বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর, ২০২৪


বনভোজন পিকনিক বা ফিস্ট যাই বলি না কেন, এ সব ক্ষেত্রে ভোজ বলতে এক বিশাল এলাহি আয়োজনের কথাই মনে আসে। চোখের সামনে বিরিয়ানি মুর্গ-মুসসাল্লাম এ সব খাবারের ছবি ভেসে ওঠে। কিন্তু আমাদের সেই বনভোজনে অতশত ছিল না। পরম তৃপ্তিতে খেয়েছিলাম। সুগন্ধি চালের সুস্বাদু খিচুড়ির সঙ্গে পাঁপড়ভাজা বেগুনি টম্যাটো খেজুরের চাটনি। একটু একটু মনে পড়ছে আমরা ছোটরা গিয়ে ঘাসে লম্বা করে পাতা শতরঞ্জির ওপর বসে সটান খেতে শুরু করে দিলাম। আর বড়রা পরিবেশন করছিলেন। আর যে ছবিটা এখনও স্পষ্ট তা’হল মাসিও প্যাকেট থেকে কুড়মুড়ে ঝালঝাল চানাচুর আমাদের সবাইকে পাতে পাতে পরিবেশন করছেন। বিরিয়ানি কালিয়া কোপ্তা নয়, কিন্তু সেদিনের সেই স্নেহের পরশ আজও যেন আমাকে ছুঁয়ে আছে।
আজও আমায় স্পর্শ করে আছে গানঘরে বসে শোনা তাঁর অনেক অনেক গান। এখনও মাঝে মাঝে গুনগুনাতে ইচ্ছে করে বারবার মাসির গলায় গাওয়া সেই ভালোলাগা বহু প্রশংসিত গান “যবে ঝরা পাতা এলোমেলো ওড়ে”। গানটি এইচএমভি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এলোমেলো স্মৃতিগুলো উড়ছে ঝরা পাতার মতোই।
গানশেখা শেষ হলে আমরা দু’ তিনজন যারা একটু ছোট তাদের মাসি কখনও সখনও বলতেন—‘যাও একটু ঘুরে এসো।’
আরও পড়ুন:

ফেলে আসা স্মৃতি: সুরসম্রাজ্ঞী দীপালি নাগ, পর্ব-৪: গানের সঙ্গে তবলা বাজাতেন মাসি নিজেই

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৯: অনেক যতনে ‘বড়দিদি’-র পর্ব রাখিনু সেথা

আমরাও সিঁড়ি দিয়ে সোজা ওপরে চলে যেতাম। ওপরে ওঁর শোবার ঘর। সে ঘরে কয়েক মিনিট এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে আবার নেমে আসতাম। কখনও উঁকি মেরে দেখতাম নিচে থেকে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার মুখেই গানঘরের ঠিক বামদিকে একদম ছোট্ট একটা ড্রেসিংরুম। এমনও হয়েছে কোন এক পুজোর সময় কাকামণির বাড়ি সেনহাটি কলোনিতে গিয়েছি। আমি আমার বোন জুলু (ইন্দ্রাণী) আরও সব সমবয়সীরা মিলে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছি। রাস্তাঘাট কিছুই চিনি না।
আরও পড়ুন:

দেশের প্রথম আধুনিক চিত্রকর নিরীহের হত্যা মানতে না পেরে গৃহত্যাগী হন

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৬: সুন্দরবনের লৌকিক দেবতা পঞ্চানন্দ বা বাবাঠাকুর

প্রতি সপ্তাহে বাবা নিয়ে আসেন। তেমনি সেদিন কাকামণির সঙ্গে সঙ্গে চলেছি। হঠাৎ দেখি ওমা গো, দেখতে দেখতে মাসির বাড়ির গলির পুজো প্যান্ডেলে চলে এসেছি। আমি তো খুশিতে ডগমগ। বললাম—

আরে এই বাড়িতেই তো আমি গান শিখতে আসি!

কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে গেট খুলে সব্বাইকে নিয়ে হুড়মুড় করে গিয়ে দরজায় বেল দিলাম। দরজা খুললেন গণেশদা। রান্না থেকে শুরু করে মাসির বাড়ির দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন গনেশদা। বললেন, মাসি নাকি সেদিনই সকালে দিল্লি চলে গিয়েছেন। আর গণেশদাও পরের দিন দেশে যাবেন।

জল খাবে তোমরা?

মাথা নাড়তেই জল এলো। জলটল খেয়ে বেরিয়ে এলাম। সেই বাড়ি ছিল যেন সকলের কাছে এক অবারিত দ্বার। প্রবেশে কোন বাধানিষেধ ছিল না।

কত না সম্মানীয় মানুষের ছিল আনাগোনা ওই বাড়িতে। আর নিউ ইয়ার্সের পর বাড়ির সিঁড়িতে নীচ থেকে ওপরতলা রংবেরঙের গ্রিটিংস কার্ডের সম্ভারে সাজানো-দারুণ মজা লাগতো দেখতে।

প্রবাদপ্রতিম ড. বিডি নাগ চৌধুরী।

সারা বাড়িতে অসংখ্য ছবি। মাসির সঙ্গে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সেতারের জাদুকর পণ্ডিত রবিশঙ্কর। টিভিতে কাগজে এঁদের পরিচয় সবার জানা। আর ড. নাগচৌধুরির সঙ্গে কতো কতো বিশিষ্টজনের ছবি! যাঁদের ওই বয়সে চিনতাম না। এ প্রসঙ্গে একটা হালের অভিজ্ঞতা শোনাই।
আরও পড়ুন:

যত মত, তত পথ, পর্ব-৭: ঈশ্বরে মনে রেখে সংসার ধর্ম—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪২: বাস কোথা যে পথিক — এবার কি গন্তব্য সুতীক্ষ্ণমুনির আশ্রম?

যদিও আমি নিজে খুব একটা দেখি না কিন্তু আমাদের বাড়িতে টিভির খবর বা সিরিয়ালের তুলনায় ওটিটি-র নানা ভাষার ছবি আর ওয়েব সিরিজ বেশি চলে। একদিন একটা ওয়েব সিরিজে অবাক হয়ে দেখলাম, আমাদের দেশের নামি বিজ্ঞানীদের নিয়ে গল্প। গল্পের চরিত্রদের কথা সব্বাই পড়েছে। ড. হোমি ভাবা, ড. বিক্রম সারাভাই, ড. এপিজে আব্দুল কালাম। সেখানেই একটি দৃশ্যে আরেক পরমাণু বিজ্ঞানী ড. রাজা রামান্না, ড. বিডি নাগচৌধুরির সঙ্গে ড. কালামের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন।

ছবি: সংগৃহীত।

ড. নাগচৌধুরি এসেছেন ডিআরডিও বা ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন থেকে। আচমকা মুখ থেকে বেরিয়ে এল।

এমা! ড. নাগ চৌধুরিকে একদম মানায়নি!

কেন?

আমি দেখেছি তো। লম্বা। রাশভারী। অনেকটা সিনেমার কমল মিত্রের ধরণ। পাজামা পাঞ্জাবির ওপর হাউসকোট চাপানো। হাতে চুরুট। মোটা ফ্রেমের চশমা। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন।—চলবে।
* লেখিকা চন্দ্রাণী সরকারের ভালোবাসা গান, সংসার, বেড়ানো, ভ্রমণকথা লেখা।

Skip to content