রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


১৭ বছর বয়সে হ্যাক করেছিলেন আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ওয়েবসাইট।

আমেরিকার ফ্লরিডার জোনাথন জেমস্ নামে এক হ্যাকার ১৭ বছর বয়সে হ্যাক করেছিলেন আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ওয়েবসাইট। মাত্র ২৪ বছর বয়সে আত্মঘাতী হন তিনি। কিন্তু এত অল্প বয়সে তাঁর জীবনচরিত গাঁথা হলেও জোনাথনের জীবনগাথা যে কোনও রহস্য-রোমাঞ্চের ছবিকে এক লহমায় হার মানিয়ে দিতে পারে।

জোনাথনের পুরো নাম জোনাথন জোসেফ জেমস। ১৯৮৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ফ্লরিডার পাইনক্রেস্টে জন্ম হয় তাঁর। ছোট থেকেই জোনাথনের অমোঘ আকর্ষণ ছিল কম্পিউটার এবং কম্পিউটারের যাবতীয় যন্ত্রাংশের প্রতি। জোনাথনই ছিলেন আমেরিকার প্রথম কিশোর হ্যাকার, যাঁকে সাইবার অপরাধের জন্য জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জোনাথনের দাবি ছিল, তিনি এথিক্যাল হ্যাকার (যাঁরা ভাল কাজের জন্য নিজেদের হ্যাকিং বিদ্যাকে কাজে লাগান) হিসাবে কাজ করতেন। তবে জানা যায়, প্রথম থেকেই এথিক্যাল হ্যাকিং করতেন না জোনাথন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি প্রথম সাইবার অপরাধ করেন। আর এই অপ্রাধের জন্য প্রথম তাঁকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয় ১৬ বছর বয়সে।
২৩ আগস্ট, ১৯৯৯ এবং ২৭ অক্টোবর, ১৯৯৯ সালের বেলসাউথ এবং মিয়ামি ডেড স্কুলের ওয়েবসাইট-সহ একাধিক ওয়েবসাইট হ্যাক করেন জোনাথন। আর এর মাধ্যমেই আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলির লক্ষ্য করে যে কম বয়সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের একটি বিভাগ ডিফেন্স থ্রেট রিডাকশন এজেন্সি (ডিটিআরএ)-এর কম্পিউটারগুলিতে তিনি অনায়াসে ধুকে পড়েন।
এই ওয়েবসাইটকে জোনাথন হ্যাকিং করবে বলে হুমকি দিয়েছিল, একথা আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার আধিকারিকরা তখন মনে করেছিলেন। তাই আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার ওপরমহল থেকে নির্দেশ আসে জোনাথনের অজান্তেই তাঁর উপর কড়া নজরদারি চালানোর জন্য ।এর মধ্যেই আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের একটি বিভাগ ‘ডিফেন্স থ্রেট রিডাকশন এজেন্সি (ডিটিআরএ)’-এর ওয়েবসাইটে উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেন জোনাথন। জোনাথনের ১৫ বছর বয়সেই তাঁর কার্যকলাপই তাঁকে সবচেয়ে বড় হ্যাকারের খেতাব দিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন:

এই ভূতুড়ে দ্বীপে তিনিই একমাত্র মহিলা, দিন কাটে দাগি অপরাধীদের সঙ্গে, ‘দ্বীপের রানি’র কেন এমন সিদ্ধান্ত?

অন্ত্যজ ও দেশজযাপনে দ্রৌপদী

গোয়েন্দারা এটা বুঝতে পেরে জোনাথনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করেন। জেমস পরে গোয়েন্দা বিভাগের কাছে স্বীকার করেন যে, তিনি ভার্জিনিয়ার ডুলেসের একটি কম্পিউটারে একটি অবৈধ সিস্টেম ব্যবহার করেছেন এবং এর সাহায্যেই তিনি ডিটিআরএ কর্মীদের কাছে আসা তিন হাজারেরও বেশি বার্তা অনায়াসেই দেখতে পারতেন। পাশাপাশি তিনি ডিটিআরএ-র ১০টি কম্পিউটারে নজরদারি চালাচ্ছিলেন বলেও স্বীকার করে নেন।এ বার নাসা জোনাথনের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করতে ময়দানে নামে । নাসা দাবি করে, জোনাথন যে সফটওয়্যার ব্যবহার করছে, তা নাসার আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপাদানকে নিয়ন্ত্রণ করত। ওই সফটওয়্যার আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা অন্যান্য ভৌত পরিবেশও নিয়ন্ত্রণ করত বলেও নাসার দাবি করে থাকে।
২০০০ সালের ২৬ জানুয়ারি জোনাথনের বাড়িতে হানা দেয় প্রতিরক্ষা বিভাগ, নাসা এবং পাইনক্রেস্ট পুলিশ বিভাগের আধিকারিকরা। এই ছোট বয়সেই তিনি আমেরিকার সরকারকে বিনাশ করার শক্তি অর্জন করে নেন। জোনাথনের কাছে আমেরিকা সরকারের বেশিরভাগ ডেটাবেস পর্যন্ত তাঁর জানা ছিল। এমনকি রক্ষাবিভাগ নাসা-এর নেটওয়ার্ক-ও তার আয়ত্রের বাইরে ছিল না। জোনাথন নাসার স্টেশন থেকে মহাকাশ স্টেশন সঞ্চালক পর্যন্ত প্রায় সমস্ত তথ্য বের করে ফেলেন। যার মুল্য ছিল ১৭ লাখ ডলারের মত। পরে নাসা কোনও উপায় না পেয়ে তাদের নেটওয়ার্ককে ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এই জন্য জোনাথনকে ইন্টারনেট দুনিয়ার কমান্ডারও বলা হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫২: সব ঘরই ‘তাসের ঘর’

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৩: সুন্দরবনে কুমিরের দেবতা কালু রায়

জেমসের বাড়িতে ২৬ জানুয়ারি, ২০০০-এ অভিযান চালান প্রতিরক্ষা বিভাগ, নাসা এবং পাইনক্রেস্ট পুলিশ বিভাগের এজেন্টরা। ছয় মাস পরে জেমসকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত করা হয়। ২১ সেপ্টেম্বর, ২০০০-এ, তিনি মার্কিন অ্যাটর্নি গাই লুইসের সঙ্গে একটি চুক্তিতে প্রবেশ করেন। তিনি একটি মৃদু শাস্তির বিনিময়ে কিশোর অপরাধের দুটি গণনার জন্য দোষী সাব্যস্ত করেন।

জেমসকে আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত সাত মাসের গৃহবন্দি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য শাস্তি দেওয়া হয়েছিল এবং তাঁকে নাসা এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের কাছে ক্ষমা চাওয়ার চিঠি লিখতে হয়েছিল। এমনকি, তাঁকে বিনোদনমূলক উদ্দেশ্যে কম্পিউটার ব্যবহার করা থেকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। জেমস পরবর্তীতে সেই পরীক্ষা লঙ্ঘন করেন যখন তিনি ড্রাগ ব্যবহারের জন্য ইতিবাচক পরীক্ষা করেন এবং পরবর্তীকালে তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্শাল সার্ভিস দ্বারা হেফাজতে নেওয়া হয় এবং আলাবামা ফেডারেল সংশোধনী সুবিধায় নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তিনি শেষ পর্যন্ত ছয় মাস দায়িত্ব পালন করেন।
তবে সেই চুক্তিভঙ্গ করার এবং মাদক সেবন করার অভিযোগে তাঁকে শেষ পর্যন্ত ছয় মাসের জেলের সাজা শোনানো হয়। সেখানে এ-ও উল্লেখ করা হয়েছিল যে, জোনাথন যদি প্রাপ্তবয়ল্ক হতেন তা হলে তাঁর অপরাধের জন্য অন্ততপক্ষে ১০ বছরের সাজা দেওয়া হত। জেল থেকে বেরিয়ে খানিক মুষড়ে পড়েছিলেন জোনাথন। মাঝেমধ্যে মাদকও সেবন করতে শুরু করেন তিনি। কিন্তু হ্যাকিং থেকে নিজেকে দূরেই রেখেছিলেন তিনি।

২০০৮ সালের ১৭ জানুয়ারি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর টিজেএক্স-এর কম্পিউটার হ্যাক হয়ে লক্ষ লক্ষ গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়ে যায়।হ্যাকারদের এই একই চক্র বোস্টন মার্কেট, বার্নস অ্যান্ড নোবেল, স্পোর্টস অথরিটি, ফরএভার ২১, ডিএসডব্লু, অফিসম্যাক্স এবং ডেভ অ্যান্ড বাস্টারস-এর মতো সংস্থার ওয়েবসাইটও হ্যাক করা হয়।এই হ্যাকারদের দলের পান্ডা অ্যালবার্ট গঞ্জালেজ হ্যাকিং করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছিলেন। অ্যালবার্টের দলে কয়েক জন সদস্য ছিলেন যাঁরা জোনাথনের বন্ধু এবং পূর্বপরিচিত।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৬: বুকে ব্যথা মানেই কি গ্যাসের ব্যথা? হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ না কি গ্যাসের ব্যথা, বুঝবেন কী ভাবে?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৩: বাড়ির কাজের লোককে নিজের সম্পত্তির অধিকার দিতে দ্বিজেন্দ্রনাথ দলিল পাল্টেছিলেন

ফলে অপরাধীকে খুঁজতে খুঁজতে আবার জোনাথনের সন্ধান করেন গোয়েন্দা সংস্থার আধিকারিকরা। এমনকি, জোনাথনের পাশাপাশি তাঁর ভাই এবং তাঁর বান্ধবীর বাড়িতেও অভিযান চালান সরকারি আধিকারিকরা। অনেক খুঁজেও ওই হ্যাকারদের দলের সঙ্গে জোনাথনের কোনও যোগসাজশ খুঁজে বার করতে পারেননি গোয়েন্দারা। তবে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ চালাতেই থাকেন ।এর পর ২০০৮ সালের ১৮ মে জোনাথনকে তার ঝরনার মধ্যে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। ময়নাতদন্ত করলে জানা যায় যে মাথায় গুলি করে আত্মঘাতী হন তিনি। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ২৪।

জেমসকে আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত সাত মাসের গৃহবন্দি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।

জোনাথনের দেহের পাশ থেকে একটি সুইসাইড নোটও উদ্ধার করা হয়। সেই সুইসাইড নোটে লেখা ছিল, ‘‘আমি সত্যিই টিজেএক্স-এর কম্পিউটার হ্যাক করিনি। কিন্তু তবুও আমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে ওরা। বিচারব্যবস্থার ওপর আমার কোনও আস্থা নেই। সম্ভবত আমার এই চিঠি জনসাধারণের কাছে একটি শক্তিশালী বার্তা হিসাবে যাবে। যে ভাবেই হোক, আমি এখন পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি। নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার এটাই আমার একমাত্র উপায়। পরে অবশ্য জোনাথনের বাবা দাবি করেন, জেল থেকে বেরোনোর পর থেকেই ক্রমাগত অবসাদে ভুগছিলেন জোনাথন। এর আগেও বার কয়েক তিনি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। পরে অবশ্য তদন্ত চালিয়ে গোয়েন্দারা মূল চক্রী অ্যালবার্টকে গ্রেফতার করতে পারে।
* অজানার সন্ধানে (Unknown story): ড. সঞ্চিতা কুণ্ডু (Sanchita Kundu) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, হুগলি মহসিন কলেজ।

Skip to content