রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


তরুণকান্তির পেন্টিং। চিত্রকলার ছবি সৌজন্য: সত্রাগ্নি।

 

বেঁচে থাকা

মোবাইলে এলার্ম বেজে ওঠে। অতীতের সুখ স্মৃতি থেকে ফিরে আসে বাবলি বসুন্ধরা ভিলার বর্তমানে। বাপিকে ওষুধ খাওয়াতে হবে। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে তো, এ বাড়িতে এসে তরুণকান্তির মত হাঁটতে না পারা সর্বক্ষণ হুইলচেয়ারে বসে থাকা একজন মানুষকে সে নিজের বাবার মতই আঁকড়ে ধরেছে। সর্বক্ষণের নার্স আছে। সাপোর্ট সার্ভিসের লোক তারা। কিন্তু যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ সে ওষুধপত্রগুলো তরুণকান্তিকে নিজে খাওয়ায়। সেজকাকিমার ঘরে দাদুর ঘরে ঠাম্মির ঘরে বা নিচের লনে যাওয়ার থাকলে হুইলচেয়ার সে নিজে নিয়ে যায়। এই হুইলচেয়ারটা নিজে নিজে চলতে পারে। মানে হ্যান্ডেল থেকে বোতাম টিপে তরুণকান্তি নিজে মুভ করাতে পারেন। কিন্তু বাবলি সেটা করতে দেয় না। অটোকন্ট্রোলের তার খুলে রেখেছে সে। তার নিজের বাবা ভীষণ ভালো ড্রাইভ করতেন। অজস্র অসংখ্যবার হাইওয়ে ধরে ফরিদাবাদ থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে ফরিদাবাদ গিয়েছেন। অথচ সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় বাবাকে চলে যেতে হল। তাই বাবলি আর ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।

নিজের ঘরের লাগোয়া স্টুডিও ঘরে জানালার কাছে হুইলচেয়ারের বসে জানলার বাইরের ঘোলাটে আকাশ দেখছিলেন তরুণকান্তি।

—ছবি আঁকছো না বাপি?

—উঁ! না!

বাবলি হাতের ওষুধটা তরুণকান্তির মুখে দিয়ে টেবিলে রাখা জলের বোতল থেকে জল খাইয়ে দেয়।

—তুই কি দুপুরে ঘুমোস না বাবলি?

—ঘুম আসে না। খাটাখাটনি নেই তো।
দুজন যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষ যখন কথা বলে তারা অনর্গল কথা বলতে পারে না। থেমে থেমে সময় নিয়ে কথা বলে। বলার আগেই মনে মনে ভেবে নেয় কি বলব কেন বলব কতটা বলবো। তরুণকান্তি জানেন বাবলির বয়সী একটা মেয়ে কি দুঃসহ দাম্পত্যের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। বাবলি জানে স্ত্রী সুজাতার অসহনীয় ব্যবহার উদ্ধত বেপরোয়া ছেলে প্রণয়কান্তি কীভাবে এই পঙ্গু মানুষটাকে আরও কুঁকড়ে গুটিয়ে দিয়েছে। তারপর বাবলির প্রতি প্রণয়ের ক্রমাগত দুর্ব্যবহারের খুঁটিনাটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে না জানলেও – তরুণকান্তি অনুভব করতে পারেন। পুত্রবধূর কাছে সেটাও তার একটা বড় কুণ্ঠার জায়গা। অন্যায় জেনেও তিনি কিছু করতে পারছেন না।

—ছবি যে আঁকি সেটা জোর করে আঁকি। আমার মনে আমার ভাবনায় কোন রং নেই। রং তো শুধু প্যালেটে বা তুলিতে থাকে না বাবলি। রংটা মনের মধ্যে থেকে ক্যানভাসে ফুটে ওঠে মনের রঙিন ছবিটাই সাদা ক্যানভাসে জীবন্ত হয়ে ওঠে। তখনই সেটা একটা সার্থক ছবি হয়ে ওঠে। না হলে সবটাই অর্থহীন আঁকিবুকি।

—আবার? আবার তুমি ওই সব নেগেটিভ কথা বলছ?

—জানিস বাবলি এই বসুন্ধরা ভিলার ঐতিহ্য পরম্পরা এই বাগেজগুলো অনেককে জীবনের পজিটিভ রাস্তাটা নিতে দেয়নি। তোর কাছে তো সবটাই বইয়ের খোলা পাতার মতো পরিষ্কার। তোদের ফুলকাকিমা মানে বিমলের বউ কীরাকে বসুন্ধরা ভিলা আপন করে নিতে পারেনি। সেটা হলে হয়ত ওদের বিয়ে টিকে যেত। জানি না। এই সুবিশাল প্রাসাদের ধবধবে সাদা রঙে যাতে দোষারোপের কলঙ্কের কালো কালি লাগতে না পারে তাই আমায় আমার আচমকা বিয়েটা মেনে নিতে হয়েছিল। সেই পারিবারিক কারণেই ভয়ঙ্কর শারীরিক মানসিক যন্ত্রণা মেনে নিয়েও তোকে মুখ বুজে এখানে থাকতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ২য় খণ্ড, পর্ব-৪৫: বাবলির বাবা যখন মারা যান তখন ও স্কুলছাত্রী

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৫: সুন্দরবনে বসন্ত রোগের দেবতা বসন্ত রায়

বাপি তোমার কাছেও তো আমার গোপন কিছু নেই। প্রথমতঃ ঠাম্মি তো নেই তাই সেজোমাকে বলে চলে যাবার কথা ভেবেছিলাম। সেজোমা মানা করলেন। তাঁর কথা আমি ফেলতে পারিনি। সেকেন্ডলি বাবার মৃত্যুর পর ফরিদাবাদের সব ছেড়েছুড়ে আমরা যখন দিল্লিতে সি আর পার্কে চলে এলাম তখন দাদু বেঁচে। আমার বিয়ে হল। আমি এ বাড়িতে চলে এলাম। কিছুদিন বাদে দাদু মারা গেলেন। কাকাকাকিমারা মায়ের যত্ন করেন ঠিকই। কিন্তু শিকড়বিহীনভাবে একটা সংসারের থাকা যে কি কষ্টকর সেটা আমি মাকে দেখে বুঝেছি। আর বসুন্ধরা ভিলাতে আমার থাকার যে মূল কারণ আমার স্বামী। তোমার ছেলে প্রণয়কান্তি দত্ত, যে আমাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিল। যাকে আমি ভালোবেসেছিলাম এখনও হয়তো… তিনি আজ আর আমায় স্ত্রীর মর্যাদা দেন না। আমার শাশুড়ি আমাকে নিজে পছন্দ করে তাঁর ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু এখন আর আমায় সহ্য করতে পারেন না।

কিন্তু এদের দু’জনকে বাদ দিলে এই গোটা বসুন্ধরা ভিলা আমাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। এ সব ছেড়ে দিল্লিতে সিআর পার্কের বাড়িতে ফিরে গেলে আমার মায়ের মানসিক চাপ আরও বাড়বে। প্রণয়ের সঙ্গে কী হয়েছে না হয়েছে সেসব মাকে আমি কিচ্ছু জানাইনি। বাবার শক এতবছর পরেও মা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আমি তার ওপর আরও একটা চাপ বাড়িয়ে দিতে চাই না। হ্যাঁ আমি ডিভোর্স ফাইল করে জোর করে প্রণয়ের থেকে অ্যালিমনি আদায় করে চাকরি-বাকরি করে জীবনটা আমি আবার নতুন করে হয়তো শুরু করতে পারতাম। কিন্তু তাতে বসুন্ধরা ভিলার মানুষগুলোর ভালোবাসা আমায় হারাতে হতো। আমার বাবার মৃত্যুর পর আমি যে আরও একটা বাপি পেয়েছি তাঁকে আমাকে হারাতে হতো। আমার ওতো মনের জোর নেই বাপি। তাই আমি এসব ছেড়ে যেতে চাই না।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৮: সকালবেলাই হাঁটতে হবে?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৩: ‘সুরের পরশে’ তুমি-ই যে শুকতারা

ধরো যদি আমার বিয়ে নাই বা হত তাহলে তো আমি থাকতাম একটা বাড়িতে। আমি নিজেকে সেভাবেই ভাবি। আমি বসুন্ধরা ভিলার একজন সদস্য। এখানে সকলে আমার আপনজন আর তার মধ্যে তুমি রয়েছো আমার বাপি। এই আমার কাছে অনেক।

আকস্মিক দুর্ঘটনায় তনুদাদার মৃত্যু বড় জেঠুমনি গগনকান্তি আর আমার বড় জেঠিমা আরতিকে ভেতর থেকে একেবারে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। দাদুর পর গোটা বসুন্ধরা গ্রুপ অফ কোম্পানিজের দুরূহ দায়িত্ব যে মানুষটা অক্লেশে সামলেছে। সে মানুষটা আচমকার শারীরিকভাবেও ভেঙ্গে পড়ল। হুড়োহুড়ি দৌড়দৌড়ি করে সারা ভারতবর্ষে ছুটে বেড়ানো মিটিং করা মানুষটার হার্ট-এ ব্লকেজ ধরা পড়ল। বড় জেঠিমা আরতি পুজো পাঠ এসব করতে ভালোবাসতেন। তনুদাদার বৌভাতের পরদিনই সকালবেলায় নতুন বর-কনেকে বড় জেঠিমা বাপের বাড়ি বেলেঘাটার রাসবাগানে রেবতী-বলদেবের মন্দিরে প্রণাম করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তনুদাদা চলে যাবার পর বড়জেঠিমা নিজেকে পুজোপাঠের আরও কঠিন অনুশাসনে বেঁধে ফেললেন। তাঁদের দুজনকে আগলে রাখতেন – বড়ছেলে চিনুদাদার বৌ সুপ্রিয়া বৌদি।

বাবলি আজকাল ফেসবুক করে না। অ্যাকাউন্ট একটা ছিল । কিন্তু লগ ইন আইডি আর পাসওয়ার্ড যে কি ছিল, সেটা মনে করতে করতেই বেশ খানিকটা সময় চলে গেল। প্রায় হাল ছেড়ে দেবার আগের মুহূর্তে ফেসবুক খুলে গেল – মোটামুটি এক বছর আগে ফেসবুকে শেষ দেখা গিয়েছিল বাবলিকে। এখনও কভার ফটোতে প্রণয়কান্তির সঙ্গে মালাবদলের ছবিটা দেওয়া আছে।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৭: জয়রামবাটির জগদ্ধাত্রীপুজো

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৫: মন বলে আমি মনের কথা জানি না!

প্রোফাইল ফটোতে রয়েছে সিঁদুরদানের পরমহুর্তে একসিঁথি সিঁদুর নিয়ে লজ্জাবস্ত্র মাথায় সলজ্জ মুখের বিগ ক্লোজ-আপ। এই একটা বছরে অনেক ওলটপালট হয়ে গেছে। এক বছর আগেও যা ছিল সুখস্মৃতি – আজ সেটা আর তা নয়। ফটো এ্যালবাম ওপেন ছিল। তাতে বোঝাই ছিল বিয়ের ছবি। এক বছর বাদে ফেসবুক খুলে প্রাথমিকভাবে অনেকগুলো কাজ করতে হলো বাবলিকে। বন্ধু খুব বেশি ছিল না বাড়ির লোকজনেরাই ফ্রেন্ডস লিস্টে ছিল। প্রণয় নিজে তাকে আনফলো করে দিয়েছে। সে করেনি। ফ্রেন্ডস লিস্টটা বাবলি হাইড করে দিল।

অ্যালবামটাও “অনলি মী” রেস্ট্রিকশনে বন্দী হল। বদলে গেল কভার ডিসপ্লে এবং প্রোফাইল পিকচার। তরুণকান্তির আঁকা একটা ছবি ছিল। খুব প্রশংসিত ছবি। পাশাপাশি তিন-চারটে মুখ। মাইম শিল্পীর সাদা রং মাখা মুখ জোকারের মজাদার রঙচঙে মুখ- বোরখা ঢাকা মহিলার মুখ মুখোশে ঢাকা মুখ কাপড়ে ঢাকা এক আতঙ্কবাদীর মুখ। ছবির ক্যাপশন ছিল ফেসেস আরাউন্ড মি। অনেক দামে ছবিটা একজন কিনতে চেয়েছিলেন তরুণ কান্তি বিক্রি করেননি। বাবলি জানে বাপি কেন এই ছবিটা এঁকেছিল। আশেপাশের মানুষদের মুখোশ ছিঁড়ে ফেলার জন্য এই ধারালো ছবিটা তাঁর স্টুডিওতে সাজানো আছে। প্রোফাইলের পুরোনো সিদুঁরপরা ছবি বদলে গিয়ে তরুণকান্তির সঙ্গে বাবলির একটা সুন্দর ছবি লাগিয়ে দিল। —চলবে।

সিঁদূরদান। ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-৪৭

জেএনইউ। প্রকাশজি। রক্তকরবী। বিশু পাগল। নন্দিনী। সিআর পার্ক। মনে পড়লে উত্তর দিস। তিনদিন পর উত্তর এসেছিল। তুই কলকাতার কোথায়? আমায় ফোনে মেসেজ করিস। একটা ফোন নাম্বার দেওয়া। যোগাযোগ হয়েছিল। তবে অরুনাভ এতদিন পরে প্রথম যোগাযোগটা টেলিফোনে করতে চায়নি। কোথায় দেখা হতে পারে জানতে চেয়েছিল।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

Skip to content