বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


 

মুক্তির তারিখ: ১৮/০১/১৯৫৭

প্রেক্ষাগৃহ: দর্পণা, ইন্দিরা ও প্রাচী

পরিচালনা: মানু সেন

উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: রজত

এল ১৯৫৭ সাল। যে বছর উত্তম কুমারের অভিনয় জীবন ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সোনার ফলকে লেখা থাকবে। এ বছরের কতগুলি বিশেষ বিশেষ ঘটনা যা ইতিহাসের সাক্ষী রূপে চিরকাল মানুষের কাছে ধরা দেবে সেগুলো প্রথম জেনে রাখা ভালো।
প্রেক্ষাপট বা প্রেক্ষিতটা হল এরকম—
উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন বা সুচিত্রা সেন ছাড়াও অন্যান্য নায়িকাদের সঙ্গে যথেষ্ট স্বচ্ছন্দ।
সাফল্যের যে রেটিং এ বছর দেখা দেবে ইতিপূর্বে বা ভবিষ্যৎ কালে কখনও তা ঘটেনি বা ঘটবে না।
উত্তম কুমার নিজে চলচ্চিত্র প্রযোজনায় নামবেন।
জাতীয় পুরস্কার লাভ করার জন্য উনি দিল্লি যাবেন (‘হারানো সুর’)
প্রথম গ্রেভা কালারে তৈরি বাংলা সিনেমা (‘পথে হলো দেরী’)-র নায়ক হিসাবে তার নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা হবে।
মেট্রো-র মতো অভিজাত সিনেমা হলে প্রথম বাংলা ছবি (‘চন্দ্রনাথ’) রিলিজ করবে। সৌভাগ্যবশত সেই ছবির নায়ক উত্তম।
উত্তম কুমার প্রথম দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করবেন। (‘তাসের ঘর’)।
এছাড়া বেশ কিছু নতুন পরিচালক ফিল্ম লাইনে হাত পাকিয়েছেন তাঁরাও উত্তম বাবুকে তাঁদের সিনেমায় মনোনয়ন করবেন এবং সিনেমাগুলি সুপার ডুপার হিট হবে। ঘটনার ঘনঘটা এমন দিকে মোড় নেবে যে পরপর চারটি হলের রিলিজিং চেনে চারটি আলাদা আলাদা ছবি রিলিজ করবে যার নাম ভূমিকায় থাকবেন উত্তম কুমার এবং সুচিত্রা সেন।

ভারতীয় সিনেমায় এ ঘটনা একমাত্র রাজেশ খান্নার জীবনেই ঘটেছে। পরপর তিনটি হলে আলাদা ছবি চলছে, তিনটি ছবি সিলভার জুবলি করছে। যা পৃথিবীর ইতিহাসে কোনও নায়ক নায়িকা হিসেবে সোনার জুটিতে ঘটেছে বলে মনে হয় না।

আমরা এ ধরনের একটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ৫৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলো আলোচনা করব। যদি সরলীকরণ করি তাহলে দেখতে পাবো, এ বছরই প্রথম মানু সেন তাঁর ছবিতে উত্তম কুমারকে কাস্ট করেন এবং এবছরের এ ছবির অর্থাৎ হার-জিত ছবির সাফল্যে উচ্ছসিত হয়ে একই বছর আরও একবার ‘পুনর্মিলন’ ছবিতে উত্তম বাবুকে নিয়ে কাজ করেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৭: সে কোন প্রভাতে হইল মোর সাধের ‘নবজন্ম’

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২২: কামুক পুরুষের সঙ্গ ছাড়া একজন নারীও একা কোনও দুষ্কর্মে লিপ্ত হতে পারে না

সন্তোষ গঙ্গোপাধ্যায় নামে একজন নতুন পরিচালক এ বছর উত্তম বাবুকে তাঁর ছবির জন্য মনোনয়ন করেন। সঙ্গে সঙ্গে চলছিল অজয় কর, নীরেন লাহিড়ী, অগ্রদূত, চিত্ত বসু প্রভৃতিদের পরিচালনায় অভিনয় করা। মঙ্গল চক্রবর্তী এবং তার ওপরে অসিত সেন যিনি একের পর এক কালজয়ী ছবির পরিচালক তিনিও একটি ক্লাসিক বাংলা ছবি ‘জীবন তৃষ্ণা’-য় উত্তম বাবুকে কাস্ট করেন।

এত কথা বলার উদ্দেশ্য হলো ১৯৫৭ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হলে আমাদের সবার আগে মানসিকভাবে প্রস্তুত এবং সচেতন থাকতে হবে যে এ বছরই ঘটবে সেই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো যেগুলো আগামী দিনে উত্তম বাবুকে মহানায়ক হবার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

উর্বর মস্তিষ্ক সমালোচকবৃন্দ সচরাচর বলে থাকেন সত্যজিৎবাবুর ছবিতে অভিনয় না করলে উত্তম বাবুকে খুঁজে পাওয়া যেত না। আবার কোন পরিচালককে তোল্লাই দিতে হলে সেই সমালোচকরা নির্দ্বিধায় বলেন অমুকের পরিচালনায় উত্তমবাবু উতরে গিয়েছেন। কি সুন্দর ছবিটার মেকিং! প্রশ্ন হল সত্যজিৎবাবুর ছবিতে অভিনয় করার পর বোধহয় উত্তম কুমার নিজেকে আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন, তাঁর আগে অভিনয় শিল্পটা তার বোধহয় আয়ত্ত ছিল না। কিন্তু এ সমস্ত কথাই একপেশে কথা। আমাদের সকলের যদি বাংলা চলচ্চিত্রের উত্তমাইজেশন ব্যাপারটা ফিল করতে পারি তাহলে দেখতে পাবো, ‘নায়ক’ ছবি নির্মাণের ১০ বছর আগেই সত্যজিৎবাবুর সঙ্গে একটি ছবিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ১৯৫৭ সালে মুক্তি প্রাপ্ত ছবিগুলোর ডাইমেনশন বিগত দুটি প্রশ্নের উত্তর দেবার পক্ষে যথেষ্ট।

যে সময় টালিগঞ্জ, ‘পথের পাঁচালী’ তৈরি সাক্ষী থেকেছে ‘অপুর সংসার,’ ‘অপরাজিত’ তৈরি হচ্ছে সে সময়েই টালিগঞ্জে ‘চন্দ্রনাথ’ তৈরি হয়েছে, ‘জীবন তৃষ্ণা” তৈরি হয়েছে, ‘অভয়ের বিয়ে’ তৈরি হয়েছে এবং ‘হার জিত‌’ তৈরি হয়েছে।

মহানায়ক।

আমরা এ বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত বারোটা ছবির যদি নিরপেক্ষ আলোচনা করতে পারি তাহলে দেখতে পাবো প্রতিটা ছবিকে বহুমাত্রিক রূপ দেবার চেষ্টা সে সময় উত্তমবাবু ছাড়া খুব কম লোকই পেয়েছেন বিশেষত নায়কের আসনে থেকে।

আমাদের আলোচ্য ‘হারজিত’ ছবিটির কাহিনি অত্যন্ত সাদামাটা। কিন্তু উত্তম কুমারের মুখের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন পরিচালক অনিতা গুহ-কে নায়িকা করে, যিনি পরবর্তীকালে লুকোচুরি ছবিতে অভিনয় করে যথেষ্ট সুনাম পেয়েছিলেন।

অনিতা গুহকে নেবার মতো মানসিক দক্ষতা, সে সময়ের বাঙালি দর্শকদের ছিল না।
তৎকালীন বাঙালি দর্শক উত্তম কুমারের পাশে সুচিত্রা সেনকে দেখতে না পেলে অসুস্থ হয়ে পড়তেন। মন মেনে নিত যদি সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় থাকতেন এবং রোলটা যদি সেরকম থাকতো। এরকম একটা ভাঙ্গা গড়ার মুহূর্তে নতুন নায়িকার সঙ্গে অভিনয় করে ছবি হিট করানোর দায়িত্ব নেওয়া, যে কোনও নায়কের কাছে বেশ চাপের।

পরিচালক, প্লেয়ার কাস্টিং করেন কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী দেয় পরিচালকের সমস্ত তুরুপের তাস একসাথে না ও ক্লিক করতে পারে। কারণ শুধু ছবির পরিচালকই ছবি হিট করার একমাত্র অবলম্বন হতে পারেন না। ‘হারজিৎ’ ছবির পরিচালক মানু সেন সে দিক দিয়ে খুব সচেতন ছিলেন তিনি উত্তমবাবুকে বোঝাতে পেরেছিলেন নায়িকা যেই থাকুন না কেন, আপনি অভিনয় করবেন আপনার নিজের ডাইমেনশনে। কিন্তু উত্তম বাবুর মতো সচেতন শিল্পীকে ব্যাকরণ বোঝানো কঠিন ছিল তিনি মনে করতেন নায়িকা কে নিজের মতো করে সেট করে না নিতে পারলে ছবি হিট করানো মুশকিল।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৬: বৈতরণীর পারে…

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৭: তোমায় পড়েছে মনে আবারও…

উত্তমবাবুর কেরিয়ারে শেষ দিকে এমন হয়েছিল যে, ছবির প্লেয়ার কাস্টিং কী রকম হবে, পরিচালক প্রযোজকরা উত্তম বাবুকে জিজ্ঞাসা করতেন বা পরামর্শ নিতেন। কিন্তু ১৯৫৭ সালের উত্তম, পরিচালকদের চোখে সেই মানে পৌঁছতে পারেননি। তাই নায়িকাকে স্বাধীনভাবে নির্বাচন বা মনোনয়নের দায়িত্ব ছবির কর্তৃপক্ষই পালন করেছেন। আজ আমরা বসে রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে হিট গান শুনে তৃপ্তি পাই কিন্তু ছবিটি নির্মাণের সময় সমস্ত শ্রেণির যে দলগত পারফরম্যান্স, সেটাকে উজ্জ্বল রূপে উপস্থাপন করার দায়িত্ব পরিচালক ব্যক্তিগতভাবে পালন করেন বলে মনে হয়। উত্তম কুমার এমন একজন ক্ষণজন্মা শিল্প সচেতন অভিনেতা ছিলেন যে প্রতিটা ছবিতে মনে হয় উনিই পরিচালক এবং এই অভেদ সত্তার চিন্তাভাবনা আমরা ‘নায়ক’ ছবিটিতে দেখতে পেয়েছি।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১১: মাতৃরূপে প্রথম পুজোগ্রহণ

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৪: সুন্দরবনের মৎস্যদেবতা মাকাল

পরিচালক সত্যজিৎবাবু কায়দা করে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন ‘নায়ক’-র শুটিংয়ের সময় উত্তমকে খুব কম জিনিস বোঝাতে হতো। আমার পরিচালনার পরেও ওর ছোট ছোট ডিটেলিংয়ে কিছু যোগ করতো যেগুলো আমার কাছে উপরি পাওনা বলে মনে হতো এই জায়গাতেই আমার প্রশ্ন, তাহলে উত্তম বাবুকে যে সমস্ত অ-সত্য জিৎবাবু গোষ্ঠীর পরিচালকরা মান্য করতেন তাঁদের চিন্তাভাবনা আর সত্যজিতবাবুর চিন্তাভাবনা সমান্তরাল রেখায় মিলে গেল।

আমার এত কথা বলার উদ্দেশ্য হলো ‘হারজিৎ’ ছবির কাহিনি যাই থাকুক না কেন উত্তম কুমারের অভিনয় গুণে ছবিটা যে মানে পৌঁছেছে সেটা খুব কম অভিনেতাই দায়িত্ব নিয়ে করতে পারেন।
ফিল্মলাইনে ১০ বছর হবার সুবাদে উত্তম কুমার আস্তে আস্তে দায়িত্ব সচেতন অভিনেতা হয়েছিলেন। ঠিক দশ বছর আগে স্টুডিয়োর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে একরাশ মন খারাপকে মূলধন করে যে যুবক ঘুরতেন আজ কলকাতার প্রথম শ্রেণির প্রেক্ষাগৃহে শুধু তাঁরই ছবি ডানদিক বাঁদিকে চলছে। মানুষও মাথায় করে নিয়েছেন।

এরকম একটা সাফল্যের হারকে মূলধন করে কোনও অভিনেতার জীবন না মসৃণ ভাবে এগিয়ে চলে? ‘হারজিত’ ছবির শুটিং চলাকালীন উত্তম বাবু হারানো সুর ছবির শুটিং চালু করে দিয়েছিলেন। যেখানে তিনি স্মৃতিভ্রষ্ট যুবকের চরিত্রে অভিনয় করবেন। অথচ ‘হারজিৎ’-র একজন রোম্যান্টিক নায়কের ভেতরের বেদনা ফুটিয়ে তোলার চিত্র নায়ককে দেখাতে হবে। আমার প্রশ্ন আবার সেখানে একসঙ্গে তিন-চারটে ছবির ভিন্ন ভিন্ন রোলে নিজেকে ফিট করার দক্ষতা কতটুকু বুঝেছিলেন। তাঁর অতি বড় নিন্দুকও জবাব দেবেন সবার চেয়ে সেরা।
আর এখানেই ‘হারজিৎ’ ছবির জিৎ।—চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content