শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও মা সারদা। ছবি: সংগৃহীত।

অসুস্থতা নিয়েও সকলের সঙ্গে রসে-বশে ঠাকুর ভালোবোধ করতে লাগলেন। সারদা মা তাঁকে কাছে থেকে সেবা করে সবই লক্ষ্য করেন নীরবে। ডাক্তার মহেন্দ্রলালের চিকিৎসায় রোগ কিছুটা উপশম হলেও তা যে সম্পূর্ণ সারার নয়। সকল ভক্তের সঙ্গে শ্রীমাও তা বুঝতে পারেন। দেখতে দেখতে শীত শেষ হয়ে প্রকৃতি নবরূপে সেজে উঠেছে। নতুন পাতায় ভরে গিয়েছে উদ্যানবাটির গাছেরা। সারদা লক্ষ্য করেন যে, এই নতুনত্বের সঙ্গে শুধু একজনের জীবনীশক্তির কোনও মিল নেই। ধীরে ধীরে তা ফুরিয়ে আসছে। আর কোনও উপায় না দেখে স্থির থাকতে পারলেন না সারদামা। লক্ষ্মীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ঠাকুরের জন্য তারকেশ্বরে গিয়ে বাবা তারকনাথের কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকলেন।
শ্রীম’র স্ত্রী নিকুঞ্জদেবী বলেন, ‘শ্রীমা ও লক্ষ্মীর সঙ্গে কোনও পুরুষ তারকেশ্বরে গিয়েছিলেন কিনা, তা জানা নেই। হয়ত, তাঁরা দুজনেই গিয়েছিলেন। দু’দিন নির্জলা উপবাস করে ঠাকুরের রোগমুক্তির সঙ্কল্প করে পড়ে রইলেন। শরীর ক্রমে দুর্বল হয়ে গেল আর গলা শুকিয়ে গেল। হঠাৎ তিনি ওই অবস্থায় জড়ো করে রাখা মাটির পাত্রের মধ্যে একটি ভেঙে গেলে যেমন শব্দ উত্থিত হয়, তেমন শব্দ শুনতে পেলেন। শ্রীমার মন সঙ্গে সঙ্গে জাগতিক সম্পর্কের বাইরে ঊর্ধ্বগামী হল আর তাঁর স্বামীর জন্য ঐকান্তিক কামনা কোথায় যেন নিমেষে বিলীন হয়ে গেল। তাঁর সঙ্কল্পিত মনে যেন ঈশ্বরের ইচ্ছাই বড় হয়ে দেখা দিল, যা তাঁর পররর্তি আচরণ থেকে অনুমান করা যায়। সারদামার মনের অবস্থা নিচে নেমে এল। তিনি হত্যা দেওয়া বন্ধ করে দুর্বল শরীরে সেই গভীর রাতে মন্দিরের পিছনে গিয়ে কুণ্ড থেকে জল নিয়ে চোখে মুখে দিলেন এবং পরদিন ঠাকুরের সেবার জন্য উদ্যানবাটিতে ফিরে এলেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৪: শ্যামপুকুরে ঠাকুর

শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয় শিষ্যের দর্শন তো রোজ পাওয়া যাবে না/২

শ্রীমাকে ফিরে আসতে দেখেই অন্তর্যামি ঠাকুর মৃদুহেসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কিগো, কিছু হল’? তারপর নিজেই বুড়ো আঙুল নেড়ে বলেন, ‘কিছুই না’। এমন করে ঠাকুরের সেবা করতে করতে একদিন সারদা আড়াই সের দুধের একটা বড় বাটি নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময় মাথা ঘুরে পড়ে যান। সেইসময় নরেন ও বাবুরাম মহারাজ ছুটে এসে তাকে ধরেন। পায়ের গোড়ালির হাড়ে আঘাত পেয়ে ফুলে যাওয়ায় তিনদিন তিনি ঠাকুরকে মণ্ড তৈরি করে খাওয়াতে পারেননি। দিন ক্রমে শেষ হয়ে আসছে। রাত জেগে দিন কাটছে সারদামার। তারকেশ্বরে তিনি কি দেখেছিলেন, ঠাকুর জানতে চাওয়ায় সারদা বলেন, ‘দেখলুম মা কালীও ঘাড় কাত করে রয়েছেন। জানতে চাইলাম, মা, তুমি এমনভাবে আছ কেন? মা কালী বললেন, কী করব, ওর ওই অসুখ যে আমারও, বড় কষ্ট গো’।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৯: The ভাটুরা Co.

ঠাকুরের অসুখ প্রসঙ্গে শ্রীমা আরও বলেন যে তখন ঠাকুরের মুখ দিয়ে লাল কাটছে। গুগলি, গেঁড়ি সিদ্ধ করে তার ঝোল খাওয়ান হল। তখন তাঁর লাল ঝরা বন্ধ হল। সারদা ঠাকুরের গলা পলতে দিয়ে পরিষ্কার করছেন, ঠাকুর বলেন, ‘কী কচ্চ? পলতে দিচ্চ, আচ্ছা দাও’, আর কিছু বললেন না। আর একদিন ঠাকুর সারদাকে বলেন, ‘ইচ্ছে হচ্চে তোমার সঙ্গে রণজিৎ রায়ের দীঘিতে গিয়ে মায়ের ভোগ দিই, আমাদের সঙ্গে আর কেউ থাকবে না শুধু লাটু’। ঠাকুর তাঁর লীলাসম্বরণের আগে সারদাকে বলেছিলেন, ‘কামারপুকুরে থাকবে, শাক বুনবে, শাকভাত খাবে আর হরিনাম করবে। পরভাতী ভাল, পরঘরী ভাল নয়। তাই কামারপুকুরে নিজের ঘর কখনও নষ্ট কোরো না। কারও কাছে পয়সার জন্য চিৎহাত কোরো না। তোমার মোটা ভাত, কাপড়ের অভাব হবে না। কৃপণ হওয়া তবু ভাল, লক্ষ্মীছাড়া হওয়া ভাল নয়। তোমার কত নাতিপুতি, কিসের ভাবনা’?
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪: কৃষ্ণভাবিনী দাসী— প্রথম মহিলা ভ্রমণ কাহিনিকার

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৬: ভয়ের না ‘অভয়ের বিয়ে’

অবশেষে ১২৯৩ সালের ৩১ শ্রাবণের বর্ষণমুখর রাত একটার পর ঠাকুর গভীর সমাধিতে মগ্ন হন যা আর ভাঙেনি। পরদিন পয়লা ভাদ্রের দুপুরে সেই সমাধি মহাসমাধিতে পরিণত হল। নীরবে ঠাকুরের সব আদেশ মাথায় নিয়ে শ্রীমা তিরিশ বছরে তাঁর গার্হস্ত্য জীবন চোখের জলে শেষ হয়ে যেতে দেখলেন। তিনি বলেছেন যে, এমন ঘটার আগে যেদিন খিচুড়ি খেতে চেয়েছিলেন ঠাকুর, তার তলা ধরে গেল। ছেলেরা সব পোড়া খিচুড়িই খেল। সারদামার একটা দেশি কুঞ্জদার শাড়ি ছাদে শুকচ্ছিল তা আর পেলেন না খুঁজে। কে চুরি করে নিল। পরদিন পাষাণ ভার নিয়ে শ্রীমা যখন তাঁর হাতের বালা খুলতে যাচ্ছেন, তিনি সারদার হাত দুটো খপ করে ধরে বলেন, আমি কি কোথাও গেছি গো? এই যেমন এঘর থেকে ওঘর’! —চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content