রবিবার ১৭ নভেম্বর, ২০২৪


হোক অল্প কিন্তু, বাসনা একটুও থাকতে থাকতে ভগবান লাভ হয় না। প্রতিনিয়ত আমাদের মনে কত না কতই বাসনা উঠে, সব পূরণ তো হওয়া কখনওই সম্ভব নয়। বড়, ছোট কত বাসনা ভোগের ইচ্ছা তো হয়; যা একজন্মে পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। আর এই বাসনা পূর্ণ করার জন্য আবার জীবন। জীবনে আবার বাসনা। এ ভাবে জীবন আর শরীর ধরনের শেষ হয় না। বাসনা, সাধনভজনের অন্তরায়। হয়ত সাধনা করতে করতে বাসনা এল, আর তারপর মৃত্যু হল। যোগভ্রষ্ট হল। আবার জন্মগ্রহণ ও সাধনা শুরু করা। সংস্কারের জন্য আবার সাধনায় লিপ্ত হওয়া।
শ্রীরামকৃষ্ণ এমন এক প্রসঙ্গে, ভোগলালসা পূর্ণ করার কথা বলতে গিয়ে নিজের কী কী বাসনা ছিল বা আছে, আর তিনি কীভাবে তা পূর্ণ করেছেন তা বলছেন। পরমহংসদেব বলছেন, “ভোগ লালসা থাকা ভালো নয়। আমি তাই যা যা মনে উঠত অমনি করে নিতাম। বড়বাজারের রঙকরা সন্দেশ দেখে খেতে ইচ্ছা হল। এরা আনিয়ে দিলে। খুব খেলুম, তারপর অসুখ। ছেলেবেলা গঙ্গা নাইবার সময়, তখন নাথের বাগানে, একটি ছেলের কোমরে সোনার গোট দেখেছিলাম। এই অবস্থার পর সেই গোট করতে সাধ হল। তা বেশিক্ষণ রাখবার জো নাই—গোট পরে ভিতর দিয়ে সিড়সিড় করে উপরে বায়ু উঠতে লাগল, সোনা গায়ে থেকেছে কি না? একটু রেখেই খুলে ফেলতে হল। তা না হলে ছিঁড়ে ফেলতে হবে। ধনেখালির খইচুর, খানাকুল কৃষ্ণনগরের সরভাজা। তাও খেতে সাধ হয়েছিল।” (সকলের হাস্য)
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৪৯: যিনি জগতে পরিব্যপ্ত, তিনিই প্রত্যেকের অন্তরে অবস্থান করছেন

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৭: হারায়ে খুঁজি চন্দ্রনাথ

সকলের হাস্য হওয়ারই কথা। যারা নিত্য নতুন বাসনার ঘেরাটোপে থাকতে পছন্দ করে, তাদের কাছে এই বাসনা গুলো ধ্যর্তব্যের মধ্যেই নয়। এই সাধ গুলোর প্রত্যেকটি বালক সুলভ বাসনা। রামকৃষ্ণ জীবন আদর্শ বিশ্লেষণে দেখা যায়, মা ভবতারিণী, বালক শ্রীরামকৃষ্ণের কোন বাসনা অপূর্ণ রাখেননি। তাকে পূর্ণ করে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কৃতকৃত্য। পূর্ণস্বরূপ ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ যে বাসনার কথা বলছেন, আমাদের লৌকিক দৃষ্টিতে এগুলো তেমন রেখা পাত করে না। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে এগুলো সাধনার অন্তরায়। তিনি বলতেন, সুতোয় ফোস থাকলে সুচের মধ্য দিয়ে ঢুকে না। কী অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি!
আরও পড়ুন:

দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-২: একলা চলো রে…

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৮: সুন্দরবনের তিন গাজী—রক্তান গাজী, তাতাল গাজী ও শতর্ষা গাজী

সহজ সরল বাসনামুক্ত যে পুরুষ, পূর্ণতা ও অপূর্ণতা পার্থক্যের চুল চেরা বিচার করেছেন। কর্মের গতি যেমন অনন্ত। বাসনা আর নির্বাসনার মাঝে যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে তাও বোঝা কঠিন। অনেক সময় অনেকে প্রশ্ন করেন, ভগবান বাসনা কি বাসনার মধ্যে পড়ে কি না? ভক্ত স্বাভাবিকভাবে আর কি প্রত্যাশা করতে পারে। একমাত্র ভগবানকে প্রত্যাশা করবে। ঠাকুর বলেছেন। শ্রীশ্রী মা বলেছেন, ভালো একমাত্র ভগবানকেই বাসবে। যেমন হিঞ্চেশাক শাকের মধ্যে নয়, পিত্ত দমন হয়— একথা ঠাকুর অবশ্য বলেছেন। যে প্রত্যাশা ঈশ্বরের সঙ্গে বন্ধন স্থাপন করে তাই শুধু রাখতে বলছেন। ভক্তের কাজ, শুধু তাকে ভালোবাসে যাওয়া। ভালোবেসে যাওয়া, যে ভালোবাসায় কোনও প্রত্যাশা নেই। এমন কি, কবে দেখা দেবেন সে বাসনাও নেই। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, তার বাসনার কথা। “শম্ভুর চণ্ডীর গান শুনতে ইচ্ছা হয়েছিল। সে গান শোনার পর আবার রাজনারায়ণের চণ্ডী শুনতে ইচ্ছা হয়েছিল। তাও শোনা হল।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৭: আস্তাবলে সহিসদের রাখি পরাতে রবীন্দ্রনাথ ছুটে গিয়েছিলেন

অনেক সাধুরা সে সময়ে আসত। তা সাধ হল, তাদের সেবার জন্য আলাদা একটি ভাঁড়ার হয়। সেজোবাবু তাই করে দিলে। সেই ভাঁড়ার থেকে সাধুদের সিদে, কাঠ এসব দেওয়া হত। একবার মনে উঠল যে খুব ভালো জরির সাজ পরব। আর রুপার গুড়গুড়িতে তামাক খাব। সেজোবাবু নূতন সাজ, গুড়গুড়ি সব পাঠিয়ে দিলে। সাজ পরা হল। গুড়গুড়ি নানা রকম করে টানতে লাগলুম। একবারে এপাশ থেকে, একবার ওপাশ থেকে,- উঁচু থেকে নিচে থেকে। তখন বললাম, মন এর নাম রুপার গুড়গুড়ি তে তামাক খাওয়া! এই বলে গুড়গুড়ি ত্যাগ হয়ে গেল। সাজগুলো খানিক পরে খুলে ফেললাম, পা দিয়ে মাড়াতে লাগলাম আর তার উপর থু থু করতে লাগলাম, বললাম এর নাম সাজ! এই সাজে রজোগুণ হয়। অদ্ভুত শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্ভুত সাধন। স্বামীজীর বলছেন, এমন ত্যাগ আর কোনওদিন কেউ দেখেনি। তিনি নর শ্রেষ্ঠ, ত্যাগের ঈশ্বর।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content