দক্ষিণ বারাসত স্টেশনের কাছে রায়নগর গ্রামে রয়েছে রক্তান গাজীর থান। এককভাবে নয়, একাধিক পৌরাণিক ও লৌকিক হিন্দু দেবদেবীর সঙ্গে নস্করদের প্রাচীন থানে বিবিমা’র সঙ্গে রয়েছে রক্তান গাজীর থান। লোকবিশ্বাস হল, রক্ত আমাশয় রোগে তাঁর কাছে মানত করলে রোগ সেরে যায়। আবার অনেকের ধারণা, যদি মেয়েদের অতিরিক্ত রক্তস্রাব হয়, তখন তাঁর থানে মানত করলে সেরে যায়। তাঁর আসল নাম বা পরিচয় বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে দক্ষিণ বারাসতের রায়নগর গ্রামে রক্তান গাজীর বার্ষিক জাঁতাল উৎসব হয়।
লোকগবেষকদের মতে, সুন্দরবনের লৌকিক দেবতা রক্তবর্ণের পঞ্চানন্দ থেকে রক্তান গাজীর উদ্ভব। সুন্দরবন অঞ্চলে যখন ইসলাম ধর্ম প্রভাব বিস্তার করছিল এবং তার ফলে অনেক হিন্দু ইসলাম ধর্মগ্রহণে বাধ্য হচ্ছিল তখন এই রূপান্তর ঘটে। দক্ষিণ ভারতের লোকদেবতা রক্তকাটেরির সঙ্গে রক্তান গাজীর লোকসংস্কৃতিগত সাদৃশ্য পাওয়া যায়। রক্ত আমাশয় বা মহিলাদের অতিরিক্ত রক্তস্রাব হলে আরোগ্য প্রার্থনায় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে রক্তান গাজীর কাছে মানত করে। রক্তান গাজীকে নিয়ে পালাগান হতেও দেখা যায়। সেখানে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ উপস্থিত থাকে। এদিক থেকে বিচার করলে রক্তান গাজী হলেন সুন্দরবনের অন্যতম ধর্মসমন্বায়ক দেবতা।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৭: হিন্দু-মুসলিম মিশ্র দেবতা সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর
এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-৩: ইতিহাসের পাতায় লাচিত বরফুকোন
সুন্দরবন অঞ্চলে একসময় তাতাল গাজীর প্রভাব থাকলেও এখন তাঁর নাম আর বিশেষ শোনা যায় না। তাতাল গাজীর সম্ভবত একটাই থান দেখা যায় মথুরাপুর ১ নং ব্লকের নালুয়া গ্রামে। লোকগবেষক ধুর্জটি নস্কর মহাশয় ও কৃষ্ণকালী মন্ডল মহাশয়ের লেখা থেকে তাতাল গাজীর বিষয়ে কিছু জানা যায়। তাতাল গাজী হলেন সুন্দরবনের আর এক গো-রক্ষক দেবতা। গোরুর গায়ে রক্ত চোষক এঁটুলি হয়। এঁটুলিকে স্থানীয় ভাষায় অনেকে বলে ‘কেঁট’। এঁটুলির সংক্রমণ তীব্র হলে গোরু-বাছুরকে রক্ষা করতে ওই অঞ্চলের মানুষ তাতাল গাজীর থানে গিয়ে মানত করে।
হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই তাতাল গাজী উপাস্য। গোরু-বাছুর এঁটুলির প্রভাব থেকে মুক্ত হলে মানতকারী বাতাসা, সন্দেশ ও ফলমূলের নৈবেদ্য দিয়ে তাতাল গাজীর উপাসনা করে। অনেকে উপচার হিসেবে তাঁর থানে একটা নতুন ঝাঁটাও দেয়। লোকদেবী শীতলার হাতে যেমন থাকে ঝাঁটা রোগজীবাণু নির্মূলকরণের প্রতীক হিসেবে তেমনই এঁটুলি নির্মূলের প্রতীক হিসেবে তাতাল গাজীকেও দেওয়া হয় ঝাঁটা। নালুয়া গ্রামে প্রতি বছর পয়লা মাঘ তাতাল গাজীর বার্ষিক জাঁতাল উৎসব হয়। এই উপলক্ষ্যে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বহু মানুষের সমাগম হয়।
হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই তাতাল গাজী উপাস্য। গোরু-বাছুর এঁটুলির প্রভাব থেকে মুক্ত হলে মানতকারী বাতাসা, সন্দেশ ও ফলমূলের নৈবেদ্য দিয়ে তাতাল গাজীর উপাসনা করে। অনেকে উপচার হিসেবে তাঁর থানে একটা নতুন ঝাঁটাও দেয়। লোকদেবী শীতলার হাতে যেমন থাকে ঝাঁটা রোগজীবাণু নির্মূলকরণের প্রতীক হিসেবে তেমনই এঁটুলি নির্মূলের প্রতীক হিসেবে তাতাল গাজীকেও দেওয়া হয় ঝাঁটা। নালুয়া গ্রামে প্রতি বছর পয়লা মাঘ তাতাল গাজীর বার্ষিক জাঁতাল উৎসব হয়। এই উপলক্ষ্যে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বহু মানুষের সমাগম হয়।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৬: ভয়ের না ‘অভয়ের বিয়ে’
দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-৩: মালতীর কথা…
শতর্ষা গাজীর মাজার রয়েছে দক্ষিণ বারাসতে। দক্ষিণ বারাসত হল অধুনা লুপ্ত আদিগঙ্গার তীরে অবস্থিত একটি প্রাচীন জনপদ। ষোড়শ শতকে লেখা কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘কবকঙ্কণ চণ্ডী’ গ্রন্থে বানিজ্যের জন্য ধনপতি সওদাগরের সমুদ্রযাত্রা বর্ণনার সময় এই স্থানের উল্লেখ রয়েছে। এখানে প্রাচীন কালে সুন্দরবনের লৌকিক ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায় ও তাঁর মা নারায়ণীদেবীর একশো বারামূর্তির পুজো প্রচলিত হয়। ‘বারামূর্তি’ শব্দের অর্থ হল মুণ্ডমূর্তি। একশত বারামূর্তির পুজো থেকে এই স্থানের নাম হয় বারাশত। উত্তর চব্বিশ পরগনাতেও অনুরূপ কারণে রয়েছে একই নামের অপর স্থান। কালের স্রোতে বানানভেদে বারাশত এখন হয়েছে বারাসত বা বারাসাত।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৫: উদ্যানবাটিতে সারদা মায়ের ঠাকুরের শুশ্রূষা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৭: আস্তাবলে সহিসদের রাখি পরাতে রবীন্দ্রনাথ ছুটে গিয়েছিলেন
উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় উভয় স্থানের নাম একই হওয়ায় পরে দক্ষিণ অঞ্চলে এই স্থানের নামের আগে দক্ষিণ শব্দটি যুক্ত হয়। একানে দক্ষিণ রায় ও নারায়ণী দেবীর পূজাস্থলের অদূরে রয়েছে শতর্ষা গাজীর মাজার। শত বারামূর্তির পুজোর সাথে শতর্ষা নামের কোনও সম্বন্ধ আছে কিনা তা লোকগবেষকরা বলতে পারবেন। তবে শোনা যায়, এই অঞ্চলে প্রায় দু’শো বছর আগে এক গাজী সাহেব আসেন। তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা দেখে সবাই তাঁর অনুরক্ত হয়ে পড়ে। তখন স্থানীয় বসু জমিদার পরিবারের এক কর্তা এক ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারকে গাজীসাহেবের সেবা করার দায়িত্ব দেন। তখন গাজী সাহেব দক্ষিণ বারাসতেই স্থিত হন। পরে এখানে তিনি প্রয়াত হন। নানা রোগ থেকে নিরাময়ের বাসনা নিয়ে প্রতিদিন হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অনেক মানুষ শতর্ষা গাজীর মাজারে আসে।
এই তিন গাজী সম্বন্ধে প্রাচীন কোনও লেখা পাওয়া যায় না। যেটুকু জানা যায় তা লোকমুখে প্রচারিত কাহিনিতে। তাই তাঁরা আসলে ব্যক্তি চরিত্র নাকি কোনও কাল্পনিক চরিত্র তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। কীভাবে সুন্দরবনবাসীর মধ্যে তাঁদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেল তাও সঠিক জানা যায় না। কালের প্রবাহে সুন্দরবনে এই তিন গাজীর প্রভাব হ্রাস পেলেও হিন্দু-মুসলিম ধর্ম সমন্বয়ের ক্ষেত্রে এঁদের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না।—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।