শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

গাধা মানেই বোকা। চালাক মানেই কাক। আর চতুর হল শেয়াল। এছাড়াও অনেকে আছে। তাদের কেউ খড়কুটো। কেউ জাহাজ। সঙ্ঘশক্তি আছে। দশের মিল আছে। একের বুদ্ধিবল-ও আছে। কিন্তু সবকিছুর ওপরে একটা সত্য যেন জেগে থাকে, প্রতীক। সবকিছু একটা নির্দিষ্ট মাপের খাপে বসিয়ে, এক ছাঁচে ঢালাই করার ইঙ্গিত। বংশগতি, অভিযোজন কিংবা উদ্বর্তনের তত্ত্ব একটা নির্দিষ্ট প্রবণতার আভাষ দেবে একথা প্রমাণিত, যেকারণে আমড়া আর আম এক হবে না, কিন্তু তা বৈচিত্র্যের মাধুর্যকেও প্রতিষ্ঠা দেবে, এটাও ধ্রুব, অভ্রান্ত। যেকারণে প্রতি মুহূর্ত, প্রতিটি দিন পৃথক, স্বতন্ত্র, স্বয়ংসম্পূর্ণ। গতানুগতিকতার আপেক্ষিক থোড়-বড়ি-খাড়া সেখানে একটা অসম্পূর্ণ সত্য কিংবা সম্পূর্ণ মিথ্যার মতোই কিছু একটা। অথচ, ছাঁচে ঢালা “তথাকথিতের” আলেয়ায় বাঘ আর বেড়াল কোথাও এক হয়ে যায় বুঝি? সেই কথাটাই এখন হোক।
যে প্রতীকের কথা উঠল, তার কথাই আগে হোক। সেখান থেকে আমরা প্রবাদে পৌঁছবো। মাঝে থাকবে মেপে চেপে চলার স্ববিরোধ, দ্বিচারিতার আখ্যান।

তুমি বড় ভালো ছেলে, ওদের মতো হয়ো না। গোপাল-রাখাল? আপাতত সেদিকে না গিয়েও, পাশের বাড়ি থেকে পাশের দেশ, ও পাড়ার তমুক থেকে অমুকবাবুর সেই আত্মীয়ের বন্ধুর মতো হয়ে ওঠার চাপ, বাসনা, আকাঙ্ক্ষা, দাবি থেকেই একটা প্রতীক, একটা অবয়ব, একটা আদর্শ দানা বাঁধে। মহাপুরুষের আদর্শে মানুষ হয়ে ওঠা, মহাজীবনের গল্প শুনে নৈতিক আদর্শের বোধ তৈরি হওয়া কিংবা, অনুসরণযোগ্য জীবনের আলোয় স্নিগ্ধ হয়ে ওঠা, লক্ষ্য, দীক্ষা, প্রেরণায় নিজেকে চিনে ওঠার, সীমাবদ্ধতা থেকে সম্ভাবনার পরিসরকে উপলব্ধি করা এক, আর, টুবুনের মাসতুতো ভাইয়ের মতো অঙ্ক কষতে পারা কিংবা বিদিতা বা চকিতার পিসতুতো ননদের দিদির মেয়ের মতোই গায়িকা হয়ে উঠতে হবে, মানে, উঠতেই হবে; এই আলেয়াকে আলো ভাবলেই সেটা হয়ে যায় অনুকরণ।

অনুসরণ মানুষ করে, অনুকরণ বড়জোর ভেড়া করতে পারে, ময়দানে ভোরবেলার গড্ডলিকাপ্রবাহের মতো।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২২: এদিক ওদিক বেড়ায় তবু ভুলের পাড়া বেড়ায় না

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২৯: রাজ্য পরিচালনার ভার একজন মন্ত্রীর উপর ন্যস্ত হলে, তাঁর মনে অহঙ্কার জন্মায় যা রাজদ্রোহের পথকে প্রশস্ত করে

এটা মানতে বা না মানতে পারলে ‘ক্যাবলা’ হয়ে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা। কারণ, এখনও “মুখ দেখলে তো বোঝা যায় না ও অতো জানে”, “ও তো অমুকের মতো”, “তুমি এটা পারবে না”, “আমাদের বাপ-ঠাকুরদা যা করেনি তাই তুই করবি!”, “আমার পূর্বপুরুষ এটাই করেছে, আমিও এটাই করবো”, “ভাই! আমাদের রীতিই এই, মানতে পারলে থাকো, নইলে…”, “আমি বরাবর এভাবেই সকলকে করায়ত্ত করেছি, একেও খুব সহজেই করবো”, “এটা আমার বিশ্বাস, আর আমার ধারণা মানেই অভ্রান্ত”, “কেমন করে হবে, খোকার গায়ে এত কি জোর আছে?” “তোমার কথার মূল্য কি? তুমি আবার পারোটা কি? এই আমাকে দেখো, দেখে শেখো, আমার উচ্চতা দেখো, আমার বংশপরিচয় দেখো, আমার প্রতিপত্তি দেখো, এমনটা সাত জন্ম পরেও তুমি হতে পারবে না।”
কিন্তু মুশকিল হল, “যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন/ সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে/ সবার পিছে, সবার নীচে, সব-হারাদের মাঝে” এটা হল আমাদের হারমোনিয়াম সহযোগে অবিশ্বাসের থিওরি” আই গো আপ”, স্টেজ থেকে নেমেই সবার থেকে আলাদা চেয়ারটার দখল বুঝেই তো স্টেজে ওঠা! মনন আর মন, বিশ্বাস আর বাস্তব, মুখ আর মাথার ভিতরের ধূসর বস্তুর রহস্য… যেন এক ধ্বস্ত কুরুক্ষেত্র, ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনার লাইভ আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩৭: মনচলি ও মনচলি…কিশোর-আশার কণ্ঠ আর অমিতাভর নাচ, মনে আছে?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৯: ইষ্টদেবী জগদ্ধাত্রী

“তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। আজ বুঝেছি কতো বড় ভুল ছিল।” কিংবা,
সারে সারে বিচিত্র প্রবাদের ঝাঁপি থেকে ঝাঁপিয়ে নেমে আসা খণ্ড খণ্ড দেশ-কাল, স্ববিরোধ, দ্বিচারিতা।

অতি চালাকের গলায় দড়ি, অতি চেনার কদর নেই, অকাল গেল সুকাল এল পাকল কাঁটাল কোষ, আজ বন্ধু ছেড়ে যাও, দিয়ে আমার দোষ, অগুণ মানুষ গুণ না চিনে, মূষা না চিনে বিড়ালি; অপ্রেমী যে প্রেম না চিনে, কাঠ না চিনে কুড়ালি, অগুণস্য হতং রূপম্, অগুরু চন্দন ফেলে চায় শেওড়া কাঠ, কোকিলের ধ্বনি ফেলে বানরের নাট, অগ্নি, ব্যাধি ও ঋণ, রেখো না তিনের চিন, আইতেও একা যাইতেও একা কার সঙ্গে বা কার দেখা, আগে আপন পরে পর আপন সামালে পরকে ধর, আগে গেলে বাঘে খায়, পাছে গেলে সোনা পায়, আগে গেলেও দোষ পাছে গেলেও দোষ, আগে ভাল ছিল জেলে জালদড়া বুনে, কি কাজ করিল জেলে এঁড়ে গরু কিনে, আগে হলাম আমি, পিছে হল মা; হাসতে হাসতে দাদা হল বাবা হল না, আগে হাঁটে, পাঁঠা কাটে, প্রদীপ উস্কোয়, দই বাঁটে; ভাণ্ডারী, কাণ্ডারি, রাঁধুনি বামুন, যশ পায় না এই সাতজন, আজ রাজা কাল ভিখারি ফুটানি করে দিন দুচারি, আনারস বলে কাঁঠাল ভাই তুমি বড় খসখসে, আপনা মাংসে হরিণা বৈরি, আপনার বেলায় আঁটিসাটি পরের বেলায় দাঁতকপাটি, কইলাম কথা সবার মাঝে; যার কথা তার গায়ে বাজে, কীসের মধ্যে কি পান্তা ভাতে ঘি, কিসের মাসি, কীসের পিসি, কীসের বৃন্দাবন; মরাগাছে ফুল ফুটেছে মা বড় ধন, জিভ পুড়লো নিজের দোষে, কি করবে হরিহর দাসে!
আরও পড়ুন:
চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়াটাই যে ক্যাবলামি… সে কথা ভালোমানুষের দল বুঝবে কবে? গাঙ পেরুলেই কুমীরকে কলা দেখায় যারা, যারা এক মাঘেই শীত চলে যাওয়ায় বিশ্বাসী কিংবা, গাছে তুলে মই কাড়া যাদের কাজ, গাছে কাঁঠাল রেখে গোঁফে তেল দিয়েই যাদের সুখ… তারাই বুঝি ধূর্তশিরোমণি?

“There are more things in Heaven and Earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy.”
(Shakespeare’s play, Hamlet)

ঋণ: উইকিপিডিয়া
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content