সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


ব্যাঘ্রবাহিনী নারায়ণী মূর্তি, চুপরিঝাড়া গ্রামে, জয়নগর-২ ব্লকে (বাঁ দিকে)। নারায়ণী দেবী, মগরাহাট-২ নং ব্লকের মৌখালিতে (মাঝখানে)। নারায়ণী দেবী, ফলতা নারায়ণী গ্রামে (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।

মুন্সি বয়নুদ্দিন রচিত মুসলমানি কেচ্ছা ‘বনবিবি জহুরানামা’ (১৮৭৮) থেকে জানা যায় মক্কা থেকে বনবিবি খোদাতাল্লার হুকুমে এসেছিলেন ভাটির দেশে অর্থাৎ সুন্দরবনে। যদিও এই কেচ্ছার মূল উদ্দেশ্য হল বনবিবির মাহাত্ম্য প্রচারের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটানো। তবুও এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। বনবিবি যখন সুন্দরবনে এলেন তখন সুন্দরবনের একচ্ছত্র অধিপতি হলেন দক্ষিণ রায়। বনবিবির উদ্দেশ্য জানতে তিনি বন্ধু সনাতন রায়কে পাঠালেন খোঁজখবর নিতে। সনাতন ফিরে এসে যা বলল তাতে বিপদ আঁচ করলেন দক্ষিণ রায়। তখন তিনি বনবিবির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিলেন। এই সংবাদ পেয়ে দক্ষিণ রায়ের মা নারায়ণী পুত্রকে বললেন যে নারীর বিরুদ্ধে নারীর লড়াই হওয়া উচিত। তাই নারায়ণী সৈন্যসামন্ত নিয়ে চললেন বনবিবির বিরুদ্ধে যুদ্ধে। প্রবল যুদ্ধ হতে লাগল। কেউ কাউকে পরাস্ত করতে পারছে না। তখন বনবিবি যুদ্ধ জেতার জন্য মা বরকতকে স্মরণ করলেন। আর তখনই মা বরকতের আশীর্বাদে বনবিবি ভূপতিত করলেন নারায়ণীকে। ‘বনবিবি জহুরানামা’-তে ‘বনবিবি ও নারায়ণী জঙ্গ’ নামেক অধ্যায়ে এই কাহিনি বর্ণিত আছে—

“তুমি থাক আমি যাই, হারি জিতি ক্ষতি নাই,
আওরতে আওরতে লড়া ভাল।
নারায়ণী ইহা বলে, দেও-দানা লিয়ে চলে,
সেনা শিষ্য যত তার ছিল।।
সারাদিন জঙ্গ চলে, কেহ কারে নাহি পারে,
বোনবিবি বিপাক দেখিয়া।
মা বরকত বলে ডাকে, উদ্ধারিয়া লেহ মোকে,
নারায়ণী ডালিল মারিয়া।।”
বনবিবি পরাস্ত নারায়ণীর বুকের উপরে বসে চুল ধরে মাটিতে ঠুকতে লাগলেন, গলা কাটতে উদ্যত হলেন। নারায়ণী ভয় পেয়ে বনবিবির দু’পা ধরে প্রাণভিক্ষা চাইলেন এবং তাঁকে ‘সই’ বলে সম্বোধন করলেন।

“দাবাইয়া বৈসে বুকে, চুলে ধরে ছের্‌ ঠোকে,
খুন্তি ফের দিতে চায় গলে।
নারায়ণী দেখে ডরে, বিবীর দুই পাও ধরে,
কহে বাত সই সই বলে।।”
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৩: সুন্দরবনে কুমিরের দেবতা কালু রায়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব ৪৭: শীতকালে দই খেতে নেই?

এতে বনবিবি খুশি হলেন এবং নারায়ণীর সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করলেন। আঠারো ভাটির দেশ অর্থাৎ সমগ্র সুন্দরবন অঞ্চল দু’জনে ভাগাভাগি করে নেবেন—এই চুক্তি করলেন।

“বোনবিবি বলে সই শুন দেল দিয়া।
সকলে আঠার ভাটি লইব বাটিয়া।।”
সেইমতো বনবিবি ও নারায়ণী তথা দক্ষিণ রায়ের সঙ্গে সুন্দরবনের এলাকা ভাগাভাগি হয়ে গেল। কিন্তু বঙ্গদেশে মুসলিম প্রভাবের ফলে সুন্দরবনবাসীর মধ্যে অরণ্যদেবী হিসেবে বনবিবির গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। ফলে অরণ্যদেবী নারায়ণীর প্রভাব প্রতিপত্তি দিনে দিনে কমে আসে। কিন্তু একসময় যে নারায়ণীর প্রভাব সুন্দরবনে যথেষ্ট বেশি ছিল তার প্রমাণস্বরূপ সুন্দরবন তথা দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এখনও বহু স্থানে নারায়ণীর প্রাচীন মন্দির বা থান দেখা যায়। এইসব থানের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হল মথুরাপুর-২ নং ব্লকের অন্তর্গত খাড়ি গ্রামে নারায়ণী দেবীর থান। সম্ভবত পাল যুগে এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল।

প্রাচীন মন্দিরটি প্রায় ধ্বংসের পথে। লুপ্ত নদী আদিগঙ্গা এখান দিয়ে প্রবাহিত হত। সেই নদীর খাড়ি অঞ্চল পাল ও সেন যুগে অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছিল। সেই থেকেই এই অঞ্চলের নাম খাড়ি। সেই সমৃদ্ধ অঞ্চলে অরণ্যদেবী নারায়ণীর প্রভাব প্রতিপত্তি যে বেশি হবে সে আর নতুন কথা কী! তাছাড়া নারায়ণী দেবীর নামে স্থানের নাম (যেমন জয়নগর-২ নং ব্লকে নারায়ণীতলা, ফলতা ব্লকে নারায়ণী, সাগর ব্লকে নারায়ণী আবাদ ইত্যাদি গ্রাম) রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার নানা স্থানে। এইসব এলাকায় সুদূর অতীতে নারায়ণী দেবীর নিশ্চিত প্রভাব ছিল।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫২: সব ঘরই ‘তাসের ঘর’

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৫: দিল মেরা বানজারা!

এই নারায়ণী দেবী কিন্তু পৌরাণিক দেবতা বিষ্ণুর পত্নী নারায়ণী নন। ইনি হলেন সুন্দরবনের লৌকিক দেবী। সুতরাং সুদূর অতীতে যে এঁর মানবী মূর্তি ছিল না তা নিশ্চিত করে বলা যায়। হয়তো কোনও প্রস্তর খণ্ড বা কোনও মাটির ঢেলা বা কোনও মনুষ্যেতর প্রাণী হিসেবে তিনি পূজিত হতেন। হয়তো তখন তাঁর এই নামই ছিল না। কিন্তু এর সপক্ষে তেমন কোনও প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। তবে প্রাচীন অনার্য সমাজের রীতি অনুযায়ী বারামূর্তি বা মুন্ডমূর্তির পূজা নারায়ণী দেবীর ক্ষেত্রেও দেখা যায়। পৌষ সংক্রান্তিতে বা পয়লা মাঘ জোড়া বারামূর্তিতে নারায়ণীর পুজো হয়।
একটি মূর্তি পুরুষ ও অপরটি নারী হওয়ায় লোকে মনে করে পুরুষ মূর্তিটি হল দক্ষিণ রায় এবং নারী মূর্তিটি হল নারায়ণী। তবে যে মূর্তিটিকে নারী হিসেবে ধারণা করা হয় তার মুখের দু’পাশে গালপাট্টা আঁকার কারণ কী তা বোধগম্য নয়। স্ত্রীলোকের গালপাট্টা থাকার কথা নয়। সুতরাং আসলে জোড়া বারা মূর্তি দুই পুরুষ দেবতার কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ আছে। যাইহোক, জঙ্গলের মধ্যে মশাল জ্বালিয়ে ও ঢাক-ঢোল বাজিয়ে ধূমধাম সহকারে জোড়া বারা মূর্তির পূজা হয়। নৈবেদ্য হিসেবে মদ ও মাংস দেওয়া হয়। তবে বর্তমানে এভাবে নারায়ণী ও দক্ষিণ রায়ের জোড়া বারা মূর্তির পূজাপদ্ধতি অতি বিরল।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২১: শ্রীমার ঠাকুরের প্রতি যত্ন

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১৩: অদ্বিতীয় সম্রাট

বর্তমান নারায়ণী দেবীর রূপ অনেকটা জগদ্ধাত্রী দেবীর মতো। মাথায় মুকুট, এলোকেশী, ত্রিনয়নী ও চতুর্ভূজা। তাঁর চারটি হাতে রয়েছে শঙ্খ, চক্র, পদ্ম ও দন্ড বা শলাকা। গায়ের রঙ রক্ত-হরিদ্রাভ এবং পরণে রক্তাভ শাড়ি। অধিকাংশ স্থানে তাঁর বাহন সিংহ। তবে কোথাও কোথাও বাহন হিসেবে বাঘ দেখা যায়। সুন্দরবনে সিংহ কোনওকালেই ছিল না। সুতরাং নারায়ণী দেবীর বাহন সিংহ হওয়া উচিত ছিল না। সম্ভবত পৌরাণিক দেবদেবীদের প্রভাবে নারায়ণীর এই পরিবর্তন। আর এই প্রভাব যে অতি প্রবল তার প্রমাণ হল বর্তমানে অধিকাংশ থানে বর্ণ ব্রাহ্মণরাই এঁর পুজো করেন। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার এবং পূর্ণিমায় এঁর পুজো হয়। একমাত্র খাড়ির মন্দিরে নিত্যপূজা হয়।

জয়নগর-২ ব্লকে চুপরিঝাড়া গ্রামে নারায়ণী মন্দির (বাঁ দিকে)। বাংলার প্রাচীনতম খাড়ি নারায়ণী মন্দিরে প্রতিমা (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নারায়ণী (হয়তো ভিন্ন নামে) আদিতে লৌকিক দেবী থাকলেও পরে তান্ত্রিক দেবীতে পরিণত হন। কারণ তান্ত্রিক দেবদেবীদের তালিকায় যেমন নারায়ণীর নাম রয়েছে, তেমনই চৌষট্টি তান্ত্রিক পীঠের মধ্যে খাড়ি গ্রামের নামও রয়েছে। কিন্তু একাদশ শতাব্দীতে সেনযুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাবে তান্ত্রিক দেবী নারায়ণীর আর্যীকরণ ঘটে। তাই অবয়বে ও পূজা পদ্ধতিতে নারায়ণী দেবী বর্তমানে প্রায় পৌরাণিক দেবীতে পর্যবসিত হয়েছেন।—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content