ইতিহাস বড় মজার বিষয়। ইতিহাস শুধু নাম আর তারিখের তালিকাই ধরে রাখে না, সেই সঙ্গে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকে কত বীরদের অমর গাথা। আমাদের বরাক ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে এমন অনেক ক্ষণজন্মা জন্মেছেন যাঁরা আমাদের কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। অসমের রাজনীতি, সমাজ সংস্কৃতিতে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য।
অসমের রাজদণ্ড কোনওদিন মোগলদের হাতে যায়নি। দিল্লির সিংহাসনেও মোগল রাজা অধিষ্টিত থাকলেও অসমের মাটিতে মোগলরা রাজত্ব করতে পারেনি। তখন অহোম সেনাদের নেতৃত্ব করছিলেন লাচিত বরফুকোন। ১৬৬৭ সালে মোগলদের সঙ্গে অহোমদের প্রথম যুদ্ধ হয় ব্রহ্মপুত্রের উত্তরদিকে অবস্থিত বাঁশবাড়িতে। অহোমদের কাছে মোঘলরা নানা রকম রণকৌশল প্রয়োগ করেও পারছিল না। ইটাখুলি নামক জায়গায় শিবির বেঁধে মোগলরা নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু অহোম সৈন্যরা মোগলদের মানস নদীর ওপার পর্যন্ত তাড়িয়ে দিয়েছিল। মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব এ অপমান মেনে নিতে পারেননি। মোগলরা আবার অসম আক্রমণ শুরু করে। সেই সময় অহোম সৈন্যদের নেতৃত্ব দেন রাম সিংহ।
অসমের রাজদণ্ড কোনওদিন মোগলদের হাতে যায়নি। দিল্লির সিংহাসনেও মোগল রাজা অধিষ্টিত থাকলেও অসমের মাটিতে মোগলরা রাজত্ব করতে পারেনি। তখন অহোম সেনাদের নেতৃত্ব করছিলেন লাচিত বরফুকোন। ১৬৬৭ সালে মোগলদের সঙ্গে অহোমদের প্রথম যুদ্ধ হয় ব্রহ্মপুত্রের উত্তরদিকে অবস্থিত বাঁশবাড়িতে। অহোমদের কাছে মোঘলরা নানা রকম রণকৌশল প্রয়োগ করেও পারছিল না। ইটাখুলি নামক জায়গায় শিবির বেঁধে মোগলরা নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু অহোম সৈন্যরা মোগলদের মানস নদীর ওপার পর্যন্ত তাড়িয়ে দিয়েছিল। মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব এ অপমান মেনে নিতে পারেননি। মোগলরা আবার অসম আক্রমণ শুরু করে। সেই সময় অহোম সৈন্যদের নেতৃত্ব দেন রাম সিংহ।
এ বার লাচিত বরফুকোন আরও সতর্ক হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, যুদ্ধ জয় করতে হলে প্রত্যেক সিপাহিকে নিজস্ব দায়িত্ব খুব ভালো করে পালন করতে হবে। তাই তিনি ঘোষণা করেন, যে সৈন্য নিজের দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করতে পারবে না, তাকে তিনি নিজেই মৃত্যুদণ্ড দেবেন। লাচিত নিজে সৈনিকদের সব রকম ব্যবস্থার দিকে নজর রাখতেন। সেনা নায়কদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করে যুদ্ধের জোরদার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। আমিনগাঁও এর একটি দুর্গ তৈরি করার দায়িত্ব লাচিতের মামার উপর ছিল, তিনি নিজের দায়িত্ব ভালো ভাবে পালন করছিলেন না বলে লাচিত মামার শিরচ্ছেদ করে বলেছিলেন, “দেশ থেকে মামা বড় নয়।”
১৬৭১ সালের মার্চ মাসে মোগল এবং অহোমদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। সেই যুদ্ধ সারাইঘাটের যুদ্ধ নামে খ্যাত। মোগল সৈন্যরা নদী পথে যুদ্ধ করে এগোচ্ছিলেন। নৌকো থেকেই তিরের ডগায় আগুনের গোলা বেঁধে অহোম সৈন্যদের দিকে ছুঁড়ছিল। তাতে ঘাবড়ে না গিয়ে অসমের সৈনিকরা মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে অশ্বক্লান্ত নামক জায়গা অবধি তাদের নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ যুদ্ধের মোড় পাল্টে যায় এবং মোগলদের রণকৌশল সফল হতে থাকে। এ দিকে লাচিত বরফুকোন তখন অসুস্থ থাকায় অহোম সেনারা যেন খেই হারিয়ে ফেলেছিল। তারা যুদ্ধ জয়ের আশা ত্যাগ করে উল্টো দিকে যাত্রা করে।
১৬৭১ সালের মার্চ মাসে মোগল এবং অহোমদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। সেই যুদ্ধ সারাইঘাটের যুদ্ধ নামে খ্যাত। মোগল সৈন্যরা নদী পথে যুদ্ধ করে এগোচ্ছিলেন। নৌকো থেকেই তিরের ডগায় আগুনের গোলা বেঁধে অহোম সৈন্যদের দিকে ছুঁড়ছিল। তাতে ঘাবড়ে না গিয়ে অসমের সৈনিকরা মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে অশ্বক্লান্ত নামক জায়গা অবধি তাদের নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ যুদ্ধের মোড় পাল্টে যায় এবং মোগলদের রণকৌশল সফল হতে থাকে। এ দিকে লাচিত বরফুকোন তখন অসুস্থ থাকায় অহোম সেনারা যেন খেই হারিয়ে ফেলেছিল। তারা যুদ্ধ জয়ের আশা ত্যাগ করে উল্টো দিকে যাত্রা করে।
আরও পড়ুন:
অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-২: ইতিহাসে অসম
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৭: আস্তাবলে সহিসদের রাখি পরাতে রবীন্দ্রনাথ ছুটে গিয়েছিলেন
এ দিকে অসুস্থ দেশভক্ত লাচিত যুদ্ধের খবরাখর যথাযথ রাখছিলেন। তিনি আর দেরি না করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। অন্য দিকে নদীর উজানের দিকে যারা যাচ্ছিল তারা মনে করে লাচিতও উজানে যাচ্ছেন। সেই ভেবে উজানের দিকে যাওয়ার জন্য সবাইকে ডাকেন। লাচিত তখন খুব রেগে যান। কারণ, তিনি যুদ্ধ করতে এসেছেন, পালিয়ে যেতে নয়। তিনি হেং দা-এর বাঁট দিয়ে আঘাত করে চার জন মাঝিকে জলে ফেলে দেন। পরে অবশ্য অন্যরা তাদের নৌকোতে তুলেও নিয়েছিল। লাচিতের এমন ব্যবহারে সৈন্যদের মধ্যে খবর রটে যায় যে, যারা উজানের দিকে যাত্রা করছে লাচিত তাদের গলা কেটে নদীতে ফেলে দিচ্ছেন। ফলে কেউ আর উজানের দিকে গেল না। সবার মধ্যে দেশভক্তি আবার জেগে উঠল।
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৭: হিন্দু-মুসলিম মিশ্র দেবতা সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর
অহোমরা একটি নৌকার সঙ্গে আরও একটি নৌকা যুক্ত করে ব্রহ্মপুত্রের উপর খুব তাড়াতাড়ি একটি ভাসমান সতু বানিয়ে নিল। দু’ পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই হয়। তিন জায়গায়তেই অহোম সৈন্যরা জয় লাভ করে। ১৬৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে রাম সিংহ নিজের দেশের দিকে যাত্রা করেন। তখন হয়গ্রীব মাধব মন্দিরে পুজো করে ব্রাহ্মণদের বলেন, “লাচিত সামান্য বীর নন। আমি তাঁর মধ্যে কোনও খুঁত পাইনি।” তিনিও এও বলেছিলেন, “এ রকম সব ধরনের কাজে দক্ষ সৈন্য আমি ভারতে কোথাও দেখিনি।”
লাচিতের দেশ ভক্তির কোনও তুলনা নেই। হয়ত অসুস্থ অবস্থায় যুদ্ধ করার জন্যই লাচিত আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুদিন পরই তাঁর মৃত্যু হয়। এমন বীরের মৃত্যু শুধু শারীরিক ভাবেই হয়। লাচিত বরফুকোন আজও অসমের মানুষের মনে বেঁচে আছেন।
রাজনীতির কত রং বদলই না দেখল এই পাহাড় নদী ঘেরা আমাদের অসম। প্রায় দীর্ঘ ছয়শো বছর রাজত্ব করার পর অহোমদের হাত থেকে শাসনক্ষমতা চলে যায়। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই অসমে ইংরেজ রাজের সূত্রপাত ঘটে। তবে অহোমদের পর পরই ইংরেজরা অসমের ‘সরকার’ হয়ে ওঠেনি। তার আগে বার্মিসদের পদার্পণ হয়েছিল অসমে।
লাচিতের দেশ ভক্তির কোনও তুলনা নেই। হয়ত অসুস্থ অবস্থায় যুদ্ধ করার জন্যই লাচিত আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুদিন পরই তাঁর মৃত্যু হয়। এমন বীরের মৃত্যু শুধু শারীরিক ভাবেই হয়। লাচিত বরফুকোন আজও অসমের মানুষের মনে বেঁচে আছেন।
রাজনীতির কত রং বদলই না দেখল এই পাহাড় নদী ঘেরা আমাদের অসম। প্রায় দীর্ঘ ছয়শো বছর রাজত্ব করার পর অহোমদের হাত থেকে শাসনক্ষমতা চলে যায়। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই অসমে ইংরেজ রাজের সূত্রপাত ঘটে। তবে অহোমদের পর পরই ইংরেজরা অসমের ‘সরকার’ হয়ে ওঠেনি। তার আগে বার্মিসদের পদার্পণ হয়েছিল অসমে।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১৪: অন্ধকারের উৎস হতে—শীতকালের প্রতিরাত
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৫: উদ্যানবাটিতে সারদা মায়ের ঠাকুরের শুশ্রূষা
অহোম সাম্রাজ্যের প্রধান মন্ত্রীকে বলা হত বুড়াগোহাই। কমলেশ্বর সিংহের রাজত্বকালে বুড়াগোহাই ছিলেন পূর্ণানন্দ নামের এক অসৎব্যক্তি। কমলেশ্বর সিংহের শাসনকালে সাধারণ মানুষ অসহ্য হয়ে পানীমুরা নামক ব্যক্তির নেতৃত্বে পূর্ণানন্দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কিন্তু এই বিদ্রোহে পূর্ণনন্দকে খুব একটা দমন করা সম্ভব হয়নি।
এ দিকে ১৮১০ সালে কমলেশ্বর সিংহের মৃত্যু হলে তাঁর ছোট ভাই চন্দ্রকান্ত সিংহ অহোম রাজসিংহাসনে বসেন। চন্দ্রকান্ত নিজেও এক স্বেচ্ছাচারী রাজা ছিলেন। তিনি পূর্নাণন্দকে গ্রেপ্তার করার জন্য ইংরেজদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু সে সময় নেপালের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় ইংরেজ সরকার সাহায্য করতে পারেনি। তৎকালীন বরফুকোন বদনচন্দ্র ব্রহ্মদেশে গিয়ে পূর্ণানন্দের বিরুদ্ধে ব্রহ্মরাজার নিকট সাহায্য চান।
এ দিকে ১৮১০ সালে কমলেশ্বর সিংহের মৃত্যু হলে তাঁর ছোট ভাই চন্দ্রকান্ত সিংহ অহোম রাজসিংহাসনে বসেন। চন্দ্রকান্ত নিজেও এক স্বেচ্ছাচারী রাজা ছিলেন। তিনি পূর্নাণন্দকে গ্রেপ্তার করার জন্য ইংরেজদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু সে সময় নেপালের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় ইংরেজ সরকার সাহায্য করতে পারেনি। তৎকালীন বরফুকোন বদনচন্দ্র ব্রহ্মদেশে গিয়ে পূর্ণানন্দের বিরুদ্ধে ব্রহ্মরাজার নিকট সাহায্য চান।
১৮১৬ সালে ব্রহ্মদেশের রাজা অসম আক্রমণ করে পূর্ণানন্দকে হত্যা করেন। বর্মীরা যুদ্ধ জয় করেন। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক কারণে বদনচন্দ্রেরও হত্যা হয়। এ ভাবে অসম বর্মীদের অধীনে চলে যায়। অহোম রাজা নামেমাত্র রাজা হয়ে রইলেন। বর্মী আক্রমণে অসমের সাধরণ লোকের চরম ক্ষতি হল। তারা বহু গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়। বহু লোক অসম ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়।
এ দিকে নিজেদের মধ্যে সিংহাসনের জন্য লড়াই করে অহোম রাজতন্ত্র আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। কিছু দিনের মধ্যেই ইংরেজরা অসমের রাজনীতিতে প্রবেশ করে। মানদের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ হয়। ইয়ান্ডাবু নামক জায়গায় দু’ পক্ষের মধ্যে সন্ধি হয়ে যুদ্ধের অবসান ঘটে। একই সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে অসমে ইংরেজ সাম্রাজের পথ চলা শুরু হয়। এ ভাবেই শুরু হল আর এক নতুন অধ্যায়।—চলবে।
ছবি: লেখিকা
এ দিকে নিজেদের মধ্যে সিংহাসনের জন্য লড়াই করে অহোম রাজতন্ত্র আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। কিছু দিনের মধ্যেই ইংরেজরা অসমের রাজনীতিতে প্রবেশ করে। মানদের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ হয়। ইয়ান্ডাবু নামক জায়গায় দু’ পক্ষের মধ্যে সন্ধি হয়ে যুদ্ধের অবসান ঘটে। একই সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে অসমে ইংরেজ সাম্রাজের পথ চলা শুরু হয়। এ ভাবেই শুরু হল আর এক নতুন অধ্যায়।—চলবে।
ছবি: লেখিকা
ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক।