শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


সারদা মা।

বেলুড়মঠ প্রতিষ্ঠার পর স্বামিজি প্রথম দুর্গোৎসব শুরু করেন। মা সারদার নামেই পুজোর সংকল্প করা হয়। তখনই তিনি পুজোয় পশুবলি বন্ধের নির্দেশ দেন। প্রথমবার পুজোয় পুরোহিত ছিলেন কৃষ্ণলাল। শশীমহারাজের বাবা ঈশ্বরচন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন তন্ত্রধারক। সেই পুজোয় শ্রীমায়ের হাত দিয়ে তন্ত্রধারককে পঁচিশ টাকা প্রণামী দিয়েছিলেন স্বামিজি। পুজোতে সারদামা পশুবলি নিষিদ্ধ করায় তাঁর বাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজোতেও বলি হত না। তিনি প্রকাশ্যে ভক্তির নামে নিষ্ঠুরতা মেনে নিতে পারতেন না। তবে কেউ আমিষাশী হলে তাকে মাংস খেতে নিষেধ করেননি।
একবার বর্ধমানের শ্যামাচরণ চক্রবর্তী মাঘমাসের গোড়ায় জয়রামবাটিতে মা সারদার কাছে এসে বলেছিলেন যে বলি কি একেবারে বন্ধ। শ্রীমা জানতে চেয়েছিলেন যে, কেন জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে। শ্যামাচরণ দ্বিধান্বিত হয়ে বলেন, ‘মানে, বাড়িতে তো মাংস খাওয়ার চল আছে, মানে ভক্তিভরেই …’। সারদা মা হেসে বলেন, ‘ভক্তি নয়, বাবা, পাঁঠার মাংস সুস্বাদু জিনিস, পেলেই লোকে খাবে। তবে বলি নিজহাতে দিও না। যে হাত দিয়ে খাবে, সেই হাতেই প্রাণীহত্যার পাপ নিও না’।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৬: শ্রীমায়ের সাধনা

শারদীয়ার গল্প-৪: সীমানা ছাড়ায়ে…

মঠের দুর্গাপুজোয় আজ ১৬ অক্টোবার ১৯১২, বুধবার, দেবীর বোধন। সারদামা আজ বিকেল বেলায় মঠে আসবেন। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। মায়ের আসতে দেরি দেখে বাবুরাম মহারাজ ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করছেন। মঠের প্রবেশদ্বারে মঙ্গলঘট ও কলাগাছ স্থাপন করা হয়নি দেখে তিনি বলেন, ‘এখনও স্থাপন করা হয়নি, মা আসবেন কি’? এমন সময় মার গাড়ি মঠে ঢোকে। সারদামা গোলাপমায়ের হাত ধরে নেমে সব দেখে বললেন, ‘সব ফিটফাট, আমরা যেন সেজেগুজে মা-দুর্গাঠাকুরণ এলুম’। অষ্টমীর দিন সেবার প্রায় তিনশ’ লোক মাকে প্রণাম করেছিল। উত্তরের দিকের বাড়িতে শ্রীমা ও স্ত্রীভক্তদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দক্ষিণের ঘরে সারদা থাকতেন। তক্তপোশের ওপর পশ্চিমদিকে পা ঝুলিয়ে বসে তিনি সকল ভক্তদের প্রণাম নিতেন। এর মধ্যে তিন-চারজন ভক্ত তাঁর কাছ থেকে মন্ত্রও নিলেন।
বিকেলবেলায় গিরীশবাবুর বোনের মৃত্যুপ্রসঙ্গ উঠলে সারদা বলেছিলেন, ‘আর মানুষ, এই আছে, এই নেই। কিছুই সঙ্গে যাবে না। একমাত্র ধর্মাধর্মই সঙ্গে যাবে। পাপপুণ্য মৃত্যুর পরও সঙ্গে যাবে’। বোধনের দিন রাতে হঠাৎ গিরীশবাবুর বোন চলে যান। জনৈক মহিলাভক্ত রাতে হঠাৎ মা সারদার কাছে যায়। শ্রীমা ভক্তটির আগ্রহ দেখে বলেন যে, এইরকম টান না হলে তাঁকে কি পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১১: আমার নাম, তোমার নাম— তুং নাম, তুং নাম!

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২১: ওঠো ওঠো রে! বিফলে প্রভাত বহে যায় যে!

বিজয়ার দিন ডাক্তার কাঞ্জিলাল মাদুর্গার ভাসানের নৌকোয় উঠে নানারকম মুখভঙ্গি করে রঙ্গ করছিলেন আর তাই দেখে অনেকেই হাসছিলেন। এই দেখে একজন রুচিশীল ব্রহ্মচারি খুব রেগে যান। উত্তরের বাগানে থেকে শ্রীমাও এইসকল কাণ্ড দেখছিলেন এবং আনন্দিত হচ্ছিলেন। সারদাকে জানান হল যে ডাক্তার দুর্গাপ্রতিমার সামনে অঙ্গভঙ্গি করায় তাকে তিরস্কার করা হচ্ছে। সারদামা বললেন, ‘না, না, এসব ঠিক। গানবাজনা, রঙ্গব্যঙ্গ—এসব দিয়ে সকল রকমে দেবীকে আনন্দ দিতে হয়’।
পুজোর কয়েকদিন থেকে বিজয়ার পরদিন শ্রীমা কলকাতায় ফিরে আসেন। করুণাময়ী মায়ের এত দয়া সারদার ওপর যে অষ্টসখী পরিবৃতা হয়ে তাঁকে কৃপা করেছেন, ভালোবেসেছেন আর আগলে রেখেছেন। একথা সারদা নিজের মুখে ভক্তদের কাছে বলেছেন। তিনি মহিলা ভক্তদের বলতেন, ‘দেখ, আমার শ্বশুর ছিলেন বড় তেজস্বী নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। কারো দান গ্রহণ করতেন না। কিন্তু দেবদ্বিজে তাঁর বড় ভক্তি ছিল।

মা শীতলা তাঁর সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন। রোজ শেষরাতে উঠে ফুল তুলতে যাওয়া ছিল তাঁর অভ্যাস। একদিন লাহাদের বাগানে গেছেন ফুল তুলতে, এমন সময় একটি ন’বছরের বালিকা তাঁকে ডেকে বলে, ‘বাবা, এদিকে এস। এ দিকের ডালে কত ফুল ফুটেছে। নুইয়ে ধরছি, তুমি তোল’। তিনি বলেন যে এ সময় এখানে সে কে? ‘মেয়েটি বলে,’আমি গো এই হালদার বাড়ির’। অমন মানুষ ছিলেন বলেই স্ব্য়ং ভগবান তাঁর ঘরে জন্মেছেন। এই কথা শুনিয়ে সারদা একটু হাসেন।
আরও পড়ুন:

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-১২: শতাব্দী প্রাচীন কোচবিহারের মদনমোহন ঠাকুর মহারাজাদের কূলদেবতা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

১৯১৬ সালে শ্রীমা মঠের মন্দিরে ঠাকুর প্রণাম করে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। দুর্গাপুজো উপলক্ষে তিনি মঠে এসেছেন। বিকেলবেলায় মঠের ব্রহ্মচারি সাধুরা কুটনো কুটছিলেন। সারদা গ্রামের মেয়ে, ছেলেরা কুটনো কুটছে দেখে তিনি অবাক হয়ে বলেই ফেলেন, ‘ছেলেরা তো বেশ কুটনো কোটে’। সেই ছেলেদের দলে তখন জগদানন্দজি ছিলেন। তিনি হঠাৎ বলে ওঠেন যে ব্রহ্মময়ীর প্রসন্নতা লাভই হল উদ্দেশ্য, তা সাধন, ভজন করেই হোক আর কুটনো কুটেই হোক। সেইসময় সারদার সঙ্গেই ছিলেন ভক্ত প্রফুল্ল, সে বলে উঠল, ‘মা ভয় হয় তোমার মতো মা পেয়েও কিছু যেন হল না মনে হয়’। মা সারদা তখন বলেন যে, ভয় কিসের, সর্বদা ঠাকুর সকলের সঙ্গে আছেন। ‘আমি রয়েছি, আমি মা থাকতে ভয় কি’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content