রবিবার ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


প্রকৃত ধর্ম ভ্রম সৃষ্টি করে না, বরঞ্চ ভ্রম দূর করাতে চেষ্টা করে। প্রত্যেকে জগতের সত্যতার ভ্রমে পড়ে রয়েছে। ধর্ম সাধনার দ্বারা বুঝতে পারে, ঘটায়মান ঘটনার নিরন্তর প্রবাহ হলে জগৎ। যার স্থায়ীত্ব ক্ষণিকের। অনেক সময় বলে থাকি দুঃখ-কষ্ট জীবনের সঙ্গী। কিন্তু কেন? কারণ প্রত্যেকে সুখ চাই। প্রতিটি জীবের স্বাভাবিক বৃত্তি হল সুখ খোঁজা। প্রতিটি জীব সুখ খোঁজে কেন? কারণ, যে যত উন্নত বা অনুন্নত জীব হোক না কেন, সুখ খোঁজায় তার স্বাভাবিক ধর্ম।
আরও গভীরে বললে বলতে হয়, তার স্বরূপ যে ‘আনন্দ’। সে প্রকৃত তাঁর সঙ্গে একান্ত হতে চায়। কিন্তু সমস্যা খুঁজতে নয়, সমস্যা হচ্ছে কার মধ্যে বা কি থেকে সে সুখ চায়! প্রত্যেকে বিষয়ে ভোগে বা ভাবনায় সুখ খুঁজে বলে। ইন্দ্রিয়গুলি যে যে বিষয় থেকে সৃষ্ট সেই সেই বিষয়ের প্রতি তার আকর্ষণও সর্বাধিক। স্বাভাবিকভাবেই সেই বিষয়ের দিকে সে ধাবিত হয়। কিন্তু বিষয় ভোগের মধ্যে সুখ চাই। কিন্তু, বিষয়ে বা প্রকাশিত প্রতিটি বস্তুতে যে সুখ নাই তা নয় আছে, কিন্তু সে মাত্রাতে অনেক কম। সে আরও ভোগ করতে চায় আরও সুখ পাবে বলে।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৪২: দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এনে ঈশ্বরে সর্মপণ করলে ভক্তি-মুক্তি দুই-ই লাভ হয়

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১১: কার মন ভোলাতে এলে তুমি আজ…

ছান্দোগ্য উপনিষদে আছে, “যঃ বৈ ভূমা তৎ সুখম্ ন অল্পে সুখম্ অস্তি” যাহা ভূমা, সর্বাধিক, সর্বশ্রেষ্ঠ তাহাই সুখ, অল্পে সুখ নাই। পৃথিবীব্যাপী যে সুখ তা কখনও অল্প বিষয় ভোগের মধ্যে পাওয়া যাবে না, আবার, যখন না পায় তখন রাগ, দ্বেষ ও দুঃখ হয়। এখন প্রশ্ন, অনাসক্ত হওয়া যায় কিনা। হওয়া যায়। যৎ ইচ্ছা লাভ সন্তুষ্ট। ‘সন্তোষ এর মতো ধণ আর নেই।’ সন্তোষ একমাত্র উপায় অনাসক্ত হওয়ার। সত্য সত্যই এখানেই ধর্ম উৎপন্ন হয়। ধর্ম আমাদের ক্ষণিক সুখ-ভ্রম দূর করে, আত্যন্তিক দুঃখ দূর করে, আনন্দ লাভ করায়। যে নিরন্তর নিরবিচ্ছিন্ন আনন্দ। যে শেষ হওয়ার নয়।
নারদীয় ভক্তি-সূত্রে রয়েছে…”যল্লব্ধ্যা পুমান্ সিদ্ধো ভবতি অমৃতো ভবতি তৃপ্তো ভবতি”, যা লাভ করলে মানুষ পূর্ণ হয়ে যায়, অমৃত স্বরূপ হয়ে যায়, অমর হয়ে যায়, পূর্ণ তৃপ্তি লাভ করে। আর কোন রূপ প্রত্যাশা থাকে না। ধর্ম লাভে ভক্তের আমিত্বের ভ্রম দূর হয়ে, তুমি-তে পরিণত করে। কাঁচা আমি ও আমার জগত থেকে, পাকা আমি ও তোমার জগতে পরিণত করে। যে ভ্রম জগতকে বাস্তবিকই, সত্যই সত্যই আমার দ্বারা আচ্ছাদিত করে ছিল, সে গণ্ডি ভেঙে যায় তখন ঈশ্বরের জগতে পরিণত হয়। ঈশ্বরের ঘরবাড়ি, স্ত্রী, পুত্র, সমস্ত কিছু সেই ভাবে এই জগতের প্রতি মমত্ব কমে ঈশ্বরের জগতের প্রতি প্রেম হয়। ভক্ত জগতে থাকে বটে কিন্তু, জগৎ আর কিছু ক্ষতি করতে পারে না। সে প্রতিটি জিনিসের রক্ষণাবেক্ষণ করে কিন্তু ঈশ্বরের জ্ঞানে।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২১: ওঠো ওঠো রে! বিফলে প্রভাত বহে যায় যে!

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-১২: শতাব্দী প্রাচীন কোচবিহারের মদনমোহন ঠাকুর মহারাজাদের কূলদেবতা

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “মদের নেশা কমাবার জন্য একটু একটু চালুনির জল খেতে হয়। তাহলে ক্রমে ক্রমে নেশা ছুটতে থাকে।” চাল ধুয়ানো জল খাওয়ালে নেশা কেটে যায়। তখন নেশা জনিত ভ্রমও কেটে যায়। রঙিন কাঁচের মধ্যে দিয়ে জগতকে দেখলে যেমন দেখায়, তেমন আর সাদা কাচের মধ্যে দিয়ে জগৎকে দেখায় না। বাস্তবিক জীবের ভ্রম উৎপন্ন হয় না। ভ্রম থেকেই জীব শরীর ধারণ করে। যে সর্বদা মুক্ত স্বভাব সে দেহ ধারণ করে বদ্ধ হয়ে যায়। সে নিজেকে শরীরের সঙ্গে এক করে নেয়। এ ভ্রম থেকে মুক্তির উপায়, ‘আলেক নিরঞ্জন’ মন্ত্র। মহীয়সী মাদালসা যা তাঁর পুত্র দের শুনাতেন প্রতিদিনই। এই মন্ত্র, ভ্রম দূর করে প্রকৃত রূপ চিনিয়ে দিতে পারে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২৬: কৌশলে যে কাজ সিদ্ধি করা যায়, সে কাজ শুধু বলপ্রয়োগে সম্ভব নয়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪২: অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই গন্ডগোল?

স্বামী বিবেকানন্দ, মানুষের যথার্থ স্বরূপ প্রবন্ধে বলছেন, “তুমিই আমি, আমিই তুমি—ইহাই তোমার স্বরূপ প্রকাশ করে, তোমাকে পবিত্র হইতে হইবে না। তুমি পবিত্র স্বরূপই আছ, তোমাকে পূর্ণ হইতে হইবে না তুমি পূর্ণ স্বরূপই আছ। সমুদয় প্রকৃতিই যবনিকার ন্যায় তাহার সত্যকে ঢাকিয়া রাখিয়াছেন। তুমি যেকোনও সৎ চিন্তা বা সৎ কার্য কর তাহা যেন শুধু আবরণকে ধীরে ধীরে ছিন্ন করিতেছে। আর সেই প্রকৃতির অন্তরালে শুদ্ধ স্বরূপ অনন্ত ঈশ্বর প্রকাশিত হইতেছেন।”

জাগো মুশাফের। সময় অল্প, মন আয়না পরিষ্কার করে মুখ দেখতে পাবে। ভ্রম সরে গিয়ে সত্য রূপ প্রকাশ হবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content