অলঙ্করণ: লেখক।
“আসেন। আপনাগোরে লইয়া যাইবার কথা বাবু কইছেন। কিন্তু মুস্কিল হইছে—”
বুঝিলাম ইনিই মুস্কিল মিঞা। ব্যোমকেশ বলিল—“মুস্কিল কিসের?”
মুস্কিল বলিল—“রসিকবাবুর-ও এই টেরেনে আওনের কথা। তা তিনি আইলেন না। পরের টেরেনের জৈন্য সবুর করতি হইব। তা বাবু মশায়রা গাড়ির মধ্যে বসেন।”…
ব্যোমকেশ বলিল—“আজই ফিরব।—তুমি মুস্কিল মিঞা?”
মুস্কিল মুখ মুচকাইয়া বলিল—‘নাম তো কর্তা সৈয়দ নুরুদ্দিন। কিন্তু মুস্কিল হইছে বাবুরা আদর কৈরা মুস্কিল মিঞা ডাকেন।”
“এ আর মুস্কিল কি?—কতদিন আছো গোলাপ কলোনীতে?”
“আন্দাজ সাত আট বছর হৈতে চলল। তখন বোষ্টম ঠাকুর ছাড়া আর কোনও কর্তাই দেখা দেন নাই। আমি পুরানো লোক।” (চিড়িয়াখানা: শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়)
বুঝিলাম ইনিই মুস্কিল মিঞা। ব্যোমকেশ বলিল—“মুস্কিল কিসের?”
মুস্কিল বলিল—“রসিকবাবুর-ও এই টেরেনে আওনের কথা। তা তিনি আইলেন না। পরের টেরেনের জৈন্য সবুর করতি হইব। তা বাবু মশায়রা গাড়ির মধ্যে বসেন।”…
ব্যোমকেশ বলিল—“আজই ফিরব।—তুমি মুস্কিল মিঞা?”
মুস্কিল মুখ মুচকাইয়া বলিল—‘নাম তো কর্তা সৈয়দ নুরুদ্দিন। কিন্তু মুস্কিল হইছে বাবুরা আদর কৈরা মুস্কিল মিঞা ডাকেন।”
“এ আর মুস্কিল কি?—কতদিন আছো গোলাপ কলোনীতে?”
“আন্দাজ সাত আট বছর হৈতে চলল। তখন বোষ্টম ঠাকুর ছাড়া আর কোনও কর্তাই দেখা দেন নাই। আমি পুরানো লোক।” (চিড়িয়াখানা: শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়)
ক্যাবলাদের কাজ হল সর্বত্র ‘মুশকিল’ ঘটানো, নিজেকে আর সকলকে বিপন্ন করেই বুঝি তাদের পুণ্য। এমনটা বাস্তবে ঘটুক বা নাই ঘটুক, যারা খুব খুব বুদ্ধিমান তারা ক্যাবলাদের এমনটাই ভাবে। এমনটা ভাবলেই তাদের বুদ্ধি আরও পোক্ত হয়।
এখন, মুশকিল হল এটাই যে, কেউ ক্যাবলা চিরকালের জন্য নয়। ক্যাবলাদের-ও বুদ্ধি পাকে। কিংবা, গেঁয়ো যোগীও গ্রামের বাইরে বেরোতে পারলে দরবেশ কী সন্দেশ হতে কতক্ষণ! সামান্য পাথর সরে সরে একদিন দেবমহিমা পেয়ে যায়। অন্যদিকে, ভীষণরকম বুদ্ধি যাদের, বুদ্ধির বৃহস্পতি যারা, তারাও কখনও কি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয় না?
এখন, মুশকিল হল এটাই যে, কেউ ক্যাবলা চিরকালের জন্য নয়। ক্যাবলাদের-ও বুদ্ধি পাকে। কিংবা, গেঁয়ো যোগীও গ্রামের বাইরে বেরোতে পারলে দরবেশ কী সন্দেশ হতে কতক্ষণ! সামান্য পাথর সরে সরে একদিন দেবমহিমা পেয়ে যায়। অন্যদিকে, ভীষণরকম বুদ্ধি যাদের, বুদ্ধির বৃহস্পতি যারা, তারাও কখনও কি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয় না?
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৩: অকালে খেয়েছ কচু, মনে রেখো কিছু কিছু
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৩: সুন্দরবনে কুমিরের দেবতা কালু রায়
শাস্ত্রে বলছে, বিদ্বান সর্বত্র সমাদর পায়। কিন্তু, লেখাপড়া বেশি করলেই গাড়িঘোড়া চড়ার মতোই গাড়িচাপা পড়ার-ও সমূহ সম্ভাবনা। এরা অনেক অঙ্ক শুরু করেও কিছু অঙ্ক মেলাতে পারে না, যেদিন অঙ্ক মেলে, সেদিন সরলগুলো জটিল লাগে, কোনওদিন সিঁড়িগুলোই ভেঙে পড়ে বুঝি। এইসব ভেজা, নেতিয়ে পড়া, ছেঁড়া ঘুড়িদের ক্যাবলা বলে তত্ত্ববিদের দল ভারি আমোদ পায়। আর পাবে নাই বা কেন, এমন ন্যাজে-গোবরে মানুষ কি ঠিক মানুষ হতে পেরেছে? নাকি হাত-পা ওলা হাঁটতে চলতে কথা কইতে জানা জীববিশেষ এরা। মানুষ কাঁদছে বলে, তার সঙ্গে কাঁদার লোক জগতে হাসির পাত্র তো? কেউ কাউকে বাঁচায় না, কেউ বাঁচেও না এটাই তো জগতের নিয়ম? এই নিয়মে চললেই “আপনি থাকছেন”, না চললে… ছিঃ ছিঃ এত্তা জঞ্জাল!
তা বলে কি যেমন খুশি চলোই বুদ্ধিমানের কাজ? আর নিয়মমতে চলাই ক্যাবলামি?
উল্টোটা হলে কি পৃথিবীর সত্যগুলো আর অভ্রান্ত থাকে না? নাকি এতদিনের গড়ে তোলা আকাশের গায়ে টকটক গন্ধ খোঁজার একমাত্র ঠিকানা গজদন্তমিনারগুলো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে? অতঃপর তাহারা সুখে কালাতিপাত করিতে লাগিল ইত্যাদি ফিল গুড সরলগুলোই কখনও মেলে না। কারণ, মুশকিল হল, এগুলো এতটাও সরল নয়। কিংবা সরল-ই নয়। একটা ক্যালকুলাস, কিংবা থিওরেম, অথবা একটা প্রহেলিকা।
উল্টোটা হলে কি পৃথিবীর সত্যগুলো আর অভ্রান্ত থাকে না? নাকি এতদিনের গড়ে তোলা আকাশের গায়ে টকটক গন্ধ খোঁজার একমাত্র ঠিকানা গজদন্তমিনারগুলো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে? অতঃপর তাহারা সুখে কালাতিপাত করিতে লাগিল ইত্যাদি ফিল গুড সরলগুলোই কখনও মেলে না। কারণ, মুশকিল হল, এগুলো এতটাও সরল নয়। কিংবা সরল-ই নয়। একটা ক্যালকুলাস, কিংবা থিওরেম, অথবা একটা প্রহেলিকা।
আরও পড়ুন:
পরিযায়ী মন, পর্ব-১৫: তিনচুলে ও লেপচাজগৎ এর মেঘ-আলয়ে
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৪: একটু হোক-ফোক!
তবে কি বুদ্ধি খাটিয়ে ক্যাবলামি কিংবা বুক চিতিয়ে ক্যাবলামি করার মতো বুদ্ধি খাটানোই পন্থা? শাস্ত্রে ত্যাগের দ্বারা ভোগ কিংবা সমন্বয়ের যে ইঙ্গিত দিয়েছে সেই পথেই কিছু সমাধান? কিন্তু তেলে আর জলে নাকি মেশে না, তবে ক্যাবলামিটা টিকিয়ে রেখে চালাক কিংবা বুদ্ধিমান হতে পারা কি আদৌ সম্ভব? অথবা বুদ্ধিমান বলেই যাদের জানা আছে, তাদের কাজে ক্যাবলামি আবিষ্কার করাটাই একটা ক্যাবলামি ছাড়া কিছু নয়? এটাই হল মুশকিল, কারণ মুশকিল ছাড়া এক পাও চলার জো নেই, কী ঘরে বা বাইরে, কী বিশ্বে কিংবা জীবনে।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২০: পাঁচ ভাইয়ের বড়দিদি
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৮১: অন্ধ্রপ্রদেশ থেকেই রাজ্যের সিংহভাগ মাছের খাবার আসে, তাই খাদ্য উৎপাদন বিকল্প আয়ের পথ হতে পারে
ট্রেন লেট থেকে ঘড়ির স্লো হয়ে যাওয়া, হাতে সময় থাকলে কর্মাভাব, কর্ম থাকলে সময়াভাব, ইচ্ছা থাকলে উপায় না থাকা, উপায় থাকলে ইচ্ছা আর সময় দুটোই না থাকা, আর সব কিছু থাকলেও… মুশকিল আসান করার মতো দিনকালের অভাব ঘিরেই ক্যাবলামির বারোমাস্যা, বুদ্ধি করে উপায়, ইচ্ছে, সময়, কর্ম সকলকেই ভেন্টিলেশনে জাগিয়ে রাখার হিসেবের রোচনামচা লিখে চলাতেই মুশকিলগুলোকেও বাঁচিয়ে রাখাতেই বুঝি একটা চিড়িয়াখানার হরতন রুইতন চিড়েতনের সার্থকতা?
ঋণ স্বীকার:
লোপামুদ্রা মিত্রের গান “আমার মুশকিল আসান করো” থেকে
ঋণ স্বীকার:
লোপামুদ্রা মিত্রের গান “আমার মুশকিল আসান করো” থেকে
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।