ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
মানবপ্রজন্মের আদিলগ্ন থেকে মানুষ ও প্রাণীর সুন্দর সহবস্থান লক্ষ্য করা যায়। খাদ্য-সহ নানান প্রয়োজনে বুদ্ধিমান মানুষ পশুদেরকে ব্যবহার করেছে এ কথা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে যখন মানুষ আগুনের ব্যবহার জানত না তখন পেটের দায়ে পশুদের কাঁচা মাংস মানুষকে খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করতে হতো। পরে আগুনে পুড়িয়ে বা ঝলসে সেই খাবার খেতে লাগলো। পরবর্তী সময়ে কৃষিকাজ শেখার ফলে প্রাণিজ মাংসের ব্যবহার কমিয়ে, মানুষ নির্ভরতা বাড়ালো খাদ্যশস্য, ফলমূল ও শাকসব্জির ওপর।
আদিম মানুষ দুটি প্রয়োজনে প্রাণী হত্যা করত, এক. আত্মরক্ষা, দুই. ক্ষুন্নিবৃত্তি। বর্তমানে লোভের বশীভূত মানুষ প্রাণী হত্যা করে এবং ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’ হিসাবে বন্যপশুর মাংস খায়। বন্য আদিম মানুষ অংক জানতো না তাই তাদের মৃত্যুর কোনও হিসাব নেই, সেই সময়ে অতিমারি ছিল কিনা তার কোন তথ্যও নেই। তবে বর্তমান দেখে অতীতের একটা আন্দাজ করে বলা যেতে পারে, প্রাণিজ মাংসের ফলে আদিম মানুষের মৃত্যুও কম হতো না। কারণ, তা থেকে বিভিন্ন ধরনের রোগের উৎপত্তিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আরও পড়ুন:
বিশ্ব উষ্ণায়নই কি পঙ্গপালের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ?
লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৮: ইতালিয়ান নিওরিয়ালিজম এবং ডি সিকার বাইসাইকেল থিভস
বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, প্রাণীদের দেহে অবস্থিত নানা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া ও হেলমেন্থিস মানুষের শরীরে অবাধে প্রবেশ করছে এবং সৃষ্টি করছে বিভিন্ন বিচিত্র রোগ যা জুনোসিস নামে পরিচিত। বর্তমান ও অতীত সময়কালের মধ্যে ঘটে যাওয়া অনেক রোগ যথা সার্স, মার্স, হান্টা, নিপা ভাইরাসজনিত রোগ, ইবোলা ভাইরাস রোগ, সালমোনেল্লোসিস, সোয়াইন ফ্লু, বার্ড ফ্লু, আফ্রিকান ঘুম রোগ, প্লেগ, চাগাস, ডেঙ্গু ও লাসা জ্বর, জাপানি এনকেফেলাইটিস, কুষ্ঠরোগ, জলাতঙ্ক রোগ, টিবি রোগ, জিকো জ্বর, ওয়েস্ট নীল জ্বর, করোনা ভাইরাস জনিত অতিমারি ইত্যাদি জুনোসিস হিসাবে উল্লেখযোগ্য। যখনই মানুষ এই ধরনের রোগের কবলে পড়ে তখনই নিরীহ বন্যপ্রাণী যাদের থেকে এই রোগ ছড়িয়েছে বলে মনে করা হয়, তাদের গালিগালাজ এবং তাদের বংশ নির্বংশ করার চেষ্টা করা হয়।
ব্যাহত হয় বন্যপ্রাণ, তারওপর নির্ভরশীল বাস্তুতন্ত্র, সর্বোপরি আমাদের এই পরিবেশ। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, এই ধরনের প্রতিটি প্রাণীই পৃথিবীতে এসেছে মানুষের আসার বহু পূর্বে, তাদের মধ্যে অবস্থিত রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা নানান জীবের আগমনও বহু কোটি বছর পূর্বে। মানুষ থেকে মানুষে যেমন রোগ ছড়ায়, তেমনি প্রাণীদেরও নিজেদের মধ্যেও রোগ ছড়ায় স্বাভাবিক নিয়মেই। কিন্তু অস্বাভাবিকত্ব দেখা যায় তখনই, যখন প্রাণীদের রোগ চলে আসে মানুষের মধ্যে। যত ধরনের জুনোটিক রোগ আছে তার বিস্তারের একটি নির্দিষ্ট নিয়ম আছে এবং তা বিধিবদ্ধ আছে ডাক্তারি শাস্ত্রে। তার মধ্যে একটি অন্যতম কারণ হল বন্যপ্রাণীর কাঁচা বা অর্ধসিদ্ধ মাংস ভক্ষণ। নিরামিষাশী মানুষ ব্যতীত প্রায় সকল মানুষই কম বেশি প্রাণিজ প্রোটিন অর্থাৎ মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি গ্রহণ করে খাদ্য হিসাবে। তার মধ্যে বহু মানুষরাই কাঁচা বা অসিদ্ধ এবং অর্ধসিদ্ধ বন্যপ্রাণীর মাংস থেকে নানা উপায়ে মহার্ঘ ও উপাদেয় ডিশ বানায়।
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৪: পানমশলা খেলে ক্যানসার হয়?
পরিযায়ী মন, পর্ব-১২: নেতারহাটের নাশপাতি বাগান
বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর শিকার প্রায় নিষিদ্ধ হলেও ‘সাইটস’ অর্থাৎ কনভেনশন অন ইন্টার্নেশনাল ট্রেন্ড ইন এনডেনজারড স্পিসিস এর বিধি নিষেধকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চোরাশিকার ও বন্যপ্রাণীর রমরমা ব্যবসা সারা বিশ্বেই প্রচলিত। সেই শিকার করা প্রাণীর টাটকা বা বাসি মাংস বা নানা বন্যপ্রাণী জীবন্ত অবস্থায় বিক্রি হয়, যেসব বাজারে সেগুলি সর্বদা জল বা বরফ গলা জলে ভিজে থাকে, তাই তাদের ওয়েট মার্কেট বা ভিজে বাজার বলে। এগুলিতে গৃহপালিত থেকে বন্যজ সকল স্থলচর, জলচর, উভচর বা খেচর প্রাণীর বিক্রি ও তার ব্যবসা হয়। তাদের মাংস বিক্রি করা হয় মানুষের খাদ্য উপযোগী করে।
এই ওয়েট মার্কেট গুলিই হল বিভিন্ন প্যাথোজেনের আঁতুড়ঘর। এখানে আইনসঙ্গতভাবে বা সম্পূর্ণ আইনঅসম্মত ভাবে বন্যপ্রাণীর ব্যবসা চলে, ব্যবসা চলে লুপ্তপ্রায় প্রাণীরও। ফলে আমরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করছি, প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনাকে নাড়িয়ে দিচ্ছি। ফলে বিভিন্ন ক্ষতিকর জীবাণু বা ভাইরাস তাদের নিজস্ব বাসস্থান ছেড়ে, মানব শরীরে বসবাসের জন্য নিজেদের উপযুক্ত করে নিচ্ছে। বৃটেনের একদল গবেষক জানাচ্ছেন কোভিড-১৯ ভাইরাসটির ন্যাচারাল হ্যাবিট্যাট প্যাঙ্গোলিন বা বাদুড় হতে পারে। ঠিক তেমনই ইবোলা ভাইরাস, সার্স ও মার্স ভাইরাস বাদুড়ের শরীরে ও হান্টা ভাইরাস ইঁদুরের দেহে বাস করে। সুতরাং এইসব প্রাণীদের সংস্পর্শে আসা বা তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশ ভক্ষণ করলে তবেই তাদের শরীরে অবস্থিত প্যাথোজেনগুলি আমাদের শরীরে আসবে।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭৮: যেখানে অন্য মাছচাষ লাভজনক নয়, সেখানে অনায়াসে শিঙ্গি, মাগুরের চাষ করা সম্ভব
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২১: ওঠো ওঠো রে! বিফলে প্রভাত বহে যায় যে!
চিনের উহানে অবস্থিত এমন বিখ্যাত (কুখ্যাত) ওয়েট মার্কেট যেমন আছে, তেমনি ভারতবর্ষসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই এই ধরনের বাজার আছে যেখানে বন্যপ্রাণীর বিক্রি ও ব্যবসা হয়। গৃহপালিত, ফার্মপালিত বা গবেষণাগারপালিত প্রাণীর ব্যবসা হোক আইনসম্মতভাবে কিন্তু বন্যপ্রাণীর চোরাচালান ও ব্যবসা বন্ধ হওয়া সর্বাধিক প্রয়োজন। এরজন্য প্রথমেই প্রয়োজন তাদের ওয়েট মার্কেট গুলিকে নিষিদ্ধ করা। তার ফলে লুপ্তপ্রায় ও বন্যপ্রাণীর মাংস এবং তাদের জীবন্ত বিক্রি এবং ব্যবসার ক্ষেত্র বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে চোরাশিকারিরা তাদের উৎসাহ হারাবে, এর ফলে বাস্তুতন্ত্র তথা বন্যপ্রাণীর সাম্যতা ফিরবে এই পৃথিবীতে। শুধু তাই নয় করোনার মত অতিমারির প্রসূতিগৃহগুলিও ধ্বংস হবে এবং পৃথিবীব্যাপী জুনোসিসকে অনেকাংশে আটকানো যাবে বলে আশা করা যায়।
* * ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।