রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

অলঙ্করণ: লেখক।

ডিসেম্বর ২২, জাতীয় অঙ্ক দিবস। দাদা! অঙ্ক কি কঠিন? ধরা যাক, একটা দুষ্টু ছেলে দৌড়ে আমগাছে উঠল, ঘণ্টায় কিছু কিলোমিটার বেগে যদি আম পাড়ার জন্য হাত বাড়ায় তাহলে কটা আম তার হাত ফসকাবে? কিংবা, একটা মিছিল গলির মোড় ঘুরে বড় রাস্তায় পড়লে ডানদিকের বারান্দায় ক’জন লোক দাঁড়িয়ে আছে? অথবা, হোমস যদি দশটা রসগোল্লা খেতে সাড়ে ছত্রিশ সেকেন্ড সময় নেয় তাহলে ওই একই সময়ে বক্সী ক’বার ফেলুর মতো ‘আই সি’ বলতে পারবে?
যাই হোক, পৃথিবী জুড়ে অঙ্কের হিসেবে ঢেউ ভাঙছে, ঝড় আসছে, বাতাস বইছে। অনন্ত আকাশে নক্ষত্রদল থেকে মাটির গভীরের উত্থান-পতন, কিছুই অঙ্কের বাইরে নয়। তার মাঝে তেলা বাঁশ, চৌবাচ্চা, রসগোল্লা, লজেন্স, শ্রমিক, ঘড়ির পেণ্ডুলাম, যদি-তবে-ধরা যাক, ট্রেন, হাট-বাজারের জমা খরচ, পরীক্ষায় পাওয়া নাম্বার থেকে বাঁদরের পিঠেভাগের এক্স ওয়াই জেড… কিংবা ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, পঞ্চভুজ, ষড়ভুজের কৌণিক মাণ, গোলকের দোলন, আপতন, বৃত্তের ব্যাস কিংবা ক্যালকুলাস, সরল কিংবা বক্র, আপেক্ষিকতা অথবা বিগ ব্যাং… এ সবের দুই দুগুণে অথবা সাত দুগুণে চোদ্দোর চার হলে কিংবা না হলেও, হাতের পেনসিলের থিওরি, থিওরেমের হিসেব ডায়মণ্ডহারবার থেকে রাণাঘাট হয়ে তিব্বত যাওয়ার মতোই জলবত্ তরলম্।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৪: মাটি তোদের ডাক দিয়েছে…

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৮: সুন্দরবনের তিন গাজী—রক্তান গাজী, তাতাল গাজী ও শতর্ষা গাজী

তো, যারা অঙ্কের গোল্লাছুটে ঢ্যারা বেশ চিনেছে, কর না গুনলে যারা হোঁচট খায়, হিসেব মানে যাদের কাছে ছোট-বড়-মাঝারির মাঝামাঝি ডাবল কিংবা ট্রিপল এক্সেল বা ওই রকম কিছু একটা হবে বোধহয়, অথবা অমুকের জামাইয়ের মামার শালার পিসের খুড়তুতো ভাই আদ্যানাথের মেসো, তাদের কাছে অঙ্কের হিসেব অন্যরকম। এই যেমন, রাষ্ট্রের কাছে মানুষ, গাড়ি, বাড়ি, ভাষা সকল কিছুই নম্বর, ফিগারে মূল্যায়িত, জন্ম কিংবা মৃত্যু একটা হিসেব, ‘জন’ মানেই সংখ্যা, তার গড়, হার, বর্গ, সূত্র ধরে ধরে শতাংশ, কমা-বাড়া, পরিসংখ্যান কিংবা লাভ ক্ষতির অঙ্ক-ই কষা হচ্ছে পাড়ার মোড় থেকে হেড আপিসের বড়বাবুর টেবিলেও। জীবনের বাঁকে বাঁকেও কী এল-গেল, ক্লাস-কাস্ট-কালচারের কোণে কোণে এই Cost এর কষ্ট, দম বের করা দাম চোকানোর হিসেব।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৭: হারায়ে খুঁজি চন্দ্রনাথ

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

এদিকে, শূন্য-একের বাইনারির ওধারে শূন্য-পূর্ণের আপেক্ষিক সত্যকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে যারা, যারা বাজারে যাচ্ছে বা ফিরছে, যারা আজ বাড়ি ফিরতে পারবে না, যে আজ নতুন কিছু শুরু করল, যে এইমাত্র শেষ করল কিছু, যে ভাবছে কিছু করবে অথবা করবে না, যারা পা ফেলছে বা দৌড়চ্ছে, যার পায়ে বল, হাতে কলম, যে সাঁতরাচ্ছে, যে গাইছে, বাজাচ্ছে, যে এইমাত্র চেকমেট করল, যাদের নুন-পান্তার হিসেব কেক-রুটির সঙ্গে মিলছে না, যারা অস্ত্র শাণাচ্ছে সামনে বা পিছনে, যারা লড়ছে অথবা যারা প্রথমার্ধে হারছে, তারা সকলেই একটা অঙ্ক কষছে, মেলানোর চেষ্টা করছে, অথবা ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন’ ভেবে থমকাচ্ছে, তারা আসলে একটা অঙ্ক করছেই।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৫: ঠাকুরবাড়ির দখিনা বাতাস— জ্ঞানদানন্দিনী দেবী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন

অঙ্ক করছে তারাও, যারা তৈলাক্ত বাঁশটা বাঁদরের অলক্ষ্যে সরিয়ে নিয়ে অন্যের জন্য গুছিয়ে তুলে রাখছে, যারা ‘গোওওওওওওল’ বলে মাঠ কাঁপাচ্ছে মাঠের ভিতর বা বাইরে থেকেও, যারা আউট হয়েও প্যাভিলিয়নে ফিরছে না, যারা আউট না হয়েও ফিরে গেছে, যে রিসার্ভ বেঞ্চে, যে গ্যালারিতে, যে স্টাম্পের সামনে, যে পিছনে, যে বিপরীতে… সকলেই অঙ্ক করছে।

আজ রাস্তায় ক’জন গেল সে হিসেব যাদের করায়ত্ত, কালের ঘরে শনি দিয়ে যে আজ সেলাই দিদিমনি, যে তোমার নিশ্বাস-প্রশ্বাসের হিসেব রাখতে চায়, যারা তোমার চিন্তায় বিনিদ্র, তোমাকে না পেলে যাদের ক্ষতি কিংবা বৃদ্ধি, যারা নিছক তারা গুণছে কিংবা মহাসাগরের কূলে নুড়ি বা পরশ পাথর কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে তারাও হিসেব মেলাতে চাইছে বৈকি!

অঙ্ক যাদের মিলছে, যাদের মিলছে না, যারা মেলাতে চাইছে আপ্রাণ, বুঝে নিচ্ছে যারা কিংবা ভুলে গেছে অথবা যারা মিলে গেছে ভেবে নিয়ে বেশ মজায় আছে, যারা সামনের বা পিছনের খাতা ধরে টানছে, যারা টুকছে প্রাণপণে আর ওয়ার্ণিং বেল পড়ে গেছে… অঙ্কটা শুধু যে তাদের জন্যই জটিল বা সোজা-সরল নয়, যারা এখনও খাতা খোলেনি, আঁক কাটেনি, পা ফেলেনি বা ধরি ধরি করেও ধরতে পারছে না তাদেরও বটে।
* হুঁকোমুখোর চিত্রকলা : লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content