দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, তারাসুন্দরী ও অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি।
মিনার্ভা থিয়েটারে ‘বলিদান’ নাটকটি প্রথম অভিনীত হয় ১৯০৫ সালের ৮ এপ্রিল। এই নাটক দেখে প্রখ্যাত নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বলেছিলেন, “যদি বলিদানের ন্যায় সামাজিক নাটক লিখিতে পারি, তবেই সামাজিক গ্রন্থ লিখিব”।
প্রথম অভিনয় রজনীতে মিনার্ভা থিয়েটারে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ (করুণাময়), অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি (রূপচাঁদ), সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ (দুলাল চাঁদ), তারাসুন্দরী (সরস্বতী), সরোজিনী (যশোমতী), নগেন্দ্র বালা (রাজলক্ষ্মী) সুশীল বালা (জোবি), চপলা সুন্দরী (করুণাময়ের ঝি)। নাটক প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ এবং তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি। মেকাপের দায়িত্বে ছিলেন শ্যামাচরণ কুণ্ডু। এই নাটকের গানগুলি লেখা এবং সুর রচনা করেছিলেন বৈকুণ্ঠনাথ বসু।
আরও পড়ুন:
নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৫২: গিরিশচন্দ্রের পৌরাণিক নাটক ‘হরগৌরী’ অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী
বলিদান বাংলার গৃহ চিত্র। কন্যাদয়গ্রস্ত গৃহস্তের উৎপীড়ন এবং লাঞ্ছনা সমাজের নিত্য ঘটনা। পুরাতন ক্ষত যেমন শলাকাঘাতে বেদনাবোধ বা রক্তমোক্ষন করে না, বাংলার এই সামাজিক খত তেমনি অসার হয়ে উঠেছে। কিন্তু গিরিশচন্দ্রের মায়া দন্ড স্পর্শে সেই পুরাতন খতে আবার অভিনব চেতনার সঞ্চার হয়েছে। হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি সারদাচরণ মিত্রর মশাইয়ের অনুরোধে গিরিশচন্দ্র এই নাটকটি লিখেছিলেন এবং তাঁকেই গিরিশচন্দ্র নাটকটি উৎসর্গ করেছিলেন। এখানে ভূমিকায় গিরিশচন্দ্র লিখছেন, “মহোদয়, এই নাটকখানি মহাশয়ের আদেশে রচিত। পরীক্ষার্থে সবিনয়ে মহাশয়কে অর্পণ করিলাম। কঠিন পরীক্ষা।”
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫১: কচ, দেবযানী ও মহান শুক্রাচার্য— প্রেম, প্রতিহিংসা, উদারতায় অনন্য তিন দৃষ্টান্ত?
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৪: মা সারদার সন্তানসম শিষ্যের দেহরক্ষা
খ্যাততনামা অভিনেতা অভিনেত্রীরা এই নাটকে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, সকলেই যেন পরস্পর প্রতিযোগিতা করে এই সমাজ চিত্রকে দর্শকের চোখের সামনে সজীব করে তুলতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন। এই সর্বজন সমাদৃত নাটকের নায়ক করুণাময় থেকে শুরু করে সামান্য ঝি পর্যন্ত সব চরিত্রই জীবন্ত এবং নাট্যকারের সৃষ্টি নৈপুণ্যের পরিচায়ক। করুণাময়ের ভূমিকাতে গিরিশচন্দ্র অসামান্য অভিনয় প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর গৃহিণী সরস্বতীর সঙ্গে কন্যার বিবাহের কথাবার্তা বলতে বলতে কাগজে বিয়ের দ্রবাদির ফর্দ করতে করতে যে অভিনয় তিনি প্রদর্শন করেছিলেন তার তুলনা নেই। এই অভিনয় যাঁরা দেখেছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করেছিলেন।
আরও পড়ুন:
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস: তোমার ভাষা বোঝার আশা
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস: ঠাকুরবাড়ির বাঙালিয়ানা
আমরা দেখতে পাই সেই সময় কি ইংরেজি কি বাংলা সকল পত্রিকাতেই “বলিদান” নাটকের ভূয়সী প্রশংসা বেরিয়েছিল। ইন্ডিয়ান নেশন পত্রিকা লিখছে, “Babu Girishchandra ঘোষ the talented author of the play, plays the part of Karunamoy to perfection. Most of the actors and actresses are up to the mark.” ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকায় উল্লেখ করেছে, “বঙ্গের রঙ্গমঞ্চে বাঙালির ঘরের ছবি যে এতটা পরিস্ফুটে হইবে, দর্শকের হৃদয়ে যে এতটা উদ্বেলিত হইবে, বলিদান অভিনয় দেখিবার পূর্বে আমরা তাহা স্বপ্নেও ভাবি নাই।”—চলবে।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh–Actor –Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।