রবিবার ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


কেন দল বাঁধে পঙ্গপাল? ছবি: সংগৃহীত।

সহজ পাঠের দ্বিতীয়ভাগে রবি ঠাকুর লিখেছেন ‘এবার পঙ্গপাল এসে বড়ো ক্ষতি করেছে। ক্ষিতিবাবুর ক্ষেতে একটি ঘাস নেই। অক্ষয়বাবুর বাগানে কপির পাতাগুলো খেয়ে সাঙ্গ করে দিয়েছে। পঙ্গপাল না তাড়াতে পারলে এবার কাজে ভঙ্গ দিতে হবে।’ অর্থাৎ ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ভারতীয় তথা বাঙালিরা ‘পঙ্গপাল’ এই নামটির সঙ্গে বহুপূর্ব থেকেই পরিচিত। বর্গী হানার মতো বহুবারই পঙ্গপাল হানা সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা এই বাংলাকে নিস্তেজ করে দিয়েছে।
প্রাচীন মিশরের কবরের উপর ডেজার্ট লোকাস্টের ছবি পাওয়া যায়, গ্রিক মহাকাব্য ইলিয়াডে পঙ্গপালের উল্লেখ আছে, ১৮৭৪ ও ১৯৭৫ সালে আমেরিকায় ব্যাপক পঙ্গপালের আক্রমণ ঘটে। ২০১৮ সালে দক্ষিণ আরবের মরু অঞ্চলে যে পঙ্গপালের ঝাঁক উড়তে শুরু করে, তাদেরই কয়েক প্রজন্ম এগিয়ে আসতে আসতে পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে ভারতের গুজরাত, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশে প্রবেশ করেছে। হয়তো বা অচিরেই পশ্চিমবঙ্গ প্রবেশ করবে পঙ্গপালের দল।
আরও পড়ুন:

উদ্ভিদ থেকে তৈরি কৃত্রিম মাংসই খেয়াল রাখবে স্বাস্থ্যের, দাবি গবেষণায়

ঠাকুরবাড়ির বিজয়া, রবীন্দ্রনাথের বিজয়া

আমরা ছোটবেলা থেকেই পঙ্গপাল, গঙ্গাফড়িং বা ঘাসফড়িংয়ের নাম শুনেছি। তবে প্রকৃতপক্ষে এই তিন পতঙ্গই একই পতঙ্গের ভিন্ন ভিন্ন নাম। কিন্তু সকল ঘাসফড়িং বা গঙ্গাফড়িংকে পঙ্গপাল বলা যাবে না। ঘাসফড়িং বা গঙ্গাফড়িং পতঙ্গ শ্রেণিভুক্ত অ্যাক্রিডিডি ফ্যামিলির অন্তর্ভুক্ত একটি প্রাণী। এর মধ্যে যারা কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে ঝাঁক বেঁধে উড়তে পারে, তাদেরকেই কেবলমাত্র পঙ্গপাল বলা হয়। প্রায় কুড়িটি ঘাসফড়িং প্রজাতির মধ্যে সাধারণত তিন ধরনের পঙ্গপাল যথা—মাইগ্রেটরি লোকাস্ট, বম্বে লোকাস্ট ও ডেজার্ট লোকাস্ট ভারতে বহুবার হানা দিয়েছে। নষ্ট করেছে হাজার হাজার বর্গকিলোমিটারের সবুজ ফসল ও শাকসব্জিও।
এমনিতে স্বভাব ভিড়ু, শান্তশিষ্ট ও লাজুক প্রকৃতির প্রাণী পঙ্গপাল। এদের বেশিরভাগ প্রজাতিই একা ও এক স্থানে থাকতেই পছন্দ করে। আরও প্রজাতি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করলেও তারাও একাকীত্বই পছন্দ করে। কিন্তু যখন মরুঅঞ্চলে বৃষ্টিপাত হয় এবং মরুস্থান সবুজতায় ভরে ওঠে তখন সেই অনুকূল পরিবেশে মাটির তলায় থাকা ‘এগ পড’ ফুটে বাচ্চা হয়। এই অপরিণত বাচ্চাকে বলা হয়ে থাকে নিম্ফ।

এক হিসাবে দেখা গিয়েছে, এক বর্গমিটার এলাকায় প্রায় হাজারটি এগ পড পাওয়া যেতে পারে। একসঙ্গে যখন হাজারে-হাজারে ডিম ফুটে ঘাসফড়িং বেরিয়ে আসে, তখনই তাদের খাবারের অভাব ঘটে। নিম্ফ উঠতে পারে না, তাই তারা দলে দলে হাঁটতে থাকে এবং হাতের কাছে যা কিছু সবুজ পায় তাই খেয়ে সাবাড় করে দেয়। বড়রা আরও বেশি ভয়ংকর তারা হাজার হাজার কিলোমিটার উড়ে যেতে পারে। বাতাসের গতিপথের ওপর নির্ভর করে এর গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় ১৬ থেকে ১৯ কিলোমিটার।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৯: সুন্দরবনের জঙ্গল-জননী বিশালাক্ষী

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

একটি পঙ্গপালের ঝাঁক সারাদিনে ৫ থেকে ১৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত উঠতে পারে। পূর্বের এক ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গিয়েছে ১৯৮৮ সালে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার পথ তারা পাড়ি দিয়েছিল মাত্র ১০ দিনে। পঙ্গপালের ঝাঁক এক বর্গকিলোমিটারে থেকেও কম হতে পারে, আবার কয়েকশো বর্গকিলোমিটারও হতে পারে।

বিজ্ঞানীরা হিসাব কষে দেখেছেন, প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪ থেকে ৮ কোটি পঙ্গপাল থাকতে পারে। ওড়ার পথে একটি পূর্ণাঙ্গ মরু পঙ্গপাল প্রতিদিন প্রায় দু’ গ্রাম পর্যন্ত খাবার খেতে পারে। পঙ্গপাল ঝাঁকের বিস্তার যদি এক বর্গ কিলোমিটার হয় এবং তাতে যদি চারকোটি পঙ্গপাল থাকে, তাহলে হিসেব মতো তারা প্রায় ৩৫,০০০ মানুষের একদিনের খাবারের সমান খাবার খেতে পারে।
১৯৯৩ সালের পর এই প্রথম পাকিস্তানসংলগ্ন ভারতে পঙ্গপালের আক্রমণের শিকার। প্রাণিবিদ, ভূতত্ত্ববিদ এবং আবহবিদদের মতে ভারতমহাসাগর তথা অন্যান্য মহাসাগরে প্রতিনিয়ত নিম্নচাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে মরুঅঞ্চলে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ফলে তৈরি হচ্ছে অনুকূল পরিবেশ। সবুজে ভরে যাচ্ছে মরুঅঞ্চল, ফলে এই পরিবেশে পঙ্গপাল ব্যাপকভাবে বংশবিস্তার করছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা এতই বেশি যে ওই অঞ্চলে ফসল এবং সব্জিতে তাদের পেট ভরছে না। ধীরে ধীরে তারা উড়তে শুরু করছে। সেই সঙ্গে আবারও বৃদ্ধি পাচ্ছে তাদের সংখ্যা। এভাবে হাজার হাজার কিলোমিটার অঞ্চল তারা পাড়ি দিচ্ছে।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও,পর্ব-১৫: দেবদেউল কথা ও গোসানিমারি কামতেশ্বরী মন্দির

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৭: মা সারদার ভগবতী সাধনা

যখন সবজের অভাব ঘটে, তখন অনেক ক্ষেত্রেই পেট ভরানোর জন্য তারা নিজেদের কেই খেতে শুরু করেছে, অর্থাৎ তারা ক্যানিবলিজিম্ দেখাচ্ছে। এই সময় মস্তিষ্কের আকৃতি বৃদ্ধি পায়, মস্তিষ্ক থেকে শেরাটোনিনের ক্ষরণ বৃদ্ধি পায়। ফলে তারা আরও বেশি ভয়ানক হয়ে ওঠে ও ব্যাপক পরিমাণে নিজেদেরকে খেতে শুরু করে। বিশ্ব উষ্ণায়ন যত বৃদ্ধি পাবে, মহাসাগরে তত সাইক্লোন ও নিম্নচাপ সৃষ্টি হবে। ফলে শুষ্ক ও রুক্ষ অঞ্চল তত বৃষ্টিস্নাত হয়ে, যা পঙ্গপালের সংখ্যাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে।

কী করে বাঁচবো আমরা? এর উত্তর একটাই। বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমন হ্রাস করতে হবে, বৃদ্ধি করতে হবে সবুজ গাছপালার সংখ্যা। ফলে পরিবেশ হবে স্বাভাবিক। যে স্থানে যেমন আবহাওয়া, সেই স্থানে তেমন আবহাওয়াই থাকবে। ফলে পঙ্গপালের ন্যায় অবাঞ্ছিত উপদ্রব বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content