রবিবার ১৭ নভেম্বর, ২০২৪


তৈত্তিরীয় উপনিষদে রয়েছে—”সত্যং বদ ধর্মং চর”। সত্য পালন ও ধর্মাচরণ জীবন ব্রত। কথাটির গূঢ় অর্থও রয়েছে; সর্ব সর্বদা সত্যনিষ্ঠা, সৎ আচরণ, তাই ধর্ম অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে সত্যতে প্রতিষ্ঠিত থাকা। তাই-ই ধর্ম। সত্যের মধ্যেই অমৃত স্বরূপ, সতঃপ্রকাশরূপ আত্মা নিহিত আছে। সত্যে যিনি প্রতিষ্ঠিত আছেন তিনি ভগবানকে ধরে আছেন। সত্য স্বরূপ ভগবান তিনি তার অন্যথা হতে দেন না। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, “সত্যই কলির তপস্যা।” শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীশ্রী ভবতারিণীকে ধর্ম-আধর্ম, পাপ-পূণ্য, ভালো-মন্দ, যশ-অযশ, ইত্যাদি সবকিছু প্রদান করেছিলেন, কিন্তু তিনি এটা বলেননি, “মা, এই নে তোর সত্য, আর এই নে তোর মিথ্যা।”

পরবর্তীকালে দেখা যায় তিনি এতটাই সত্যে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন যে, তিনি ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত কোনও মিথ্যা আচরণ করতে পারেননি। শ্রীশ্রীজগদম্বা যেন সন্তানের হাত ধরে সঠিক পথেই মাত্র পরিচালিত করেছেন। সনাতন আদর্শে যাঁরা দৃষ্টান্ত স্বরূপ হয়ে রয়েছেন রাজা হরিশচন্দ্র, শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্য বা শ্রীরামকৃষ্ণ এবং অন্যান্য ভারতের সনাতন আদর্শে ও তার ধর্মের পথপ্রদর্শনকারী মুনি, ঋষি, দৃষ্টান্ত স্রষ্টা সাধক সাধিকা, ভারতের প্রাণপুরুষ স্বরূপ, তারা প্রত্যেকেই ধর্ম থেকে কখনো বিচ্যুত হন না। শ্রীরামকৃষ্ণও ধর্ম পালনে কখনও বিচ্যুত হননি। তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত আমরা এখানে দিতে পারি।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, “যার সত্যনিষ্ঠা আছে, সে ভগবানকে পায়। যার সত্যনিষ্ঠা আছে মা তার কথা কখনও মিথ্যা হতে দেয় না।” প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। তিনি এই অবতারত্বে, সত্য কী করে পালন করা যায় তা দেখিয়েছেন তাঁর আচরণে। তাঁর শ্রীমুখ দিয়ে যা প্রকাশ হত তা সত্য সত্যই কোনও না কোনও ভাবে ফলপ্রসূ হত। বাস্তব ক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনে প্রায় সর্বদাই সত্যনিষ্ঠাতে অচল থাকার যে দৃষ্টান্ত দেখা যায় তার কয়েকটি উদাহরণ আমরা এখানে উল্লেখ করি। শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তি মতি গোপালের মা, যিনি ঠাকুর কে গোপাল রূপে দেখতেন। তিনি একদিন ঠাকুরকে ভাত রেঁধে খাওয়ালেন। সব প্রস্তুত। ঠাকুর খেতে বসলেন। বসে দেখেন, ভাত শক্ত আছে। সুসিদ্ধ হয়নি। “এ ভাত কি আমি খেতে পারি? আর ওর হাতে আর কখনো খাব না”

ঠাকুরের এ কথায় সকলে ভাবলেন ঠাকুর গোপালের মাকে ভয় দেখালেন মাত্র। যে গোপালের মাকে সর্বদা আদর যত্ন করতেন, তার হাতে খাবেন না তা হতে পারে না। কিন্তু অল্পকাল পরেই ঠাকুরের গলায় অসুখ ক্রমে বাড়ে, ঠাকুরের ভাত খাওয়া বন্ধ হল। গোপালের মায়ের হাতে আর কোনওদিন ভাত খাওয়া হয়নি।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৫১: সামাজিক জীবনশৈলী কেমন হওয়া উচিত শ্রীরামকৃষ্ণ ও সারদা মায়ের মতো আর কেউ ভাবেননি

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩১: সুন্দরবনের ঐতিহ্য গঙ্গাসাগরমেলা ও কপিল মুনির আশ্রম

একদিন দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হয়ে বলছেন, এরপরে আর কিছু খাব না, কেবল পায়েসান্ন। শ্রীশ্রীমা ওই সময়ে ঠাকুরের খাবার নিয়ে আসছিলেন, ওই কথা শুনে তিনি ভীত হলেন। ঠাকুরের শ্রীমুখ দিয়ে যে কথা বের হয় তা নিরর্থক হয় না, ভয় পেয়ে মা বলেন, আমি মাছের ঝোল ভাত রেঁধে দেব, খাবে। পায়েস কেন? ঠাকুর ভাবাবস্থায় বললেন একই কথা। শ্রীরামকৃষ্ণ অসুখ ক্রমাগত বাড়তে লাগল। বাস্তবিক আর তিনি কোনওদিন ব্যঞ্জনাদি খেলেন না। দুধ ভাত, সাগু, দুধ, বার্লি খেয়ে কাটালেন। দানশীল ধনী শম্ভু চন্দ্র মল্লিক মহাশয়কে ঠাকুরের চারজন রসদ্দারের মধ্যে দ্বিতীয় রসদ্দার বলে নির্দেশ করতেন। রানি রাসমনির কালীবাড়ির কাছেই তার একখানি বাগান বাড়ি ছিল। তিনি ভগবত চর্চায় ঠাকুরের সঙ্গে অনেক কাল কাটাতেন। তার প্রতিষ্ঠিত একটি দাতব্য চিকিৎসালয়ও ছিল।
আরও পড়ুন:

মুভি রিভিউ: আদুরের ‘মাথিলুকাল’ সারা ছবি জুড়ে মামুটির অসামান্য অভিনয় প্রতিভা বিচ্ছুরিত হয়েছে

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৩: রাজসেবায় পুরস্কার মিলতেও পারে, নাও মিলতে পারে! কিন্তু সামান্য বিচ্যুতি ঘটলে রাজরোষে মৃত্যু নিশ্চিত

শ্রীরামকৃষ্ণের পেটের অসুখ অনেক সময় লেগে থাকত। একদিন শম্ভুবাবু এরূপ পেটের অসুখের জন্য তাকে একটু আফিম খেতে পরামর্শ দেন ও রানি রাসমনির বাগানে ফিরবার সময়, তার কাছ থেকে নিয়ে যেতে বলেন। ঠাকুর ও সে-কথাই সম্মত হলেন। তারপর কথাবার্তায় ওই কথা দু’ জনেই ভুলে গেলেন। শম্ভুবাবুর নিকট হতে বিদায় গ্রহণ করে, পথে এসে ঠাকুরের আফিম নেওয়ার কথা মনে পড়ল। পুনরায় ফিরে আসে দেখলেন শম্ভুবাবু ভিতর গিয়েছেন। ঠাকুর ওই বিষয়ের জন্য তাকে আর না ডেকে তার কর্মচারীর কাছ থেকে একটু আফিম চেয়ে নিয়ে রানি রাসমনির বাগানে ফিরতে লাগলেন।

কিন্তু রাস্তায় এসে ঠাকুরের এমন ঝোঁক এল যে সামনে রাস্তা আর দেখতে পেলেন না, পা যেন পেছনে টানছে। পিছনের রাস্তা বেশ দেখা যায়। দু’ এক পা সামনে গিয়ে আবার দেখা যায় না। তখন দু-একবার এরকম হওয়াতে ঠাকুরের মনে হল, শম্ভু বলেছিল আমার নিকট হতে আফিম চেয়ে নিয়ে যেও কিন্তু তিনি তা না করে কর্মচারীর কাছ থেকে আফিম নিয়েছিলেন। কর্মচারীর শম্ভুর আদেশ ছাড়া দেওয়া উচিত হয়নি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩২: দীক্ষার আংটি হেমলতাকে দিয়েছিলেন মহর্ষিদেব

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৪: রামচন্দ্রকে ঘিরে যুগান্তরেও কেন উন্মাদনা? একজন কথকঠাকুরানির সাধারণ সমীক্ষা

এদিক থেকে মিথ্যা ও চুরি দুই দোষ হচ্ছে। সেই কারণেই মা তাকে ঘোরাচ্ছেন। এই মনে করে তিনি ফিরে গিয়ে শম্ভুবাবুর ঔষধালয়ে দেখেন—কর্মচারীও সেখানে নেই। তখন তিনি জানালা দিয়ে আফিমের মোড়কটি ভিতরে ফেলে বলেন, ‘ওগো, এই তোমাদের আফিম রইল’; বলে তিনি আবার রানি রাসমনির বাগানের দিকে চললেন। তখন রাস্তা বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। শ্রীশ্রীঠাকুর বলতেন “মায়ের উপর সম্পূর্ণ ভার দিয়েছি কিনা। তাই মা হাত ধরে আছেন। একটুও বেচালে পা পড়তে দেন না।”

শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বাঙ্গীণ সত্যনিষ্ঠা ও নির্ভরতা কি কল্পনা করতে পারি! ঠাকুর গল্পের ছলে বলতেন, আল দিয়ে যাওয়ার সময় বাপ ছেলের হাত ধরে থাকলে ছেলে পড়ে না। কিন্তু ছেলে বাবার হাত ধরে থাকলে আল থেকে পড়ে যেতে পারে।—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content