গায় উঠে রোদ পোয়াতো আর সেখানে আশা মুনি-ঋষিদের মুখে ধর্ম কথা শুনে আর বন্ধুদের সঙ্গে গল্প-গুজব করে ভালোই সময় কাটাতো। সূর্যাস্ত হলেই তারা নিজ নিজ বাসায় ফিরে আসতো। দিন কাটছিল এই ভাবেই। একবার সময়ে ঠিক-ঠাক বৃষ্টি না হওয়ায় সেই সরোবরের জল সূর্যের প্রখর তাপে শুকিয়ে যেতে শুরু করল। তখন সেই হাঁদ দুটি গভীর দুঃখের সঙ্গে কম্বুগ্রীবকে বললে, ওহে মিত্র! এই বিরাট জলাশয়ে তো কাদাজল ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখন আপনাদের দু’জনের কী হবে? জলের প্রাণী বলতে তো আর কিছুই পড়ে নেই, আপনার এখন কি হবে সেইসব ভেবেই আমরা ব্যাকুল হচ্ছি। খাবার-দাবারের সংস্থান তো কিছু একটা তো থাকতে হবে।
কম্বুগ্রীব বললে, বন্ধু! আপনারা সঠিকই অনুমান করেছেন, এই জলাভাবে সত্যিই আমি হয়তো বেঁচে থাকবো না। কিন্তু মুনি-ঋষিরা কি বলেন মনে আছে—

ত্যাজ্যং ন ধৈর্যং বিধূরেঽপি কালে
ধৈর্যাৎ কদাচিদ্গতিমাপ্নুযাৎ সঃ।
যথা সমুদ্রেঽপি চ পোতভঙ্গে
সাংযাত্রিকো বাঞ্ছতি তর্তুমেব॥ (ঐ, ৩৪৫)
সময় প্রতিকূল হলেও ধৈর্য ত্যাগ করা উচিত নয়। কারণ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলে কখনো কখনও বিপদ-মুক্তির পথ বেরিয়েও আসে। সমুদ্রের মাঝে জাহাজ ভেঙ্গে গেলেও অভিযাত্রীরা কেউই কিন্তু সমুদ্র পার করবার আশা পরিত্যাগ করেন না। মনু মহারাজও বলেন যে বিপদ উপস্থিত হলে বুদ্ধিমান লোকেদের উচিত তার আত্মীয়-বন্ধুরা যাতে সে বিপদ থেকে উদ্ধার পান তার জন্য কিছু একটা উদ্যোগ নেওয়া। তাই আমার পরামর্শ এদিক ওদিক থেকে খুঁজে একটা শক্ত মোটা দড়ি বা একটা কাঠের টুকরো নিয়ে এসো আর সেইসঙ্গে আশেপাশে কোথায় জলযুক্ত বিশাল সরোবর আছে তারও খোঁজ করো। আমি সেই কাঠের খণ্ডটির বা দড়িটির মাঝখানে দাঁতে করে চেপে ধরবো আর তোমরা দু’জন সেটার প্রান্তভাগ দুটো ঠোঁটে করে ধরে আকাশ পথে উড়ে আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে। হাঁস দুটি তখন বলল, ওহে মিত্র! আমরা ঠিক এইটাই করবো। কিন্তু আপনাকে একেবারে চুপ করে থাকতে হবে— “মৌনব্রতেন স্থাতব্যম্”। কথা বললেই মুখ থেকে সেই দড়ি বা কাঠের টুকরোটি ছেড়ে গেলেই আপনি কিন্তু পড়ে যাবেন আর তাতে মৃত্যু অবসম্ভাবনা প্রবল।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৭: যুদ্ধ করার থেকে তা এড়িয়ে যাওয়াটাও রণনীতিরই বড় অঙ্গ

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৭: সুন্দরবনের নদীবাঁধের ভবিতব্য

সেই রকম ব্যবস্থা বন্দোবস্ত করে একটা কাষ্ঠ খণ্ড দুপ্রান্তে ধরে সংকট আর বিকট দু’জনে আকাশে উড়লো আর কম্বুগ্রীব শক্ত করে তার মধ্যভাগ দাঁতে করে চেপে রাখল। আকাশ পথে যেতে যেতে সেই কচ্ছপ কম্বুগ্রীব নীচে পৃথিবী পৃষ্ঠে এক নগর দেখতে পেলো, যেখানে নাগরিকেরা আকাশ পথে তাদেরকে এইভাবে উড়ে যেতে দেখে আশ্চর্য হয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে শুরু করল, দেখো দেখো গোল চাকার মতো কী একটা জিনিষ পাখীরা নিয়ে উড়ে যাচ্ছে।
নীচে গোলমাল শুনে কম্বুগ্রীব স্বভাবস্বরূপ ভঙ্গীতে বলতে গেল, “ভোঃ কিমেষ কোলাহলঃ”—ওহে! এতো সব কোলাহল কিসের?
সে বাক্য আর পূর্ণ হল না। মুখ থেকে সেই কাষ্ঠখণ্ডটি ছেড়ে যাওয়ায় উপর থেকে সে কচ্ছপটি নীচে পড়তেই নাগরিকরা তাকে খাবার জন্য টুকরো টুকরো করে ফেলল।
 

১৩তম কাহিনি সমাপ্ত।

আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫১: কচ, দেবযানী ও মহান শুক্রাচার্য— প্রেম, প্রতিহিংসা, উদারতায় অনন্য তিন দৃষ্টান্ত?

এই প্রসঙ্গেই আমার পাঠক-পাঠিকাদের কিছু অতিরিক্ত তথ্য দিতে ইচ্ছে করছে। এই কচ্ছপ আর দুই হাঁসের যে গল্পটি এখানে টিট্টিভির মুখে আপনারা শুনলেন সেটি কিন্তু বেশ প্রাচীন। মানে আমি বলতে চাইছি এই পঞ্চতন্ত্রেরও বহু পূর্বে রচিত জাতকের কাহিনীতেও আপনি এই গল্পটি পাবেন। সেখানে গল্পটি আকারে আরও কিছু বড়। জাতক সঙ্কলনের ২১৫ সংখ্যক কাহিনি হল এই ‘কচ্ছপ জাতক’ এর কাহিনী। সেখানে বলা হয়েছে, হিমালয় প্রদেশে বসবাসকারী সেই কচ্ছপটিকে নিয়ে হাঁস দুটি তখন উড়ে চলেছিল তাদের নিবাস চিত্রকূটপর্বতের কাঞ্চনগুহার। পথে বারাণসী নগরীর উপকণ্ঠ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময়েই এই দুর্ঘটনাটি ঘটে। বারাণসীর রাজভবনের উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে সেই কচ্ছপটি পড়ে যখন খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেলো তখন তত্কালীন কাশী নরেশ ব্রহ্মদত্ত সে সময়ে কচ্ছপটিকে দেখে খুব আশ্চর্য হলেন। বোধিসত্ত্ব সে সময়ে কাশীতে এক অমাত্যকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বয়ঃপ্রাপ্তির পর রাজার ধর্মার্থানুশাসকের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। রাজা সেই কচ্ছপটিকে দেখে বোধিসত্ত্বকে জিজ্ঞাসা করলেন, পণ্ডিতবর! এ কচ্ছপটি এখানে পড়ল কী করে?
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮১: কবির ‘গানের ভাণ্ডারী’ দিনেন্দ্রনাথ বৈষয়িক-কারণে শান্তিনিকেতন ত্যাগ করেছিলেন

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৪: মা সারদার সন্তানসম শিষ্যের দেহরক্ষা

সেই রাজা ছিলেন বাচালতা দোষে দুষ্ট; তিনি কোন কথা বলতে আরম্ভ করলে অন্য কেউ কিছু বলবার অবসর পেতেন না। একজন রাজার পক্ষে এ দোষ ভয়ানক। কারণ রাজাকে সকল অমাত্যদের পরামর্শ নিয়েই রাজ্য শাসন করতে হয় আর অমাত্যরা যদি কথা বলবারই সুযোগ না পান তাহলে তো স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না। বোধিসত্ত্ব ভাবলেন এইটাই উপযুক্ত সময়। রাজার বাচালতা দূর করার জন্য এই অবসরেই কিছু উপদেশ দেওয়া পারে। তিনি বললেন, এই কচ্ছপের সঙ্গে হাঁসেদের যে বন্ধুত্ব হয়েছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তারা একে তাদের সঙ্গে হয়তো হিমবন্ত প্রদেশে নিয়ে যাবে সেই জন্যই দণ্ডটি কামড়ে ধরতে বলেছিল এবং সেই অবস্থাতেই একে নিয়ে আকাশে উড়ে ছিল। তারপর কিছু বলবার ইচ্ছায় এই কচ্ছপটি নিশ্চয়ই তার মুখ আর সামলাতে পারেনি; কথা বলতে গিয়েই দণ্ড থেকে মুখ ছেড়ে গিয়ে আকাশ থেকে পড়ে মৃত্যু ঘটেছে।

কিছু সময় চিন্তা করে বোধিসত্ত্ব বললেন, মহারাজ! যাঁরা অতি মুখর এবং নিজের জিহ্বাকে সংযত রাখতে পারে না তাদের এইরকম কচ্ছপের মতনই দুর্দশা হয়ে থাকে।

রাজা বুঝলেন যে, বোধিসত্ত্ব তাঁকে উদ্দেশ্য করেই শেষের কথাগুলো বললেন। তিনি বোধিসত্ত্বকে জিজ্ঞাসা করলেন, পণ্ডিতবর! আপনি কি আমাকেই লক্ষ্য করে বললেন?

বোধিসত্ত্ব উত্তর দিলেন, “মহারাজ! আপনিই হন বা অন্য যে কেউ—অপরিমিতভাষীদের এইরকম দুর্গতিই ঘটে।

জাতকের কাহিনি অনুযায়ী বোধিসত্ত্ব এ ভাবে সমস্ত কথা খুলে বলায় রাজা নাকি মিতভাষী হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১২: সুখলতা রাও— ছোটদের পরী

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৮: কে আবার বাজায় বাঁশি

বৌদ্ধ জাতকের এই কাহিনিটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে পঞ্চতন্ত্রকার সযন্তে এই কাহিনিটিকে নিজের গ্রন্থে ঠাঁই দিয়েছিলেন এবং সেই পঞ্চতন্ত্র গ্রন্থ অনুবাদের মাধ্যমে যখন বিশ্বভ্রমণ করতে শুরু করে তখন এই গল্প ফার্সী, সিরিয়াক, আরব, গ্রিক, হিব্রু ও ল্যাটিন ভাষা-ভাষী জনসমাজের মাঝে ছড়িয়ে যায়। মোঙ্গলিয়ার লোককাহিনিতেও এই গল্প পাওয়া যায়; রাশিয়াতেও কাহিনি আছে তবে সেক্ষেত্রে কচ্ছপের বদলে ব্যাঙের যাত্রার কথা বলা হয়েছে। এমনকি পঞ্চতন্ত্র পরবর্তী নারায়ণ শর্মার রচিত হিতোপদেশ গ্রন্থটিতেও এই কাহিনিটি সযত্নে রক্ষিত আছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা জানাচ্ছেন যে প্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত দ্বিতীয় মন্দির গাত্রের উত্তরমুখে এই কাহিনীটি খোদাই করা আছে। ভাস্কর্যটি আনুমানিক সপ্তম শতাব্দীর।

নালন্দা থেকে প্রাপ্ত খ্রিস্টিয় ৭ম শতাব্দীর ভাস্কর্য।

উল্লেখ্য, নবম শতাব্দীতে তৈরি জাভার মেনদুট (Mendut) গ্রামের নির্মিত বৌদ্ধমন্দিরের সিঁড়িতেও এই গল্পের ভাস্কর্যটির দেখা মেলে। যাইহোক আমরা আবার মূল গল্পে ফিরে আসি।

টিট্টিভকে সবটা কাহিনি শুনিয়ে টিট্টিভী বললে, সেই জন্যই আমি বলেছিলাম, এ জগতে যে লোকেরা নিজের হিতৈষী বন্ধুদের কথা শোনে না তাদের সেই দুর্বুদ্ধি কচ্ছপটার মতন অবস্থা হয়। শুধু কি তাই? —
অনাগতবিধাতা চ প্রত্যুত্পন্নমতিস্তথা।
দ্বাবেতৌ সুখমেধতে যদ্ভবিষ্যো বিনশ্যতি॥ (ঐ, ৩৪৭)


অনাগতবিধাতা আর প্রত্যুত্পন্নমতি — এ দুজনেই সুখে থাকে, শুধু যদ্ভবিষ্যই বিনষ্ট হয়ে যায়।
টিট্টিভ বলল— “কথমেতৎ”। ব্যাপারটা ঠিক কি রকম?
টিট্টিভী তখন আবার বলতে শুরু করে।— চলবে
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content