শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


শবনমের থেকে বুনি মারফত অনেকটা জানতে পারলাম। যেটা প্রথম দিন শবনমের সঙ্গে কথা বলার পরও অজানা থেকে গিয়েছিল।

ফিরোজের বন্ধু পরিচিত এই উপকারী শেখটিকে একবারই দেখেছে আফিফা। একটুও পছন্দ হয়নি। সহ্য করতে পারিনি সে। ছোট ছোট কুতকুতে চোখ। লালচে সে চোখে তীব্র লালসা।

আফিফা সন্দেহ করে ওই শেখ নির্ঘাৎ ফিরোজকে কোন একটা ঝামেলায় ফাঁসিয়েছে। কিন্তু ফিরোজ বড্ড একরোখা। বাধা বারণ কানে তোলে না তার ওপর যখন যাকে সে বিশ্বাস করে তাঁর সম্বন্ধে কোনও সাবধানবাণী সে শুনবেই না।

সেদিন সিডিটা চালাবার পরই সে বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু এক ঝলক যা মনে আছে, যে মেয়েটাকে ওখানে অশ্লীলভাবে দেখা গিয়েছে মেয়েটাকে সে দেখেছে। মেয়েটা তার খুব চেনা। কিন্তু কোথায় যে দেখেছে কিছুতেই আন্দাজ করতে পারছে না।

এমন নয় যে এই পর্ন ভিডিও ব্যাপারটা সে জানে না। আসানসোল স্কুলে পড়ার সময় ক্লাস নাইন টেনে কানাঘুষোয় এ সব শুনতো। স্কুলের কিছু অতি পাকা বান্ধবীরা এসব নিয়ে খোলাখুলি আলোচনাও করতো। দুবাইতে সেই দুপুর বেলার আগে কখনও এই ভিডিওর মুখোমুখি হয়নি আফিফা।
এর কিছুদিন পরেই ফিরোজের ফ্যাশন ডিজাইনিং শোরুমের বিজ্ঞাপন আফিফার হাতে এল। মেয়েটার মুখ দেখে চমকে উঠল আফিফা। এই মেয়েটা! এ তো এই মেয়েটাই! অনেক সংকোচ কাটিয়ে একদিন রাতে খাওয়ার সময় ফিরোজকে জিজ্ঞেসই করে ফেলল—

—এই মডেল কি এখানকার নাকি ইন্ডিয়ার?
ফিরোজ থমকে একবার তাকালো তারপর জবাব দিল—

—ইন্ডিয়ার। এখানকার মডেল অনেক কস্টলি।

—ইন্ডিয়া থেকে এখানে মডেলিং করল?

—না, করার কি আছে? পয়সা পেলেই করবে। তবে এসব আমার ডিপার্টমেন্ট নয়। শেখ সাহেবের এজেন্সি থেকে সব বানায়। কেন তুমি মডেলিং করবে নাকি?
আফিফা জবাব না দিয়ে উঠে গিয়েছিল।
সেদিন আমি দুর্বল হইনি।

আফিফার যন্ত্রণা ছোট্ট মাসুদার ভয়ংকর পরিণতি হয়েছিল সেটা উপলব্ধি করে কষ্ট পেয়েছি খুব। কিন্তু আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিলাম। আমি জানতাম ঈপ্সিতা চ্যাটার্জি অত্যন্ত ব্যস্ত। বারবার আমাদের এভাবে সময় দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। আফিফা আর অজানা ইতিহাসের সবটুকু আমাকে আজই জানতে হবে। সরাসরি আফিফার কাছ থেকে।

সেই ভয়ংকর উত্তেজক অনুভূতিটা, ক্রমশ থিতিয়ে এল ঘরটা আবার আগের মতো। না আছে কালো ধোঁয়ার কোনও অনুভূতি না পোড়া চামড়া পোড়া মাংসের তীব্র কটূ গন্ধ। মোমবাতির শিখা কাঁপতে থাকছে ছড়িয়ে পড়ছে মোমবাতির সুগন্ধ। সাদা পর্দা গুলো খুব ধীরে ধীরে হাওয়ায় দুলছে। শোনা গেল ইঈপ্সিতা চ্যাটার্জির ফ্যাসফ্যাসে গম্ভীর কণ্ঠস্বর।
আফিফার কথা ভাবুন। আফিফাকে ফিরিয়ে আনুন! আফিফা! মাসুদা! তোমরা কি এখানে আছো। আমরা তোমাদের কথা শুনতে চাই। আফিফা আমরা অপেক্ষা করছি।
আরও পড়ুন:

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-২১: এতক্ষণ নড়তে থাকা হাত-পা ক্রমশ এলিয়ে পড়ল

ফেলে আসা স্মৃতি: সুরসম্রাজ্ঞী দীপালি নাগ, পর্ব-৪: গানের সঙ্গে তবলা বাজাতেন মাসি নিজেই

আরও কিছুক্ষণ একই রকম নৈঃশব্দ্য। আমি ভাবছি আবার সেদিনের মতো আফিফাকে হারিয়ে ফেললাম? আজও জানা হল না সত্যি কেন এভাবে ওদের দু’জনকে চলে যেতে হল। দু’ দুটো প্রাণ চলে গেল অথচ খুনির কোন শাস্তি হবে না? কোনও প্রমাণ নেই এই জঘন্য অপরাধের?
আমাকে চমকে দিয়ে ঈপ্সিতা তার জায়গায় বসেই আফিফার কন্ঠে ও ভঙ্গিতে আমাকে বলতে লাগলো।

—না নেই। আমাদের দু’ জনের নিথর দেহ বিছানার সাদা চাদরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রান্নাঘরে রেখে এসেছিল ফিরোজ। গ্যারেজের একটা ছোট জেরিকেনে পেট্রোল রেখে দেওয়া ফিরোজের বহুদিনের স্বভাব। সেই পেট্রল এনে আমাদের শরীরটা ভিজিয়ে দিয়েছিল রান্নাঘর ছেড়ে আসার আগে গ্যাসটা খুলে দিয়েছিল। দরজা দিয়ে বেরোবার ঠিক আগের মুহূর্তে দেশলাই কাঠি ঘরের ভেতর ফেলে লোহার দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। নেরুলের ওই ভাড়াবাড়িতে রান্নাঘরটা বাড়ির অন্য অংশের থেকে আলাদা এবং রান্না ঘরের দরজাটা লোহার।

খানিকটা থেমে থাকার পর আসিফার জবানিতে আবার কথা শুরু করলেন ঈপ্সিতা।

—কয়েকটা ব্যাপারে আমার খুব সন্দেহ হয়েছিল। বম্বেতে আন্ধেরি ইস্টের জেবি নগর সার্কেলের কাছে ফিরোজের দু’ কামরার ফ্ল্যাট ছিল। দুবাই থেকে সেখানে এসে উঠলেও কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমরা নেরুলে চলে গেলাম। অনেক বেশি টাকায় সে বাড়িটা ভাড়া দিয়ে দিল। জায়গাটা খুব ভালো। সাহার এয়ারপোর্ট একদম কাছে। কাছেপিঠে অনেক স্কুল মাসুদার পড়াশোনার সুবিধা হতো। আমি নেরুল আসতে চাইনি। বলেছিলাম সে কথা। তখন নিরুল আমি চিনতাম না। কিন্তু মেন বোম্বে থেকে যে অনেকটা দূর সেটা আন্দাজ করেছিলাম। ফিরোজ বলল এখন সেরকম রোজগারপাতি নেই। মেয়ে ছোট। নেরুলের ভাড়া কম। ওখানে থাকতে শুরু করি তারপর মেয়ে একটু বড় হলে আমরা আবার আন্ধেরি ফিরে আসবো। আমি ফিরোজের কথায় সায় দিয়েছিলাম।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৯: খাবারে একদম মশলা নয়?

পালকিতে যেতে যেতে লেখা হয়েছিল ‘বর্ণপরিচয়’

নেরুল আসার কিছুদিন পর ফিরোজ গোপনে দুবাইতে কথা বলতো এটা আমি বুঝতে পারতাম। দুবাইতে সেক্স রাকেটের এর ব্যাপারে পুলিশ খুব কড়া। তবে ফিরোজের বন্ধু শেখ-এর অনেক জানাশোনা। পুলিশ তাকে স্পর্শ করেনি। সেই ফিরোজকে আগেভাগে সব জানিয়ে দুবাই থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এখন সে বিনিময়ে ফিরোজকে নতুনভাবে এই ব্যবসায় কাজে লাগাতে চায়। অর্থের প্রলোভন এতটাই বেশি ফিরোজের না বলার ক্ষমতা ছিল না। সে ভারত থেকে দুবাইতে মেয়ে পাচারের চক্রে জড়িয়ে পড়ল। আমি প্রতিবাদ করায় ফিরোজ ভয়ংকর হয়ে উঠলো। দুবাইতে আমার অনেক ভয় ছিল বিদেশ বিভুঁই! নিজের দেশে আর কোন ভয় নেই। আমি ফিরোজকে নিয়ে আমার মেয়েকে নিয়ে একটা নিশ্চিন্ত সংসার চেয়েছিলাম।

তাই ফিরোজকে আবার বিপদে পড়তে না দেওয়া আমার কর্তব্য ছিল। ফিরোজকে যখন বোঝাতে পারলাম না তখন ঠিক করলাম আমি পুলিশকে সব জানাবো। ফিরোজ বাড়িতেই থাকতো শেখের জন্য কাজের তদারকি করতো আর ব্যাংকে শেখের টাকা ঢুকতো। আমার পক্ষে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পুলিশ স্টেশনে খবর দেওয়া সম্ভব ছিল না। আমি সব জানিয়ে গোপনে একটা চিঠি লিখলাম। ভেবেছিলাম পুলিশ স্টেশনের ঠিকানায় লেখা চিঠিটা কোনওভাবে বাড়ির কাজের লোককে দিয়ে পোস্ট করে দেব। চিঠিটা লুকিয়ে রেখেছিলাম কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য ফিরোজ সেটা খুঁজে পেয়ে গেল। মাঝরাতে আমাকে জোর করে ঘুম থেকে ডেকে চিঠিটা দেখিয়ে তর্ক করতে শুরু করল। আমি এতদিন সবকিছু মেনে নিয়েছিলাম কিন্তু সেদিন আর পারিনি। বলেছিলাম আমি বেঁচে থাকা পর্যন্তই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবোই। রাগে ফিরোজ আমাকে প্রথমে ধাক্কা মারলো খাটের কোণাতে দাগ ছিটকে পড়ে আমার কপাল ফেটে গেল।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৬: আজগুবি ‘নয়’, আজগুবি নয়, সত্যিকারের কথা!

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৫: সুন্দরবনের বিসূচিকা রোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ওলাবিবি

আমি বুঝতে পারছি যে ঈপ্সিতা চ্যাটার্জির মধ্যেও আফিফার যন্ত্রণা একটু একটু করে চারিয়ে যাচ্ছে। যখন কথা বলছিলেন মানে আফিফা যখন কথা বলছিল আফিফার যন্ত্রণা স্পষ্টভাবে ওঁর মধ্যে দিয়ে ব্যক্ত হচ্ছিল—

—আমার কপালে অনেকটা কেটে গেল সারা মুখ দিয়ে গরম রক্ত গড়িয়ে নেমে আসছে। ঘুমন্ত মাসুদা চেঁচামেচির মধ্যে উঠে পড়েছে। আমাকে ওই অবস্থায় দেখে সে চিৎকার করে উঠলো। আমি কোনওক্রমে ছুটে গিয়ে মাসুদাকে জড়িয়ে ধরলাম। সেই মুহূর্তে আমার এতোটুকু বাঁচতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু মনে হল মাসুদা যে একা পড়ে যাবে। আর মাসুদাকে এই জঘন্য লোকটার হাতে ছেড়ে যেতে আমার এতটুকু ইচ্ছে ছিল না। তাই চিৎকার করে বলেছিলাম আমাদের দু’ জনকে তুমি শেষ করে দাও। টাকার নেশায় পাগল হয়ে যাওয়া ফিরোজ এক মুহূর্তের মধ্যে বিছানার পাশে রাখা সাদা বড় চাদর দিয়ে আমাদের ঢেকে দিল আমি বাধা দিইনি। প্রাণপণে মাসুদা কে নিজের বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরেছিলাম। আর আল্লাহকে মনে মনে ডাকছিলাম। বলছিলাম আর একটুও বাঁচিয়ে রেখ না আমাদের। এখুনি এই মুহূর্তে আমাদের দুজনকে শেষ করে দাও।

হঠাৎ বুঝতে পারলাম ঈপ্সিতা চ্যাটার্জি একটা ভয়ংকর শ্বাসকষ্টের মধ্যে ছটফট করছেন। আমার ধরা হাতে টান পড়ছিল। এতক্ষণ আমি চোখ বুঝিয়ে আফিকার কথার মন দিয়ে শুনছিলাম। কিন্তু মহিলার এরকম অবস্থায় দেখে চোখ খুলতে বাধ্য হলাম। চোখ খুলে যা দেখলাম তাতে আমি স্তম্ভিত। ঈপ্সিতা চ্যাটার্জির কপাল থেকে সারামুখ রক্তাক্ত। ভয়ংকর শ্বাসকষ্টের মধ্যে কথা বলতে পারছেন না। ছটফট করছেন শরীরটা বেঁকে যাচ্ছে। তারপর একটা সময় আর পারলেন না আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সামনের তেপায়া টেবিলের ওপর মাথা গুঁজে পড়ে গেলেন টেবিলের ওপর রাখা মোমবাতিটা টেবিল থেকে ছিটকে পড়ল নিচে। আর মেঝের কার্পেটে আগুন ধরে গেল।—চলবে।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content