বুধবার ২৭ নভেম্বর, ২০২৪


জ্ঞানদানন্দিনী।

উনিশ শতকের নারীশিক্ষা নারী স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলব অথচ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রসঙ্গ আসবে না— এ অসম্ভব। ঠাকুরবাড়ি নারী স্বাধীনতার বিষয়ে প্রথম অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। ঠাকুরবাড়ির কন্যা এবং পুত্রবধূরাও বাঙালি মেয়েদের সামনে দৃষ্টান্ত স্বরূপ। আজ আমাদের কথকতা জ্ঞানদানন্দিনীকে নিয়ে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৃতি সন্তান সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী! সত্যেন্দ্রনাথ আদর করে তাঁকে ডাকতেন—‘জ্ঞেনুমনি’! আমরা সকলেই তাঁকে প্রগতিশীল, আধুনিক, দিগন্তসৃষ্টিকারী এক মহীয়সী হিসেবে জানি।

জ্ঞানদানন্দিনী এখনও বাঙালি মেয়েদের কাছে স্টাইল আইকন। এখন তাঁর মনের রেনেসাঁ পর্বটা ঠিক কেমন ছিল? কতটা লড়াই তাঁকে একলা করতে হয়েছিল সেই সময়কার খাঁচায় বন্দী পাখির মতো মেয়েগুলিকে আলোর পথ দেখানোর জন্য? এইসবই তো জানতে হবে। সরস্বতীর লীলাকমল তো সকলের হাতে আসে না। জ্ঞানদানন্দিনী কিন্তু পেয়েছিলেন সেই লীলাকমল। সারাজীবনব্যাপী তাঁর অনেক কাজ। ঘরে বাইরে কত মেয়ের তিনি প্রেরণা ছিলেন। তেমনি ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। অথচ সেই ব্যক্তিত্বের নির্মাণপর্বও ছিল বাধাবিপত্তিতে ভরা। ভাগ্যিস সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন! নাহলে আমরা জ্ঞানদানন্দিনীর আসল স্বরূপকে খুঁজে পেতাম না।
যশোরের নরেন্দ্রপুরের পিরালী ঘরের মেয়ে বলেই ঠাকুরবাড়িতে বৌ হয়ে এসেছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। তাঁর বাবা নরেন্দ্রনাথ এবং মা নিস্তারিণী দেবীর ভাবনা ছিল সেকেলে সমাজের থেকে একটু আলাদা। লেখাপড়া ভালোবাসতেন দু’জনেই। নরেন্দ্রনাথের বাড়ির আঙিনাতেই ছিল একটি পাঠশালা। নিস্তারিণী দেবী গভীর রাতে লুকিয়ে লেখাপড়া করতেন। বাবা-মায়ের বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনা তাঁর রক্তের মধ্যেই ছিল। ঠাকুরবাড়ির পরিবেশ এবং সত্যেন্দ্রনাথ সেই ভাবনাকে সমৃদ্ধ করে তাঁকে এগিয়ে চলার রসদ জুগিয়েছে।

বাঙালি পুরুষরাও তখন অর্ধাঙ্গিনীদের লেখাপড়ার বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন হয়ে উঠছেন। এখন সেইটি কতটা মেয়েদের চিন্তার বিকাশ ঘটানোর জন্য আর কতটা নিজেদের মনের কথা প্রকাশের যোগ্য আধার খুঁজে পাওয়ার জন্য — সেই বিষয় আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি চিঠিতে বাঙালি পুরুষদের এই উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছিল—‘ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণরা কি অশিক্ষিত স্ত্রীর কাছ থেকে যথেষ্ট সম্প্রীতি সান্ত্বনা এবং সাহায্য পাবেন?— মনস্তত্ত্ব যাই হোক না কেন,মেয়েদের জন্য একটি খোলা আকাশ তৈরি হচ্ছিল। এইটিই বড় কথা।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪: কৃষ্ণভাবিনী দাসী— প্রথম মহিলা ভ্রমণ কাহিনিকার

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭২: রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনে কঠোর হতেও পারতেন

ছোটবেলায় নতুন কাপড় পরার আগে কাপড়ের একদিক থেকে সুতো বের করে নিয়ে সেটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ‘কাঁটা নাও’, ‘খোঁচা নাও’, ‘আগুন নাও’— এইসব বলে নাকি কাপড়অনিষ্টকারী সব জিনিসকে এক এক টুকরো দিয়ে পরতেন। পরে এই জ্ঞানদানন্দিনীই বাঙালি মেয়েদের শাড়ি পরার নতুন ধরণ তৈরি করবেন। সত্যেন্দ্রনাথ আর জ্ঞানদানন্দিনীর যখন বিয়ে হয় তখন জ্ঞানদানন্দিনীর বয়স মাত্র সাত। বাবা-মায়ের পরেই স্বামী সত্যেন্দ্রনাথের উদার মানসিকতা প্রভাব ফেলেছিল সত্যেন্দ্রনাথের মনে।

জ্ঞানদানন্দিনী সেই সময়ের পর্দানশীন মেয়েদেরও দেখেছেন আর নিজের স্বামীকে দেখেছেন প্রচলিত ছকের উল্টোপথে হাঁটতে। নাহলে কেউ রাতের আঁধারে নিজের বন্ধু মনোমোহন ঘোষ আর জ্ঞানদানন্দিনীর সাক্ষাৎ ঘটাতে পারেন শোবার ঘরের মশারির মধ্যে? সত্যেন্দ্রনাথ বিলেত গেলেন আর ডাক পাঠালেন অর্ধাঙ্গিনীকে। ফরাসি দোকানে অর্ডার দিয়ে জ্ঞানদানন্দিনীর জন্য ওরিয়েন্টাল পোশাক বানালেন। অনেক ঝড় পেরিয়ে জ্ঞানদানন্দিনী যেদিন বোম্বাই যাত্রা করলেন, সেদিন ঠাকুরবাড়িতে রীতিমতো কান্নার রোল পড়ে গেল।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দাসদাসীরাও সেই কান্নায় শামিল হয়েছিল। জ্ঞানদানন্দিনীও পুরোপুরি সংস্কারমুক্ত ছিলেন না। ফলে ঘেরাটোপ দেওয়া পাল্কি চড়ে জাহাজে ওঠা, পার্সি পরিবারে থাকা, লাটসাহেবের সঙ্গে কথা বলতে না পারার অস্বস্তি— সবটাই ধীরে ধীরে অতিক্রম করতে হয়েছিল তাঁকে। প্রথমদিকে লজ্জায় কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। তাঁকে ‘মুগীমাসি’ বা ‘বোবা’ বলা হত। ধীরে ধীরে নতুন এক জ্ঞানদানন্দিনী আত্মপ্রকাশ করলেন। যিনি তাঁর কাজের জন্য অমরতা পাবেন। জ্ঞানদানন্দিনীকে লেখা সত্যেন্দ্রনাথের একটি পত্রের উল্লেখ করা যায়। সত্যেন্দ্রনাথ লিখছেন,‘…তুমি উন্নত হও, শিক্ষিত হও, তুমি ইংলন্ডের সমাজের মধ্যে থাকিয়া তোমার স্ত্রী হৃদয়কে সহস্র গুণে বলবান কর…। তুমি আপনাকে যত উন্নত করিবে, তোমার দেশের ভগিনীগণের তোমার দৃষ্টান্ত ততই উপকার করিতে পারিবে।’
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৭: হারায়ে খুঁজি চন্দ্রনাথ

দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-৩: মালতীর কথা…

সেকালের মহিলাদের বাইরে যাওয়ার একটি বাস্তব বাধা ছিল। তাদের পোশাক। মেয়েরা তখন পরতেন শুধু একটি শাড়ি। পেটিকোট বা ব্লাউজ পরার রীতি তখনও প্রচলিত হয়নি। ১৮৫০ সালে বিদেশিনী ফ্যানি পার্কস এই সমস্যার কথা লিখেছিলেন। ঈশ্বরগুপ্ত সংবাদ প্রভাকরে মেয়েদের বিষয় অনেক বিধিনিষেধ তৈরি করে নিয়মিত লিখতেন। তার মধ্যে তাঁর আশঙ্কা ছিল— মেয়েরা জুতো পরবে, গাড়িতে উঠবে আর বাইরে যাবে। জ্ঞানদানন্দিনী এই তিনটি নিষেধের বেড়াই পার হয়েছিলেন। কিন্তু ঈশ্বর গুপ্তের সেসব আর দেখা হয় নি। দেবেন্দ্রনাথ সিভিলিয়ান সন্তানের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি। কিন্তু পাল্কি করে জাহাজে ওঠার আদেশ জারি করেছিলেন।

সেবার জ্ঞানদানন্দিনীকে কোনও প্রতিবাদী ভূমিকায় দেখা না গেলেও দুবছর পর ফেরার সময় জ্ঞানদানন্দিনী কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ফিরেছিলেন একটি গাড়িতে চড়ে, একা! এই খবর এতটাই স্তম্ভিত করেছিল যে সংবাদপত্রে এই খবর প্রকাশিত হয়েছিল। দেবেন্দ্রনাথ বিরক্ত হয়ে পুত্রবধূর সঙ্গে দীর্ঘদিন বাক্যালাপ করেননি। ভিন্ন রকম শাড়ি পরা, স্বামীর সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাওয়া এবং গাড়ি চড়া — এই অপরাধে সত্যেন্দ্রনাথ আর জ্ঞানদানন্দিনীকে ঠাকুরবাড়িতে একঘরে হয়ে থাকতে হয়েছিল।

জ্ঞানদানন্দিনী দেবী।

জ্ঞানদানন্দিনী প্রথমে পার্সি ধরণে শাড়ি পরতেন, তারপর তিনি পার্সিদের ডানদিকে আঁচল দেওয়ার রীতিকে বাঁদিকে করলেন। ব্লাউজ, পেটিকোট, চাদরের প্রবর্তন করলেন। সারা ভারতে ছড়িয়ে যাচ্ছিল তাঁর এই শাড়ি পরার ধরণ। ১৮৭১ সালে বামাবোধিনী পত্রিকায় এই শাড়ি পরার প্রয়োজনীয়তার বর্ণনা করে একটি চিঠি লেখেন। তবে বাঙালি মেয়েদের কুঁচি করে শাড়ি পরার রেওয়াজ প্রবর্তন করেছিলেন কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা মহারানি সুনীতিদেবী।

জ্ঞানদানন্দিনী বহুভাষাবিদ ছিলেন। বাংলা, ইংরেজি, মারাঠি, গুজরাটি এমন কি ফরাসিও শিখেছিলেন। শিশুদের মনের বিকাশের জন্য তিনি ‘বালক’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ছোটদের জন্য তিনি দুটি বই লিখেছিলেন ‘টাকডুমা ডুম’ এবং ‘সাত ভাই চম্পা’। সন্তানদের জন্মদিন পালন, ইংরেজি নববর্ষে শুভেচ্ছা বিনিময়, এপ্রিল ফুল করা ইত্যাদি প্রথার প্রচলন করেন। তখনকার ইঙ্গবঙ্গ সমাজের কেন্দ্রে তিনি ছিলেন এবং ধীরে ধীরে ঠাকুরবাড়িতেও তাঁর ব্যক্তিত্ব প্রাধান্য পেতে লাগল। বাঙালি সমাজেও।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৫: উদ্যানবাটিতে সারদা মায়ের ঠাকুরের শুশ্রূষা

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৪৫: নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জ ছায়ায়

কিন্তু এই প্রগতিশীল মানুষটি তাঁর দুই সন্তান ইন্দিরা ও সুরেনের জীবনে অসম্ভব আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। তাঁদের চোখের আড়াল করতে চাইতেন না। সুরেনের স্ত্রী সংজ্ঞাদেবীর সঙ্গেও খুব একটা মনের মিল ছিল না জ্ঞানদানন্দিনীর। মনে প্রশ্ন জাগে, কেন এই আশ্চর্য চারিত্রিক বৈষম্য। তখন মনে পড়ে বিদেশে থাকাকালীন আর এক সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। সেই সন্তান খুব অল্পদিন জীবিত ছিল। তখন কাছে সত্যেন্দ্রনাথও ছিলেন না। বাকি দুই সন্তানকে সামলে জ্ঞানদানন্দিনীকে সেই সন্তানশোক সহ্য করতে হয়েছিল আর ভিতরে ভিতরে তৈরি হয়েছিল তীব্র শোক আর হারাবার ভয়। জ্ঞানদানন্দিনীর ব্যক্তিত্ব হয়তো বদলে যায়। আসলে মেয়েরা অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে পারে, আধুনিকতার অনেক সোপান পার হতে পারে । কিন্তু মাতৃত্ব আদি ও অকৃত্রিম। নারীর অন্তরের কেন্দ্রে অন্যতম চালিকা শক্তি। কখনও হার না মানা জ্ঞানদানন্দিনী এই শোকের কাছে নত হয়েছিলেন।

সহায়ক বই
নারীপ্রগতির একশো বছর—রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া
জ্ঞানদানন্দিনীর রচনাসংকলন: পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (সম্পাদনা)
জোড়াসাঁকোর জার্নাল: মহুয়া দাশগুপ্ত
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত এবং পরীক্ষায় আসবে না তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content