দেবানন্দ পরিচালিত ‘স্বামী দাদা’ ছবির আনজান-এর লেখা ‘এক রূপ কই নাম’ গানটিতে ভক্তিগীতির ধাঁচে সুরারোপ করেন পঞ্চম। দেবানন্দের লিপে গানটি পরিবেশিত করেন কিশোর। সুরের নিরিখে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের কি নিদারুণ এক মেলবন্ধন খুজে পাওয়া যায় এই গানটিতে। গানের মূল বিষয় হল ‘ঈশ্বর এক’। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ তাঁকে যতই ভিন্ন নামে ডাকুক, তিনি এক। অর্থাৎ, গানটির মাধ্যমে ঈশ্বরবন্দনা করা হচ্ছে।
খেয়াল করবেন, যে সুরে সাজানো হয়েছে গানটি এবং যে ছন্দ ব্যবহার করা হয়েছে তাতে শুধু একটি করতাল হলেই গানটি সহজেই গেয়ে ফেলা যায়। তবু সেই ছন্দে পঞ্চম এমন কিছু বাদ্যযন্ত্রকে কাজে লাগিয়েছেন, সেটি গানের অংশেই হোক অথবা ইন্টার লুডে, তাতে গানটি একটি অন্য মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে। একটি ইন্টারলুডে পাওয়া যায় পাশ্চাত্যের ছোঁয়া। ঠিক যেন কিঞ্চিৎ স্বাদ বদল। আর কিশোর? তিনি যে এক এবং অদ্বিতীয়! এই কণ্ঠ যে অনির্বাণ! কি অসাধারণ গেয়েছেন তিনি গানটি। গানটির শেষ অন্তরার একটি পংক্তি যেন একটু বেশিমাত্রায় মনকে নাড়া দিয়ে যায়। পংক্তিটি হল ‘জো কর্ময়োগী হ্যায় কর্ম সে ইয়াদ আয়েঙ্গে’। কে বলতে পারে, আনজান সাহেব হয়তো এটি কিশোর এবং পঞ্চমের উদ্দেশ্যেই লিখেছিলেন। আজ এই দুই ক্ষণজন্মার ক্ষেত্রেই কথাটি একশো ভাগ প্রযোজ্য।
আরও পড়ুন:
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩৯: দিলবর মেরে কব তক মুঝে…
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৫: সুন্দরবনে বসন্ত রোগের দেবতা বসন্ত রায়
‘জিন্দেগি ইয়ে ক্যায়সি হ্যায়’ গানটি একটু আলাদা, কেন জানেন? গানটি শুরু হয় একটি পার্টি সং-এর ছন্দকে আশ্রয় করে। পঞ্চমের সেই চিরাচরিত আপ-টেম্পো রিদম। সেই রিদমের তালে তাল মিলিয়ে আশা ভোঁসলে এবং অমিত কুমার নিজেদের কণ্ঠ দিয়ে যথাযত ভাবে সাজিয়ে তোলেন গানটিকে। কিন্তু গানটির একটি অংশে আকস্মিক ভাবে ছন্দের পরিবর্তন ঘটে। টেম্পো কমে আসে অনেকাংশেই। দেবানন্দের লিপে গেয়ে ওঠেন কিশোর। করতালের অনুকরণে বেজে চলা পরকাশন কানে ধরা দেয়। প্রবাদপ্রতিম কিশোর কুমার তাঁর কণ্ঠের ইন্দ্রজালে ঘিরে রাখেন আমাদের। কি অভাবনীয় উপস্থাপনা।
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৮: সকালবেলাই হাঁটতে হবে?
গৃহিণীদের মধ্যে বইয়ের নেশা বাড়াতে কাঁধে ঝোলা নিয়ে ঘুরে বেড়ান রাধা, ‘চলমান পাঠাগার’ তাঁর পরিচয়!
বন্ধু আমজাদ খান নির্দেশিত ‘অধুরা আদমি’ ছবিতে যোগেশের লেখায় সুর করেন পঞ্চম। ‘তুমসে হি তো শুরু’ গানটির জন্য তাঁর লতাদিদিকে বেছে নেন পঞ্চম। তাই, সুরের কাঠামো এবং প্রবাহ দুটোই এমন, যা কিনা লতা মঙ্গেশকরের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। একটি মন ভালো করে দেওয়া মজার গান শুনতে চাইছেন? তাহলে শুনে নিন এই ছবির ‘জানি তুম হাসিন হো’ গানটি। যেমন মেলোডি, তেমন ছন্দ। কোরাস এর মূর্ছনা এবং সর্বোপরি পঞ্চম-জায়ার মিষ্টি কণ্ঠ।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৫: মন বলে আমি মনের কথা জানি না!
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৬: মোমো চিত্তে!
রমেশ সিপ্পি নির্দেশিত ‘শক্তি’ ছবির ‘জানে ক্যায়সে কব কাঁহা’ গানটি আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন। আনন্দ বক্সীর লেখায় পঞ্চমের সুর দেওয়া এই গানটি যদি প্রথম থেকে শেষ অবধি আমরা শুনি, দেখতে পাবো একই গানে কীভাবে ছন্দের পরিবর্তন ঘটিয়ে সেটিকে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে। মুখরার এক রকম ছন্দ। অন্তরার ভিন্ন এক ছন্দ। একই গানে সুর এবং ছন্দের এই বৈচিত্র্যগুলিই হয়তো পঞ্চমের সৃষ্টিগুলিকে একটু আলাদা করে রাখে।
যেমন অশান্তি ছবির ‘দিল দিয়া হ্যায়’ গানটি। এটিও আনন্দ বক্সীর কলম থেকে বেরিয়ে আসা একটি গান। একটি পার্টির দৃশ্যে কানওয়ালজিৎ এবং জিনাত আমানকে দেখা যাচ্ছে। আর তাই এই জুটির জন্য পঞ্চম বেছে নেন আশা এবং অমিত কুমারকে। শুধু তাই নয়, ইন্টারলুডে আবারও পাবেন সেই বৈচিত্রের ছোঁয়া।
যেমন অশান্তি ছবির ‘দিল দিয়া হ্যায়’ গানটি। এটিও আনন্দ বক্সীর কলম থেকে বেরিয়ে আসা একটি গান। একটি পার্টির দৃশ্যে কানওয়ালজিৎ এবং জিনাত আমানকে দেখা যাচ্ছে। আর তাই এই জুটির জন্য পঞ্চম বেছে নেন আশা এবং অমিত কুমারকে। শুধু তাই নয়, ইন্টারলুডে আবারও পাবেন সেই বৈচিত্রের ছোঁয়া।
ভাবতে অবাক লাগে যে একসঙ্গে অনেকগুলি বিষয়কে মাথায় রেখে তাঁর সুরসৃষ্টির যে প্রক্রিয়া অথবা ভবনা, কীভাবে সম্ভব হতো। কী করে পারতেন তিনি! তাঁর ঘনিষ্ঠ অথবা সতীর্থদের কাছ থেকে যেটুকু জানা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব অল্প সময়েই তিনি তৈরি করে ফেলতেন সুরের কাঠামো। শুধু লেখা নিয়ে বসার দেরি। প্রতিভা এবং সঙ্গীতের অগাধ জ্ঞানের পাশাপাশি পঞ্চমের যেটি ছিল তা হল, এক অদ্ভুত খুঁতখুঁতেমি। তিনি স্বয়ং ছিলেন তাঁর সৃষ্টির প্রধান সমালোচক। তাই হয়তো অগুন্তি কালজয়ী সুরের স্রষ্টা তিনি। —চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।