শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


রাজেশের পরিবর্তে ‘আনন্দ’ ছবিতে মুখ্যচরিত্রে অভিনয়ের জন্য কিশোরকে পছন্দ করেছিলেন হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়।

বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন কারণে, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অনেক সমস্যার মধ্যেও কিশোর অন্তরে কাঁদলেও, বাইরের জগৎকে তা বুঝতে দেননি কখনওই। এমনি রহস্যময়, জাদুকর ছিলেন তিনি। নিজের ভিতরের দুঃখ, কষ্টকে সদা রাখতেন এক ছোট শিশুর সরলতার অন্তরালে। রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে তার হাজার রকম ছেলেমানুষির কথা বার বার উঠে আসে লতা, আশার স্মৃতিচারণায়।
জীবনে প্রথমবার যখন পঞ্চমদা তার দেখা পান তিনি তখন এক স্টুডিয়োর সামনের পাঁচিলে উঠে বসে পা দোলাচ্ছেন আর দাদামনি আর সচিন কর্তার নকল করে যাচ্ছেন অবিরত। অমিত খান্নার কাছে শোনা যায়, নিজের বাড়ির বাগানে লাগানো দোলনা আর স্লিপে নিয়মিত বিস্তেন তিনি। খুব নিকট পরিচিত বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে বলতেন, ‘বাধিয়া খালে কারারে গাজাক।’ তবে সে কথার অর্থ বোধকরি শুধু তিনি জানতেন।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১১: কার মন ভোলাতে এলে তুমি আজ…

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩৪: আরডি-র গানে সারা পৃথিবীর মিউজিক উঠে এসেছিল

শারারাত ছবির শুটিংয়ের কথা। এক গানের রেকর্ডিংয়ে কথা মতো না যাওয়ার জন্য, নির্দেশক ঠিক করলেন কিশোরকে তিনি তার বাড়ি থেকে গিয়ে নিয়ে আসবেন। কিশোরের বাড়ি গিয়ে তো তিনি তাজ্জব বোনে গেলেন, দেখলেন কিশোর নিজের গলায় একটি চেনের মতো বেঁধে, একটি থালায় রুটি আর পাশে একটা বাটিতে কিছুটা জল নিয়ে মাটিতে বসে রয়েছেন। ঠিক যেন বাড়ির পোষা একটি কুকুর।

আর পাঁচজনের মতো এ দেখে পরিচালক আর হাসি চাপতে পারলেন না, যেই না তিনিও মজা করে কিশোরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গিয়েছেন, অমনি কিশোরও কুকুরের মতো চিৎকার করে তাড়া করলেন পরিচালককে। একেবারে বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বার না করা পর্যন্ত। একবার তো এক ছবিতে ভোজন গাওয়ার আগে কোনও এক তীর্থস্থান থেকে ঘুরে এসে, সন্ন্যাসীদের বেশ ধারণ করলেন।
এ ভাবেই হাসতে আর হাসাতে হাসাতেই হঠাৎ একদিন সবকিছু ছেড়ে চলে গেলেন অমৃতলোকে। দিনটা ছিল ১৩ অক্টোবর ১৯৮৭। কোনও এক রেকর্ডিংয়ের ব্যাপারেই কথা বলে, টেলিফোন রেখে একটি হলিউড ছবি দেখছিলেন বাড়ির বসার ঘরে বসে। হঠাৎই বুকে কিছু অস্বস্তি অনুভব করায় তা জানালেন স্ত্রী লীনাকে। প্রথমে লীনা ভাবলেন এ হয়তো তার করা আর পাঁচটা মজার মতো কিছু হবে। তবে সঙ্গে সঙ্গেই অনুভব করলেন ঘটনার গুরুত্ব। তৎক্ষণাৎ ডাক্তার ডাকার কথা বলতে কিশোর বললেন, বাড়িতে কোনও ওষুধ থাকলে দিলে তিনি ঠিক হলেও হতে পারেন। তবে ডাক্তার ডাকলে তার অবধারিত হার্ট অ্যাটাক হবে। চির হাস্যময়, মুখরিত মানুষটার ওটিই ছিল শেষ মজা। এরপর কোনও চিকিৎসার সুযোগ আর দেননি তিনি।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২১: ওঠো ওঠো রে! বিফলে প্রভাত বহে যায় যে!

ইতিহাস কথা কও, পর্ব-১৫: দেবদেউল কথা ও গোসানিমারি কামতেশ্বরী মন্দির

তার মৃত্যুর প্রায় ৩৫ বছর বাদেও যেন কিশোরের গুঞ্জন শোনা যায় প্রতি মুহূর্তে কোনও না কোনও আনাচে কানাচে, মনের মন্দিরে, হাসি কান্নার আলোড়নে। চোখ বন্ধ করলেই পর্দার সেই ছেলেমানুষি ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। কিশোরের মৃত্যু হয় না, তিনি অমর। তার অমৃতলোকে যাত্রার তরী ভেসে চলে আমাদের মনের ময়ুরমহলে।

সমাপ্ত

* ঋত্বিক চক্রবর্তী, পেশাগত ভাবে একটি বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। কর্মসূত্রেই স্পেনে থাকা। কাজের কাজ ও অকাজ করে সময় পেলেই বইপড়া, গান শোনার চেষ্টা আর পাঁচটা বাঙালির মতোই মজ্জাগত। রুজি রোজগারের বাইরে নিজের মনের জন্য কিছু পুষ্টি সঞ্চয়ে উন্মুখ। তাই পেশা আর নেশার টানাপোড়েনে পড়ে থাকা আর এক বাঙালি।

Skip to content