চেন্নাইয়ের অলন্ডুর মন্দিরের দ্রৌপদী আম্মান এবং তামিলনাড়ুর অরভিলের কাছে এক মন্দিরে শায়িত দ্রৌপদীর মূর্তি।
মহাভারতের বহু পর্বে ধ্বনিত হয়েছে যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ—এই বিখ্যাত বাণী, কিন্তু সব ক্ষেত্রে ধর্ম রক্ষিত হয়নি। যেমন দ্রৌপদীর বিবাহের ক্ষেত্র। স্বয়ং ব্যাসদেবের দান করা দিব্যদৃষ্টিতে রাজা দ্রুপদ দেখলেন ইন্দ্রের জন্মান্তরস্বরূপ পাণ্ডবদের আর স্বর্গলক্ষীরূপে দ্রৌপদীকে। শুনলেন সেই ক্ষীণকোটি কন্যার গল্প যিনি দেবাদিদেবের কাছে— ‘আমাকে উপযুক্ত স্বামী দাও’, পাঁচবার বলায় মহাদেব তাঁকে তাঁর জন্মান্তরে পাঁচ স্বামী হবে বলে বর দিয়েছিলেন। দ্রুপদ ব্যাসের নির্দেশে জানলেন, সেই কন্যাই এই জন্মে যজ্ঞাগ্নি থেকে জন্ম নেওয়া তাঁর কন্যা দ্রৌপদী। যিনি ক্ষত্রিয়দের ধ্বংস করার জন্য আবির্ভূতা হয়েছেন। জন্মান্তরীণ সংস্কারের মতো বিবাহবন্ধনও জন্মান্তর প্রভাবিত বোঝানোর কতই না চেষ্টা!
এই বিবাহের সমর্থনে নানা মুনির নানা মতে এসে পড়ে পাণ্ডবদের পিতৃপরিচয় প্রসঙ্গ। মাদ্রীর পুত্র নকুল ও সহদেবের পিতা ছিলেন শতশৃঙ্গ পর্বতের এক বা একাধিক অনার্য পুরুষ, তাই পঞ্চপাণ্ডবের রক্তধারায় আর্য-অনার্য সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটায় সেই বিবাহ অনার্য-অন্ত্যজ আড়ালে সমর্থিত। অথচ উপমহাদেশের অন্ত্যজ শ্রেণির মধ্যে কিংবা প্রাক-বৈদিক যুগে নারীর বহু বিবাহের দৃষ্টান্ত বিরল। জটিলা, বার্ক্ষী প্রমুখ প্রাচীনাদের বহুবিবাহের প্রেক্ষিত ছিল ভিন্ন। ওদিকে মূল মহাভারতের সভাপর্বে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের চেষ্টায় ভীমসেনের দ্বারা দুঃশাসনের রক্তপানের প্রতিজ্ঞা আর সেই রক্তের প্রলেপ না দেওয়া পর্যন্ত মুক্তকেশী দ্রৌপদীর প্রত্যয়, আজও গাড়োয়াল হিমালয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে তাঁদের আদ্যশ্রাদ্ধে অনুষ্ঠিত এক প্রথা রূপে বহমান।
আরও পড়ুন:
যে উপদেশ গিয়েছি ভুলে…/২
ঠাকুরবাড়ির বিজয়া, রবীন্দ্রনাথের বিজয়া
জনপ্রিয় এই প্রথার নাম ‘পাণ্ডবলীলা’। এই অনুষ্ঠানে শোকগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা পঞ্চপাণ্ডব এবং দ্রৌপদীরূপে অভিনয় করেন। সাধারণত দ্রৌপদীর চরিত্রে অভিনয় করেন পরিবারের পুত্রবধূ। দ্রৌপদীর রক্তলিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য আজও সেই পুত্রবধূদের বন্য পশুর রক্ত দেওয়া হয় পানের জন্য। এখানে লক্ষ্যণীয় পাঞ্চালীর মতো ইন্দো-ইউরোপীয় চরিত্র আজও দেশজযাপনে অনুসরণীয়া হয়ে আছেন। অথচ ভারতবর্ষের দক্ষিণ প্রান্তে মহাভারতের এই মহিয়সী দেবীরূপে, রক্ষাকর্ত্রীরূপে পূজিতা হন। দক্ষিণ ভারতে মাতৃপূজা বহুল প্রচলিত। সেখানে অঞ্চল ভেদে দেবীর রূপ ভিন্ন এবং স্থানীয় দেবী প্রাধান্য পান।
মহাভারতের তেলেগু অতিকথনে দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম দ্রৌপদীর অত্যধিক শারীরিক বাসনা পূরণে অসমর্থ হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে জানান। এইসময় তিনি দ্রৌপদীর বিশ্বরূপ দেখে বিস্মিত হন। এই কথনে এমনও মান্যতা আছে যে, বনবাসে থাকাকালীন দ্রৌপদী তাঁর স্বামীদের ছেড়ে প্রতিরাতে বন্য পশু এবং শবদেহ ভক্ষণের জন্য বেরোতেন। তামিল বলয়ের জনশ্রুতিতে দ্রৌপদীর বিশ্বরূপ সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণ পঞ্চপাণ্ডবকে সাবধানবাণী শুনিয়েছিলেন কারণ দ্রৌপদীর ক্ষুধা চরিতার্থ না হলে তিনি পাণ্ডবদের গ্রাস করতে পারেন। এই জনশ্রুতিতে আরও বলা হয় যে এমতাবস্থায় পাণ্ডবরা প্রাণে বাঁচার জন্য নিজেদের কুটিরে আবদ্ধ করতেন।
আরও পড়ুন:
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৪: একটু হোক-ফোক!
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫২: সব ঘরই ‘তাসের ঘর’
অন্য কথনে বনবাসে থাকাকালীন দ্রৌপদীকে বীরপাঞ্চালীও বলা হত। তাঁর এই রূপ পাণ্ডবদের দস্যু, রাক্ষসদের হাত থেকে রক্ষা করতো। তামিলনাড়ুর উত্তরে বিশেষত ভেলোর অঞ্চলের লোকবিশ্বাস অনুযায়ী তিনি কালী, অঘোরী, আম্মানপাঞ্চালী অথবা দ্রৌপদীআম্মান রূপে পূজিতা হন। উত্তরভারতের কোনও বড় উৎসব মহাভারত প্রভাবিত না হলেও মূল চরিত্রদের মধ্যে অন্যতম দ্রৌপদী অন্ত্যজ ও দেশজযাপনে চিরস্মরণীয়া হয়ে আছেন।
পঞ্চপাণ্ডব, দ্রৌপদী এবং শ্রীকৃষ্ণের প্রতি উৎসর্গীকৃত ব্যাঙ্গালোরের ধর্মরায় স্বামী মন্দির।
ঋণস্বীকার
মিভ হ্যুগস
সুখময় ভট্টাচার্য
বুদ্ধদেব বসু
অ্যালফ হিল্টবিটল
ছবি সৌজন্য: রাজা রবি বর্মা ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
মিভ হ্যুগস
সুখময় ভট্টাচার্য
বুদ্ধদেব বসু
অ্যালফ হিল্টবিটল
ছবি সৌজন্য: রাজা রবি বর্মা ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
* লেখিকা পরিচিতি: ড. বিদিশা মিশ্র বিগত চৌদ্দ বছর ধরে সরকারি কলেজে, বর্তমানে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বিষয়— সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রী বিদিশা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় হন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল —বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের গ্রন্থ ‘কাব্যবিলাস’। তাঁর এই গবেষণা ২০২১ সালে কর্ণাটকের আইএনএসসি পাবলিশিং হাউস থেকে ‘দ্য কাব্যবিলাস অফ চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য — এ ক্রিটিক্যাল স্টাডি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্রগুলি প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তাঁর তত্ত্বাবধানে একাধিক স্কলার গবেষণারত। বিভিন্ন সরকারি কাজকর্ম ও অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি গুরুজি বিপ্লব মুখোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল ও রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী জয়শ্রী দাসের কাছে রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষারতা। ভ্রমণপিপাসু বিদিশা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরেছেন, সেইসব অভিজ্ঞতা তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে বলে তিনি মনে করেন।