ছবি প্রতীকী। সংগৃহীত।
মিত্রভেদ
অন্ধকাল গলিপথ দিয়ে নিঃশব্দে তাঁতি-বউ চলে গেল দেবদত্তের কাছে গোপন অভিসারে। এদিকে তাঁতির বাড়িতে থামে বাঁধা অবস্থায় পড়ে রইলো দ্যুতি-নাপিতনী। কিন্তু সবকিছু যতটা সহজ-সোজা তারা ভেবেছিল বিষয়টা ততটা সহজ ছিল না। কিছুক্ষণ পরেই ঘুম ভাঙলো তাঁতির। মদের নেশাটাপুরোপুরি না কাটলেও, অনেক্ষণ ঘুমিয়ে ক্রোধটা হয়তো কিছুটা কমেছিল। কিন্তু তন্দ্রার ঘোর ছিল তখনও চোখে। রাতের অন্ধকারে থামে যে তাঁতি-বউয়ের বদলে নাপিতনী বাঁধা আছে সেটা বুঝতে পারলো না সে। থামে বাঁধা এক স্ত্রীর অবয়ব দেখলো শুধু। বউকে উদ্দেশ্য করে সে বললে, ওরে কটুবাদিনী! ভালো কথা তো মুখ দিয়ে তোর বেরোয় না— যদি বলিস আজ থেকে আর বাড়ির বাইরে পা রাখবি না বা এইরকম ঝগড়া করবি না, তবেই তোর বাঁধন খুলবো আমি।
কণ্ঠস্বর শুনে পাছে বুঝতে পারে যে এ তাঁতি-বউ নয়, তাই নাপিতনী ভয়ে একদম নিশ্চুপ হয়ে রইলো। তাঁতি বারে বারে জিজ্ঞাসা করলেও নাপিতনী কোনও উত্তর দেয় না। ফল হল বিপরীত। নাপিত ক্রোধে তার খুরটা চালিয়ে নাপিতনীর নাক কেটে দেয়। বলে, ওরে শালী পুংশ্চলি! এখানেই বাঁধা থাক, আর যদি কোনওদিন তোকে আমি তোষণ করি।
এইসব শাপশাপান্ত করতে করতে নেশার প্রভাবে আবার ঘুমিয়ে যায় সে। পাশের ঘর থেকে সেই ব্রাহ্মণ দেবশর্মা সবকিছুই দেখলো। টাকা-পয়সা সব খোয়া যাওয়ায় এমনিতেই মনোকষ্টে ছিল সে, তার উপর তোষক ছাড়া একটা চৌকিতে শুয়ে কি আর ঘুম আসে? পাশের ঘর থেকে বিস্মিত হয়ে স্ত্রীলোকের বিচিত্র মানসিকতা এবং তাদের চরিত্র—সব কিছুই সে দেখলো।
এর কিছু সময় পরেই সেই তাঁতি-বউ মনের আনন্দে সেই দেবদত্তের সঙ্গে সুরতসুখ ভোগ করে যখন সন্তর্পণে নিজগৃহে ফিরে এলো তখন থামে বাঁধা নাপিতনীকে জিজ্ঞেস করলো, সবকিছু ঠিক-ঠাক আছে তো? আমি চলে যাওয়ার পর এই পাপীটা ওঠেনি তো?
নাপিতনী বলল, নাকটা বাদে বাকি শরীরটা এখনও ঠিকই আছে। তুমি তাড়াতাড়ি আমার বাঁধন খুলে দাও, আমিও বাড়ি ফিরি। তাঁতি-বউ তাকে বন্ধন মুক্ত করলে নাপিতনী আবার তাকে আগের মতোই থামে বেঁধে রাত্রি থাকতে থাকতেই সেখান থেকে গা ঢাকা দেয়।
এবার মুখ খোলে তাঁতি-বউ। ধিক্কার দিয়ে আক্ষেপের সুরে বলে, ওরে মহামূর্খ! তোকে ধিক্কার। আমার মতো সতী নারীর উপর সন্দেহ করে আমাকে অঙ্গহীন করার দুঃসাহ কি করে হয় তোর?
সেই যে কথায় আছে না চোরের মায়ের বড় গলা—তাঁতি বউ চিত্কার করে সকলে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে থাকে, “তচ্ছৃণ্বন্তু সর্বেঽপি লোকপালাঃ”—ওহে লোকপালগণ আপনারা সকলে শুনুন—
আদিত্যচন্দ্রাবনিলোঽনলশ্চ দ্যৌর্ভূমিরাপো হৃদযং যমশ্চ।
অহশ্চ রাত্রিশ্চ উভে চ সন্ধে ধর্মশ্চ জানাতি যস্য নরস্য বৃত্তম্।।
হে দ্বাদশ আদিত্য, হে চন্দ্রদেব, হে পবনদেব, হে অগ্নি! আকাশ, ভূমি, জল, যম, দিন-রাত্রি, উভয় সন্ধ্যা—আপনারা সকলে মানুষের সারাদিনের সর্ববৃত্তান্তের সাক্ষী। আপনারা জানেন যে মনে মনেও কখনও যদি আমি কোনও পুরুষকে কখনও কামনা করিনি; তাই হে দেবগণ! আমি যদি সত্যিই একজন সতী নারী হই তবে পুনরায় আমার নাসিকাকে অক্ষত করুন।
এই বলে পুনরায় সে তাঁতিকে বলল, ওরে দুরাত্মা! দেখ আমার সতীত্বের প্রমাণ—দেবকৃপায় আমার নাক অক্ষতই আছে। তাঁতি একটা জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে এসে তাঁতি-বউয়ের নাক যথাযথ দেখে বিস্মৃত হয়ে গেল। মাটিতে রক্ত প্রবাহ তখনও টাটকা। এ তো দৈবমহিমা ছাড়া আর কিছুই নয়।তাঁতি তখনই তাকে বন্ধন মুক্ত করে যত্ন করে শয্যায় এনে অনেক ভালো ভালো কথায় তাকে শান্ত করতে শুরু করল।
ব্রাহ্মণ দেবশর্মা তাঁতি-বউয়ের কাণ্ডকারখানা আড়াল থেকে দেখছে আর বিস্মিত হচ্ছে। স্ত্রীসঙ্গে অনভিজ্ঞ সন্ন্যাসীর বৈরাগ্য যেন ক্রমশ আরও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। পূর্বে পঠিত শাস্ত্রবাক্যগুলি একে একে স্মৃতিপটে উদ্ভাসিত হতে শুরু করে তার—
শম্বরস্য চ যা মাযা যা মাযা নমুচেরপি।
বলেঃ কুম্ভীনসেশ্চ সর্বাস্তা যোষিতো বিদুঃ।। (ঐ, ১৯৪)
শম্বরাসুর, নমুচি, বলি বা কুম্ভীনস যে মায়া জানে স্ত্রীলোকের কাছে সে সবের কোনটাই অজানা নয়। উত্সাহী পাঠককে বলবো শম্বাসুর [ভাগবদ্পুরাণ (৫৫/১০)], নমুচি [পদ্মপুরাণ, সৃষ্টিখণ্ড], বলি বা কুম্ভীনসের উপাখ্যান আপনারাপৌরাণিক কোনও অভিধান খুললেই পেয়ে যাবেন, এখানে সেই কাহিনিগুলো বলে প্রসঙ্গান্তরে যেতে চাই না। প্রত্যেক অসুরের কাহিনিতেই দেখবেন তারা কোনও না কোনও মায়া করতে জানতেন, যাকে বলে ব্ল্যাক ম্যাজিক। শাস্ত্রকারদের দাবিটা একটু বাড়াবাড়ি হলেও বক্তব্যটা হল স্ত্রীলোক মায়া বা ছলনা করতে নাকি ওস্তাদ। নারীবাদীদের বলবো আপনার দয়া করে হই হই করে উঠবেন না, কারণ এই ধারণা যে নির্দিষ্ট প্রেক্ষিতে ব্যক্তি বিশেষের সেটা আপনারাও জানেন; কারণ একালের মতো সেকালেও পুরুষ-নারী নির্বিশেষে ছলনা করতে ছিলেন সুদক্ষ।
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২১: এ-কালের মতো সেই পুরোনো আমল থেকেই রাজনৈতিক প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য নিষিদ্ধ প্রণয়-ফাঁদ পাতা হত
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৬: ‘কোনওদিন কিছুই ছিল না, কিছুই কিছুই নেই আমাদের আজ’
উশনা বেদ যচ্ছাস্ত্রং যচ্চ বেদ বৃহস্পতিঃ।
স্ত্রীবুদ্ধ্যা ন বিশিষ্যেত তস্মাদ্রক্ষ্যাঃ কথং হি তাঃ।। (ঐ, ১৯৬)
অর্থাৎ দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য এবং দেবগুরু বৃহস্পতিও যে শাস্ত্র জানেন, সে শাস্ত্র স্ত্রীবুদ্ধিতে স্বাভাবিকভাবেই বিরাজ করে—তাই তাদেরকে মর্যাদার মধ্যে রাখবে এ-কার সাধ্যি? যে স্ত্রীলোক মিথ্যাকে সত্য এবং সত্যকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিতে পারে, সেই স্ত্রীকে রক্ষা করা ধৈর্যবান পুরুষের কাজ নয়।
এসব দেখে শুনে সন্ন্যাসী দেবশর্মার মধ্যে বৈরাগ্য যেন আরও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। দ্যুতি নাপিতনী আর কুলটা তাঁতি-বউয়ের এই সব কাণ্ডকারখানা চোখের সামনে দেখে গোটা স্ত্রীজাতির উপরেই বিচিত্র এক ধারণা তৈরি হতে শুরু করে তার মনে। তার মনে হতে শুরু করে, স্ত্রীলোকের কথা-বার্তায় বেশি প্রভাবিত না হয়ে তার উপর কারোরই বেশি আসক্তি রাখাটা উচিত নয়; স্ত্রীলোকের স্বভাবই হলো তার প্রতি অনুরক্ত পুরুষের সঙ্গে ডানাকাটা কাকের মতন খেলা করা। প্রেমাসক্ত পুরুষকে সে আঘাত দেয়; কারণ মুখে মিষ্টিভাষা থাকলেও হৃদয় যেন তাদের বিষে ভরা। এইসব ভালোমন্দ বিভিন্ন চিন্তা করতে করতে সেই পরিব্রাজক দেবশর্মা কোনও মতে সেই তাঁতির বাড়িতে রাতটুকু কাটালো।
পরিযায়ী মন, পর্ব-৬: বৈতরণীর পারে…
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৭: তোমায় পড়েছে মনে আবারও…
সেই নাককাটা নাপিতনী ঘরের মধ্যে ইচ্ছে করেই বেশ কিছুটা সময় বিলম্ব করে নাপিতের ছুরি-কাঁচির পেটিকাটি থেকে একটা মাত্র ক্ষুর তার মুখের সামনে এনে রাখলো। সারারাত না ঘুমিয়ে রাজবাড়িতে কর্তব্য পালনের পর নাপিতের তখন সকালে গ্রাহক ধরবার তাড়া আর তার মধ্যে এতো দেরী করে নাপিতনী যখন ছুরি-কাঁচির সম্পূর্ণ পেটিকাটি না এনে তার থেকে একটা মাত্র ক্ষুর বের তার সামনে রাখে তখন নাপিতের যে মাথা গরম হবে—একথা নিশ্চয় আর ব্যাখ্যা করে বোঝানোর প্রয়োজননেই। রাগের মাথায় সেই ক্ষুরটি সে নাপিতনীর দিকে ছুঁড়ে দিলো আর সেই দুষ্টা নাপিতনী এই সুযোগটারই যেন অপেক্ষায় ছিল। নাপিত সেই ক্ষুরটা ছুঁড়ে মারতেই নাপিতনী চিত্কার-চ্যাঁচামিচি আর কান্নাকাটি করে পাড়া মাথায় তুললো। লোকজনকে ডেকে ডেকে বলতে শুরু করলো—“অহো পশ্যত পাপেনানেন মম সদাচারবর্তিন্যঃ নাসিকাচ্ছেদো বিহিতঃ”—দেখুন আপনারা দেখুন সকলে। এই নাপিত আমার মতন একজন সাধ্বী নারীর নাক কেটে দিয়েছে— “তৎ পরিত্রাযতাম্, পরিত্রাযতাম্” —আমাকে রক্ষা করুন, রক্ষা করুন আমাকে।
আজকের দিনে রাস্তায় যেমন পুলিশ ঘুরে বেড়ায় তেমনই রাজপুরুষেরা ছিল তাদের আশেপাশেই। নাপিতনীর চেঁচামিচি শুনে রাজপুরুষেরা সেখানে এসে নাপিতকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে কোমরে শক্ত করে দড়ি দিয়ে বেঁধে নাককাটা সেই পাপিতনীকে সঙ্গে নিয়ে ধর্মাধিকরণ অর্থাৎ ন্যায়ালয়ে নিয়ে এসে সমস্ত সভ্যদের উদ্দেশ্য করে বললেন—“শৃণ্বন্তু ভবন্তঃ সভাসদঃ! অনেন নাপিতেনাপরাধং বিনা স্ত্রীরত্নমেতদ্ব্যঙ্গিতম্। তদস্য যদ্ যুজ্যতে তৎ ক্রিয়তাম্”—হে সভাসদগণ আপনার সকলে শুনুন। এই নাপিত বিনা অপরাধে তার স্ত্রীরত্নটির অঙ্গহানী করেছে।তাই একে উচিত শাস্তি প্রদান করুন। সভ্যগণ রাজপুরুষদের থেকে অভিযোগ শুনে নাপিতকে জিজ্ঞাসা করলেন—“রে নাপিত! কিমর্থং ত্বযা ভার্যা ব্যঙ্গিতা? কিমনযা পরপুরুষোঽভিলাষিতঃ উতস্ত্বিত্প্রাণদ্রোহঃ কৃতঃ, কিংবা চৌর্যকর্মাচরিতম্? তত্কথ্যতামস্যা অপরাধঃ”—ওরে বেটা নাপিত! বল কেন তুই তোর স্ত্রীরঅঙ্গহানী করেছিস? সে কি কোনও ব্যভিচার করেছিল? কোনও পরপুরুষকামনা বা তোর প্রাণনাশের চেষ্টা—কী করেছিল সে? কিছু কি চুরি করেছিল? ওর অপরাধটা কি ছিল?
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১১: মাতৃরূপে প্রথম পুজোগ্রহণ
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৪: সুন্দরবনের মৎস্যদেবতা মাকাল
পাঠক-পাঠিকাদেরকে বলব, এই গল্পকে আশ্রয় করে প্রাচীন ভারতের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে একটা সাধারণ ধারণা করে বসবেন না যেন। অপরাধীর মনস্তত্ত্ব বোঝবার জন্য উপরের নিয়মটি একটা অতি সাধারণ পর্যবেক্ষণ মাত্র। আজকের দিনে আদালতে যেমন “সাক্ষ্যবিধি” বা Evidence Act মেনে বিচার হয় সে আমলেও ঠিক তেমনটাই হতো। এবিষয়ে ধর্মশাস্ত্রের “ব্যবহার” সংক্রান্ত বিষয়ে বিস্তৃত ধারণা আপনার পাবেন, কিন্তু এখানে প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার ভয়ে এগুলো নিয়ে আর কথা বাড়ালাম না।
ধর্মাধিকরণের সদস্যরা একমত হয়ে বললেন, “তদেষঃ দুষ্টচরিত্রলক্ষণো দৃশ্যতে। স্ত্রীধর্ষণাদ্ বধ্য ইতি। তচ্ছূলীযামারোপ্যতাম্”—সবস্ত লক্ষণই বলে দিচ্ছে এই লোকটা দোষী। স্ত্রীকে অপমানিত করবার জন্যেই এই নাপিতটি তার স্ত্রীয়ের নাক কেটেছে। একে শূলে চাপিয়ে হত্যা করা হোক।—চলবে।