শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ।
শ্রীরামকৃষ্ণ সাধনার শেষে বহু বছর অপেক্ষা করেছিলেন, তাঁর ভক্তদের আসার অপেক্ষায়। সন্ধেবেলায় দক্ষিনেশ্বরের কুঠিবাড়ির ছাদে উঠে তিনি আকুল ব্যাকুল হয়ে ডাকতেন “ওরে তোরা কে কোথায় আছিস আয়! আমার যে তোদের না দেখে প্রাণ যায়! বিষয়ী লোকেদের সাথে কথা বলে বলে যে আমার প্রাণ জ্বলে গেল।” এরপর ক্রমশ ভক্তেরা একে একে তাঁর কাছে আসতে থাকে।
এখনও অলক্ষ্যে তিনি আমাদের ডেকে চলেছেন কারণ তিনি আমাদের ছাড়া থাকতে পারেন না। তিনি চান ভোগের পঙ্ক থেকে আমরা উঠে বসি। পাঁকাল মাছের মতো ঝেড়ে ফেলে পাঁক। অমৃত-স্নান করে শুদ্ধ পবিত্র হই। ভক্তি ও অনুতাপ অশ্রুতে আমাদের হৃদয় পবিত্র হোক, আর মন হোক শুদ্ধ। কারণ শুদ্ধ হৃদয়েই ঈশ্বর দর্শন হয়। তাঁর কথায় “তিনি শুদ্ধ মন ও শুদ্ধ বুদ্ধির গোচর। শুদ্ধ মন ও যা শুদ্ধ আত্মাও তা। আয়নায় ময়লা থাকলে মুখ দেখা যায় না। কিন্তু ময়লা মুছে ফেললে আবার সেই আয়নাতেই মুখ দেখা যায়। সোনা চাপা আছে মাটির ভিতর। মাটি সরিয়ে ফেললে সেই সোনাই পাওয়া যায়। হাজার বছরের অন্ধকার ঘরে যদি কেউ আলো জ্বালে, তবে কি অন্ধকার একটু একটু করে যায়? ঘরটা সঙ্গে সঙ্গে আলোকিত হয়।”
এখনও অলক্ষ্যে তিনি আমাদের ডেকে চলেছেন কারণ তিনি আমাদের ছাড়া থাকতে পারেন না। তিনি চান ভোগের পঙ্ক থেকে আমরা উঠে বসি। পাঁকাল মাছের মতো ঝেড়ে ফেলে পাঁক। অমৃত-স্নান করে শুদ্ধ পবিত্র হই। ভক্তি ও অনুতাপ অশ্রুতে আমাদের হৃদয় পবিত্র হোক, আর মন হোক শুদ্ধ। কারণ শুদ্ধ হৃদয়েই ঈশ্বর দর্শন হয়। তাঁর কথায় “তিনি শুদ্ধ মন ও শুদ্ধ বুদ্ধির গোচর। শুদ্ধ মন ও যা শুদ্ধ আত্মাও তা। আয়নায় ময়লা থাকলে মুখ দেখা যায় না। কিন্তু ময়লা মুছে ফেললে আবার সেই আয়নাতেই মুখ দেখা যায়। সোনা চাপা আছে মাটির ভিতর। মাটি সরিয়ে ফেললে সেই সোনাই পাওয়া যায়। হাজার বছরের অন্ধকার ঘরে যদি কেউ আলো জ্বালে, তবে কি অন্ধকার একটু একটু করে যায়? ঘরটা সঙ্গে সঙ্গে আলোকিত হয়।”
যিশুখ্রিস্টও বলেছিলেন এই একই কথা “Blessed are the pure in heart, for they shall see God.” (পবিত্র আত্মারাই ধন্য। কারণ তাঁরাই ঈশ্বর দর্শন করবে।) রবীন্দ্রনাথও এই শুদ্ধ মনের জন্য প্রার্থনা করেছেন ঈশ্বরের কাছে—
“কত কলুষ কত ফাঁকি
এখনো যে আছে বাকি হৃদয়মাঝারে,
তুমি তার লাগি আর
ফিরায়ও না
তারে আগুন দিয়ে দহ।”
(গানের প্রথম পংক্তি —
“তুমি এবার আমায়
লহো হে নাথ লহো”)
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “জীব তো সচ্চিদানন্দ-স্বরূপ। শুধু আবরণ ও বিক্ষেপ।” এই আবরণ ও বিক্ষেপ গেলেই জীব দেখে এক বই দুই নেই। দেহবোধ থাকতে বলতে গেলেই দুটো। পূর্ণজ্ঞান হলে এক চৈতন্য বোধ হয়।” এ ব্যাপারে তাঁর দর্শনের কথা তিনি আমাদের শোনাচ্ছেন “একদিন (মা) দেখালে—আমি নিজে, এক সাহেব ও মুদ্দফরাস। এক দেড়ে মুসলমান এসে এক সানকি থেকে একটু ভাত সকলের মুখে দিয়ে গেল। দেখালে অভেদ, এক চৈতন্য।” বলছেন, “বিচার আর কি করব? দেখছি তিনিই সব হয়েছেন। হাড়িকাঠ, বলির পাঁঠা, কামার, প্রতিমা—সব তিনি। দেখছি মানুষগুলো খোল মাত্র। তিনিই ভেতর থেকে হাত, পা, মাথা, নাড়ছেন। নিজের মধ্যে নিজেকে দেখতে পেল তো সব হয়ে গেল। এর জন্যেই সাধনা।”
এখনো যে আছে বাকি হৃদয়মাঝারে,
তুমি তার লাগি আর
ফিরায়ও না
তারে আগুন দিয়ে দহ।”
(গানের প্রথম পংক্তি —
“তুমি এবার আমায়
লহো হে নাথ লহো”)
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “জীব তো সচ্চিদানন্দ-স্বরূপ। শুধু আবরণ ও বিক্ষেপ।” এই আবরণ ও বিক্ষেপ গেলেই জীব দেখে এক বই দুই নেই। দেহবোধ থাকতে বলতে গেলেই দুটো। পূর্ণজ্ঞান হলে এক চৈতন্য বোধ হয়।” এ ব্যাপারে তাঁর দর্শনের কথা তিনি আমাদের শোনাচ্ছেন “একদিন (মা) দেখালে—আমি নিজে, এক সাহেব ও মুদ্দফরাস। এক দেড়ে মুসলমান এসে এক সানকি থেকে একটু ভাত সকলের মুখে দিয়ে গেল। দেখালে অভেদ, এক চৈতন্য।” বলছেন, “বিচার আর কি করব? দেখছি তিনিই সব হয়েছেন। হাড়িকাঠ, বলির পাঁঠা, কামার, প্রতিমা—সব তিনি। দেখছি মানুষগুলো খোল মাত্র। তিনিই ভেতর থেকে হাত, পা, মাথা, নাড়ছেন। নিজের মধ্যে নিজেকে দেখতে পেল তো সব হয়ে গেল। এর জন্যেই সাধনা।”
আরও পড়ুন:
যত মত, তত পথ, পর্ব-৮: আনন্দের ফেরিওয়ালা
মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-১৩: দেবী সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের স্থাপত্য এক অনন্যসাধারণ মিশ্রশৈলীর উদাহরণ
শুধু অর্থনৈতিক সাম্য নয়—এই চেতনার সাম্য, সকলের মধ্যে একই চৈতন্যস্বরূপকে দেখার সাম্যের বাণী নিয়ে একদিন এই পৃথিবী যে তোলপাড় হবে, আর অনিত্য বিষয় ছেড়ে তাঁর সঙ্গে আনন্দনগরে যাবার জন্য তিনি যে ব্যাকুল আহ্বান করেছেন তার ডাকেও যে একদিন পৃথিবীর বহুলোক ব্যাকুল হয়ে ছুটে যাবে, তা তিনি জানতেন। (আধুনিক বিজ্ঞান, বিশেষ করে পদার্থবিদ্যা (Physics) সেই এককে সর্ব বস্তুতে দর্শনের জন্য বিজ্ঞান মন্দিরের দ্বারে মাথা খুঁড়ে মরছে।)
শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন, এখন তাঁকে কেউ বুঝবে না। তাই বলেছেন “কালে বুঝবে। বাউলের দল এলো গেল, কত নাচলে গাইলে, কেউ চিনল না।” কোথাও বলেছেন, “ওরে তাঁরে কেউ চিনলে না রে, সে যে কাঙাল বেশে ফিরছে জীবের ঘরে ঘরে।” কোথাও বুঝিয়েছেন—হীরের দাম বেগুনওয়ালা, কাপরওয়ালা বুঝতে পারে না। একমাত্র হীরেওয়ালাই জানে তার মূল্য।
শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন, এখন তাঁকে কেউ বুঝবে না। তাই বলেছেন “কালে বুঝবে। বাউলের দল এলো গেল, কত নাচলে গাইলে, কেউ চিনল না।” কোথাও বলেছেন, “ওরে তাঁরে কেউ চিনলে না রে, সে যে কাঙাল বেশে ফিরছে জীবের ঘরে ঘরে।” কোথাও বুঝিয়েছেন—হীরের দাম বেগুনওয়ালা, কাপরওয়ালা বুঝতে পারে না। একমাত্র হীরেওয়ালাই জানে তার মূল্য।
এই পাগল-বাউল আমাদের বদ্ধ অবস্থা দেখে একেবারে স্থির থাকতে পারেন না। তিনি আমাদের অসত্য থেকে সত্যে, অচৈতন্য থেকে চৈতন্যে ও মৃত্যু থেকে অমৃতে নিয়ে যেতে চান। গুদামের ইঁদুরের মতো আমাদের অল্পে তুষ্ট দেখে তিনি কষ্ট পান, বোঝাতে চান অল্পে তুষ্ট হয়ো না কারণ ভূমাতেই সুখ, অল্পে সুখ নেই। (ভূমৈব সুখম, নাল্পে সুখমস্তি ) দু’ দিনের অনিত্য সম্পদ নিয়ে আমাদের মশগুল দেখে, তিনি সেই পরম সম্পদের দিকে আমাদের মুখ ঘুরিয়ে দিতে চান। কারণ তিনিই পরম সম্পদ, তিনিই পরম গতি। (এষাস্য পরমা সম্পদ, এষাস্য পরমা গতি) আমরা তাঁর কথা শুনছি, কিন্তু অন্তরে ঢুকছে না, কারণ মন ভোগের জন্য ব্যাকুল হয়ে নকল ফেরিওয়ালাদের দিকে ছুটে চলেছে।
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৭: মা সারদার ভগবতী সাধনা
আমরা তাঁর দিকে না ফিরে তাকালে, ‘পাগল’ বললে কিংবা অবজ্ঞায় ফিরে চলে গেলে, তিনি কিন্তু আমাদের ছেড়ে যেতে পারেন না। কারণ, এই পাগল-বাউল আমাদের ভারী বন্ধু ও আপনজন। সখার মতো তিনি আমাদের হাত ধরতে চান, আমাদের দুঃখে দুঃখী, সুখে সুখী তিনি—তিনি যে আমাদেরই লোক। আমাদের মূঢ়তায় তিনি কষ্ট পান, কিন্তু ফেলে পালান না। আর তাই খুব মমতায় ভালবেসে আমাদের কানের কাছে এসে বারবার গুনগুন করেন “হায়! হায়! তাঁকে কেউ চায় না। আনারস গাছের ফল ছেড়ে লোকে তার পাতা খেয়ে মরে।” “ঈশ্বরের আনন্দ কি তা মুখে বলা যায় না, যার হয়েছে শুধু সেই জানে।” “ঈশ্বরের আনন্দ পেলে তার আর কিছু ভাল লাগে না। সে শুধু সেই আনন্দ খুঁজে বেড়ায়।” “বাবা ছেলেকে বলেছিল ‘মদটা আর খাসনি।’ ছেলে বলল ‘বাবা তুমি একবার খেয়ে দেখ।’ বাবা খেয়ে বলল ‘তুই ছাড়লে ছাড়, আমি আর ছাড়ছি না’।”
কত না কথায়, উপমায় তিনি আমাদের বোঝাতে চান শাশ্বত ও অনন্ত ঈশ্বরের আনন্দ কি। আমাদের বিশ্বাসের জন্য কাম-কাঞ্চন-খ্যাতি ও ক্ষমতা, যার জন্য আমাদের মুখ দিয়ে অনবরত নাল ঝরছে, সেসব তিনি থু থু করে ফেলে দিলেন—যাতে আমরা তার কথায় বিশ্বাস করে, আর ঠুনকো আনন্দের পিছনে না দৌড়ে, প্রকৃত শাশ্বত আনন্দের খোঁজ করি। কিন্তু বদ্ধজীব আমাদের অবস্থা বিষ্ঠার পোকার মতো। তাঁর কথায় “বিষ্ঠার পোকা বিষ্ঠাতেই ভালো থাকে। ওতেই বেশ হৃষ্টপুষ্ঠ হয়। তাকে ভাল জায়গায় রাখলে হেদিয়ে হেদিয়ে মারা যাবে।” আমাদের শোনালেন দুই বান্ধবী মালিনী ও মেছুনির কথা। মেছুনির বাড়ি ফিরতে রাত হওয়ায় পথে বান্ধবী মালিনীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। দুজনে শুয়ে আছে একসাথে। এদিকে মালিনীর ঘরের ফুলের গন্ধে মেছুনির কিছুতেই ঘুম আসছে না। তখন সে উঠে বাইরে বেরিয়ে মাছের ঝুড়িটায় জল দিয়ে মাছের গন্ধে ভোঁস ভোঁস করে নাক ডেকে ঘুমোতে লাগল।
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২০: অক্টোবর মাসের ষোলো, কী হল! কী হল?
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭৮: যেখানে অন্য মাছচাষ লাভজনক নয়, সেখানে অনায়াসে শিঙ্গি, মাগুরের চাষ করা সম্ভব
একটা গুবরে পোকা নাকে একটু গোবর নিয়ে কয়েক বিঘা বিস্তৃত বেলফুলের বাগানে ঘুরে বেড়ালেও, তার নাকের উপর ওইটুকু গোবরের জন্য, গোবর ছাড়া একটুও বেলফুলের গন্ধ পাবে না। তেমনি আমাদের চেতনায় কাম কাঞ্চন খ্যাতি ক্ষমতার আসক্তির জন্য আমরা শাশ্বত ও অনন্ত আনন্দের জন্য কোনও তৃষ্ণা অনুভব করি না। আমাদের অবস্থা ধরা পড়েছে রবীন্দ্রনাথের গানে—
তোমার কথা হেথা
কেহ তো বলে না,
মিছে করে শুধু কোলাহল।
সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া
পান করে শুধু হলাহল।
আমরাও অমৃতসাগরের তীরে বসে, উল্টো দিকে মুখ করে, বিষ খেয়ে মরছি, তবু ভুলেও অমৃত মুখে দিচ্ছি না। আমাদের অবস্থা রজনীকান্ত সেনের গানে ধরা পড়েছে—
ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়
ওরা চাহে ধন, জন, মান,
আরোগ্য, বিজয়।
করুনার সিন্ধুকুলে আসি
একবিন্দু বারি মুখে নাহি লয়।
ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়।
কেহ তো বলে না,
মিছে করে শুধু কোলাহল।
সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া
পান করে শুধু হলাহল।
আমরাও অমৃতসাগরের তীরে বসে, উল্টো দিকে মুখ করে, বিষ খেয়ে মরছি, তবু ভুলেও অমৃত মুখে দিচ্ছি না। আমাদের অবস্থা রজনীকান্ত সেনের গানে ধরা পড়েছে—
ওরা চাহে ধন, জন, মান,
আরোগ্য, বিজয়।
করুনার সিন্ধুকুলে আসি
একবিন্দু বারি মুখে নাহি লয়।
ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়।
* সুসময় রায় চৌধুরী (Susamay Roy Chowdhury) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইরাজি সাহিত্যে সাম্মানিক ও সাংবাদিকতায় এমএ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ: ১. শিক্ষায় জীবন গঠন ও আনন্দলাভ—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ, ২. শ্রীরামকৃষ্ণ-আলোয় সবার জীবন, ৩. শ্রীরামকৃষ্ণের কথা রবীন্দ্রনাথের গান—প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড। আরও কয়েকটি খণ্ড প্রকাশের অপেক্ষায়। প্রকাশিতব্য: ১. জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য—ঈশ্বরলাভ, ২. কে তুমি শ্রীরামকৃষ্ণ?, ৩. কে তুমি বিবেকানন্দ?, ৪. জন্মানতরবাদ—ভারতীয় শাস্ত্র ও ঋষি, মহামানবেরা।