ফলনাপুর মদনমোহন মন্দির।
কোচ স্থাপত্যের আরেকটি অত্যুৎকৃষ্ট নিদর্শন ফলনাপুর মদনমোহন মন্দির। এই দেবায়তনটি কোচবিহার শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরত্বে শীতলখুচির মহিষমুড়ি এলাকার ফলনাপুর গ্রামে অবস্থিত। ১৯৪৯ সালে যখন কোচবিহার ভারতভুক্ত হয়েছিল এই মন্দিরটি দীর্ঘদিন সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ছিটের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় চুক্তির পর বর্তমানে এটি ভারতের অংশভুক্ত হয়েছে। মন্দিরটির বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত জরাজীর্ণ। পাঁকুড় গাছের শেকড় কর্তৃক আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িত থাকায় গঠনশৈলী তথা অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যবৈশিষ্ট্য সনাক্তকরণ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কালের করাল গ্রাসের পাশাপাশি ১৮৯৭ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পেও ফলনাপুর মদনমোহন মন্দিরটির স্থাপত্যগতভাবে প্রভূত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। যেমন মন্দিরের দ্বিতলে ওঠার সিঁড়ির ধ্বংসপ্রাপ্তি তথা মন্দিরটির নিম্নতলের অনেকাংশ মাটিতে হেলে বসে গিয়েছে। ফলে এর উচ্চতারও হ্রাস পেয়েছে। নিঃসন্দেহে প্রতীত হয়। তবে জনশ্রুতি ও ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখেছি, দেবায়তনটি কোচ স্থাপত্যের খুব সম্ভবত একমাত্র দ্বিতল পঞ্চরত্ন মন্দিরস্থাপত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পশ্চিমমুখী এই সৌধটির উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট ও দেওয়ালের পুরূত্ব প্রায় ৪.৫ ফুট। মন্দিরটির নির্মাণকাল নিয়ে প্রামাণিক তথ্য নেই বললেই চলে। তবে স্থানীয়দের মত অনুযায়ী, এটি আনুমানিক ৩০০ বছর পূর্বে এই অঞ্চলের তৎকালীন জমিদার জগৎরামের স্ত্রী মনোরমা দেবীর সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মীত হয়েছিল।
আরও পড়ুন:
মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৬: খামার সিতাই বুড়া শিবমন্দির —এক অনালোকিত দেবায়তন
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৪: সুন্দরবনের মৎস্যদেবতা মাকাল
দেবায়তনটিতে বিবিধ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যবৈশিষ্ট্যের সমাহার নজরে পড়ল। তার মধ্যে সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য হল, মন্দিরের অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেওয়ালগাত্রে বিভিন্ন আকৃতির কুলুঙ্গির অস্তিত্ব এবং সেই সঙ্গে মন্দিরের স্থাপত্যে স্তম্ভশীর্ষের ঠিক উপরে অবস্থিত মাথাটির নিম্নতম অংশে (Architrave) ফুলেল অলঙ্করণ যা, সবমিলিয়ে আলোচ্য স্থাপত্যে গথিক ও মুরিশ স্থাপত্যশৈলীর যু্গ্ম প্রভাবকে সুনিশ্চিত করে। মন্দিরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কোচ স্থাপত্য কামতেশ্বরী মন্দিরের ন্যায় বহুখাঁজবিশিষ্ট অলঙ্করণসমৃদ্ধ কৃত্রিম দ্বার তথা বাতায়নের উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়। সৌধটির বহির্দেওয়ালগাত্রের কিছু কুলুঙ্গিতে বেশ কিছু নিখুঁতভাবে খোদিত মূর্তিসমূহ রয়েছে (আলিঙ্গনরত যুগল, তীর নিক্ষেপরত ধনুর্ধর মূর্তি) যা, সুনিশ্চিতভাবে স্থপতির শিল্পজ্ঞান তথা সৌন্দর্যবোধকে প্রত্যয়িত করে।
আরও পড়ুন:
পরিযায়ী মন, পর্ব-৬: বৈতরণীর পারে…
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৯: তুনে ও রঙ্গিলে ক্যায়সা জাদু কিয়া… লতার সেই সুরেলা কণ্ঠ ও পঞ্চমের জাদু
ফলনাপুর মদনমোহন মন্দিরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যবৈশিষ্ট্যটি হল, এর উভয় তলেই অভ্যন্তরস্থ পূর্বমুখী ও উত্তরমুখী দেওয়ালগাত্রে মিহরাব-এর উপস্থিতি (প্রায় ৫ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট) যা, অনেকটা দেওতাপাড়া শিব মন্দিরের অনুরূপ আকৃতিসম্পন্ন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল পূর্বে আলোচিত রাজমাতা মন্দিরের ন্যায় বাতায়নের উপস্থিতি যা, হিন্দু মন্দির স্থাপত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যটির মূল কার্যকারিতা হল এটি মন্দির অভ্যন্তরে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের সরবরাহ সুনিশ্চিত করে। মন্দিরটির দক্ষিণদিকস্থ একটি সুপ্রাচীন বৃহৎ ইঁদারা রয়েছে, খুব সম্ভবতঃ দীর্ঘকাল ধরে মন্দিরের প্রাত্যহিক নিত্যকর্মে জলের যোগানকে সুনিশ্চিত করেছে এটা প্রতীত হয়।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৬: ‘কোনওদিন কিছুই ছিল না, কিছুই কিছুই নেই আমাদের আজ’
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১১: মাতৃরূপে প্রথম পুজোগ্রহণ
মন্দিরটি স্থাপত্যগত দিক থেকে বিবিধ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ হলেও এর বর্তমান দৈন্যদশা স্থাপত্যপ্রেমী তথা গবেষক হিসেবে বিষাদের উন্মেষ করে। পাশাপাশি এই দেবায়তনকে কেন্দ্র করে পূর্বে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের (যেমন: জন্মাষ্টমী, দোলযাত্রা, দুর্গাপুজো ইত্যাদি) যে সমারোহ দেখা যেতো। বর্তমানে এর আড়ম্বর তথা জৌলুষ অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছে। যদিও স্থানীয় মানুষজনের আপ্রাণ প্রচেষ্টা সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু যত দ্রুত সম্ভব সরকারি স্তরে (রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের মাধ্যমে) এই অতুলনীয় সৌধের সংস্কারপ্রক্রিয়ার সূত্রপাত না ঘটলে তা নিশ্চিতভাবে কোচস্থাপত্যের এই অনুপম কীর্তির পক্ষে দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে আসবে এটা সুনিশ্চিতভাবে বলা যায়।
বহির্দেওয়ালগাত্রের কিছু কুলুঙ্গিতে বেশ কিছু নিখুঁতভাবে খোদিত মূর্তিসমূহ (আলিঙ্গনরত যুগল, তীর নিক্ষেপরত ধনুর্ধর মূর্তি)।
দেওতাপাড়া মন্দিরের ন্যায় এই দেবায়তনটিরও নির্মাণকাল খুব সম্ভবত ষোড়শ শতকের মধ্য বা অন্তিম পর্বে। কারণ, বাংলায় রত্নশৈলীর মন্দিরের প্রচলন তথা জনপ্রিয়তা বাংলার মন্দির স্থাপত্যের পুনরুজ্জীবন পর্বে লক্ষিত হয়, যা ষোড়শ থেকে উনবিংশ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত। এটা বলা যায় যে, ফলনাপুর মদনমোহন মন্দিরটি নিজ স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। কারণ, এটা প্রায় নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, কোচ স্থাপত্যের দ্বিতল পঞ্চরত্ন মন্দিরের এটি একমাত্র নিদর্শন। নিজ বহুমুখী উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যবৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে আলোচ্য সৌধটি এই অঞ্চলের মন্দিরস্থাপত্যে অন্যতম সর্বোত্তম স্থান নিয়ে নিয়েছে। —চলবে।
ছবি: লেখক
ছবি: লেখক
* মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ (Temples in North Bengal): অর্ক আচার্য (Arka Acharjee), অধ্যাপক ও গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়, কোচবিহার। লেখকের গবেষণার বিষয়: ‘Origin and Development of Unique and Composite type of Temple Architecture from 16th to 19th Century in the Northern Region of Bengal.’